যারাই ক্যাম্পাসের হস্টেলে থেকে কয়েকবছর পড়াশোনা করেছেন, তাঁরাই জানবেন যে প্রতিটি কলেজের ক্যাম্পাসের ছাত্রছাত্রীদের জন্য একটা ছোট মেডিক্যাল সেন্টার থাকে। বিই কলেজেও একটি প্রাগঐতিহাসিক যুগের হাসপাতাল ছিলো। ’৭০ এর দশকে পড়বার সময় অনেক প্রাক্তনীর মুখে মুখে অনেককিছু শোনা যেত। সেই পটভূমিকায় এই স্যাটায়ার। গপ্পোটার প্রথম দু’পাতা ভূমিকা। এই ভূমিকা না দিলে গপ্পের প্লট তৈরি হবে না।
হোস্টেলে শৈবালের খাওয়া ঠিকমতন হচ্ছে না। পেটে একটা অস্বস্তি, মাঝেমাঝেই ব্যাথা হয়। হেডঠাকুরের স্পেশাল ডায়েট ঝোল খেয়েও কমছে না। তিন সপ্তাহ হয়ে গেছে, এবার শৈবালের হোস্টেলের দুই রুমমেট অশোক আর তনোজ ওঁকে কলেজের হাসপাতালে নিয়ে গেলো।
এই হাসপাতালটির ভূমিকা দিয়ে রাখি। সাহেবদের আমলে এই ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ক্যাম্পাসের লোকজনদের সাধারণ চিকিৎসার জন্য ক্যাম্পাসের মধ্যেই এই হাসপাতালটি তৈরি হয়েছিলো। এখন আছেন একজন ডাক্তার, আছেন দুজন কম্পাউণ্ডার। আছে তিনটি ইনডোর কেবিন আর দশটা জেনারেল বেড। আছে প্রচুর ইংরেজ আমলের যন্ত্রপাতি, যার অধিকাংশই এখন কাজ করে না। স্টোরে বোতলে রঙবেরঙের মিক্সচার ওষুধ আছে। ওষুধের কোনো নাম নেই। এক নম্বর ওষুধ, দুই নম্বর ওষুধ এইভাবেই বোতলগুলোকে মার্ক করা। এর বাইরে অন্য ওষুধ লাগলে রোগীকে বাজারে গিয়ে পয়সা দিয়ে কিনতে হয়।
লোকমুখে প্রচলিত যে এই হাসপাতালের ডাক্তার আসলে একজন ইঞ্জিনিয়ার, এই কলেজ থেকেই পাশ করা। ইঞ্জিনিয়ারিং চাকরি ভালো লাগেনি, তাই ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রী নিয়েই এখানে ডাক্তারি করছেন। নাম ডঃ জ্যাঙ্গো।
বন্ধুরা শৈবালকে হাসপাতালে ডঃ জ্যাঙ্গোর কাছেই নিয়ে গেলো। উনি তখন রোগী দেখছেন, কলেজের একটি ছাত্র, ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। সর্দিকাশি হয়েছে। ডঃ জ্যাঙ্গো স্টেথোস্কোপ খুজে পাচ্ছেন না। কম্পাউন্ডারবাবুকে ডাকলেন, স্টেথোস্কোপ কোথায়? কম্পাউন্ডারবাবুই এসব খেয়াল রাখেন। “স্যার, আপনি তো কালই ওটা ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের হেড ঘোড়াবাবুকে দিয়েছেন। উনি ফিজিক্স ল্যাবে সাউণ্ডের কি সব এক্সপেরিমেন্ট করবেন বলেছেন।”
– ওঃ, তাই? মনে ছিল না। ভালো ভালো, খুব ভালো। কিন্তু স্টেথোস্কোপ ছাড়া বুকে সর্দি কিভাবে বুঝবো?
কম্পাউন্ডারবাবু এইসব সমস্যা খুব ভালো ম্যানেজ করেন। এতবছর এইভাবেই চালিয়ে আসছেন। কানে কানে বললেন “ছ্যার। ফাচট ইয়ারের চেলে, কেন জামেলায় যান? এই পোতমবার এচেচে। দিন এক নম্বর চবুজ মিকচচারটা তিনদাগ। আপনার কাজ হয়ে যাবে।” ডঃ জ্যাঙ্গো প্রেসক্রিপশন লিখে দিলেন, এক নম্বর সবুজ ওষুধ, দিনে তিনবার এক দাগ করে খাবে।
এক মিনিটেই ছেলেটি ফিরে এলো, সঙ্গে কম্পাউন্ডারবাবু। “ছ্যার, বুল হয়ে গেচে। এই এক নম্বর চবুজ ওচুধটা শেষ হয়ে গেছে।”
– কেন? কালকেই তো স্টকে ছিল।
– হ্যাঁ ছ্যার, বুলে গেচিলাম। মনে নেই? গতকাল লেডিচ হোচটেলের ঝি এচেছিলো। ওঁর পায়ের আঙ্গুলে হাজা ছিলো? কালকে আপনিই তো এই এক নম্বর ওচুধটাই পায়ের হাজায় লাগানোর জন্য দিয়েছেন।
– তাই? তাহলে চার নম্বরে অনেকটা জল মিশিয়ে ছেলেটাকে দিয়ে দাও। আর রঙটাও সবুজ করে দিও।
কম্পাউন্ডার আর ছেলেটি চলে গেলো।
এবার শৈবালের পালা। এই হাসপাতালে সে এই প্রথমবার। আগের কেসটার সব দেখলো, শুনলো। তবু এসেছে যখন, একবার ডাক্তারের পরামর্শ না নিয়ে সে ফিরে যাবে না। ডঃ জ্যাঙ্গো শৈবালের সমস্যা শুনলেন।
– তার মানে পেটের গণ্ডগোল? পায়খানা হয়?
– হয় স্যার।
– তুমি কি সিওর যে তোমার পায়খানা হয়?
– হ্যাঁ স্যার, হয়। প্রত্যেক দিন সকালে ক্লাসে যাওয়ার আগে।
– নিজের চোখে দেখেছ? হয়?
– হ্যাঁ স্যার, রোজ সকালে হয়।
– কিরকম হয়?
– হ্যাঁ স্যার। কখনো ভালো হয়, আবার কখনো একটু খারাপ।
– আরে সেভাবে বললে কি চিকিৎসা হয়? কি রঙের হয়? কিরকম ভালো হয়? সেটা তো বলো।
– স্যার, ভালো মানে, আমরা যাকে ভালো বলি, সেরকম। মানে ভালোই হয়।
– এভাবে নয়। এভাবে নয়। কালার আইডেন্টিফিকেশনটা খুব ইম্পরট্যান্ট। কালকে টর্চের বা মোমবাতির উজ্জল আলোয় ভালো করে দেখবে, খুব মন দিয়ে দেখবে। কি রঙের হয় সেই রঙটা আইডেনটিফাই করবে। দরকার হলে শালিমার পেন্টসের দেওয়াল রং করার ক্যাটালগ রেফার করবে। রঙটা আইডেনটিফাই করবে। বুঝলে?
– স্যার হস্টেলে টর্চ তো নেই, মোমবাতিই কিনে নেবো। কিন্তু স্যার, জ্বলন্ত মোমবাতি হাতে নিয়ে পায়খানা …… সেটা কি করে করবো?
– তাহলে তোমার ট্রিটমেন্ট আমি করতে পারবো না, অন্য জায়গায় যাও।
– আচ্ছা স্যার। আচ্ছা স্যার। তাই করবো।
– বায়ু, মানে গ্যাসের সমস্যা আছে?
শৈবাল কিছু বলার আগেই বন্ধু অশোক পাশ থেকে বলে দিলো, “হ্যাঁ স্যার, ভীষণ সমস্যা। মাঝরাতে কতবার যে আমাদের ঘুম ভেঙ্গে যায়।“
– সেটাই আন্দাজ করেছিলাম। তাহলে যাও, তোমার ইউরিনটাও দেরি না করে এখনই টেস্ট করিয়ে নাও। ওই কোনায় কম্পাউন্ডারবাবু আছেন, ওনার কাছে যাও।
– আচ্ছা স্যার।
– আর, বলছি তোমার শরীরে কোথাও উকুন আছে?
শৈবাল বুঝতে পারে না পেটের রোগের সাথে চুলে উকুনের কি সম্পর্ক। তবু, উত্তর দিলো, “ উকুন? না ডাক্তারবাবু, আমার চুলে উকুন নেই।“
– চুল ছাড়াও তো শরীরের অন্যান্য জায়গায় উকুন হয়। সেটাও জানো না? বগলের গন্ধ কি রকম?
– মানে?
– মানে তোমার বগলে কি বাজে দুর্গন্ধ হয়?
এবার শৈবালের আবার টেনশন শুরু হয়ে গেলো। উকুন? বগলের গন্ধ? পেটের রোগের সাথে কি সম্পর্ক?
– ডাক্তারবাবু, আমার ব্যাথাটা পেটে। তার সাথে উকুন আর বগলের গন্ধের সম্পর্কটা ………
– থাকে থাকে থাকে। পেট থেকে বুক আর বগল কত দূরে? মাত্র ছ’ ইঞ্চি। পাশাপাশি দুটো ইউনিট। একটা খারাপ হলে অন্যটাও বিগড়ে যায়। এটা ডাক্তারি, তোমাদের ইঞ্জিনিয়ারিং নয়, যা বলছি মন দিয়ে শুনবে।
এইবার ধীরে ধীরে শৈবালের রাগ জমছে। ডঃ জ্যাঙ্গোও বুঝতে পারছেন যে শৈবাল ক্রমেই অধৈর্য হয়ে উঠছে।
– এখন যাও, কালকে এসে পায়খানার স্ট্যাটাস দেবে। কোন ইয়ার তোমার?
– স্যার ফার্স্ট ইয়ার।
– এক নম্বর ওষুধ। সবুজ মিক্সচার, দিনে তিনবার। আর রাত্রে শুধু শসা আর দুধ। লিখে দিলাম।
শৈবাল আঁতকে উঠলো।
– স্যার, আপনি এক নম্বর ওষুধটা এই আগের ছেলেটিকে দিলেন, নাকে সর্দির জন্য। লেডিস হোস্টেলের ঝিয়ের পায়ে হাজাতেও ঐ একই ওষুধ দিয়েছেন। আমার পেটের গণ্ডগোলেও একই ওষুধ?
– ওকে ওকে। গুড অবজারভেশন, আমার খেয়াল ছিলো না। তোমাকে অন্য ওষুধ লিখে দিচ্ছি।
– আমার রোগটা কি ডাক্তারবাবু?
– মনে হয় তোমার ইন্টিগ্রেটেড মিড বডি ফেলিওর এফেক্ট হয়েছে। তোমার পেটে আর বুকে স্ক্যান করাতে হবে। আবার মাথায় হাইব্রিড গণ্ডগোলের রোগও হতে পারে। কাল পায়খানা টেস্ট আর ইউরিন রিপোর্টটা পেলেই সব বোঝা যাবে।
– স্যার বগলে রোগ হলে পেটে ব্যাথা হবে?
– হবে, হবে, হবে। আর কথা নয়। এবার ওষুধ নিয়ে হস্টেলে যাও। রাত্রে পান্তা ভাত, বেগুন ভাজা।
শৈবালের ভ্রু কুঁচকে গেলো। “স্যার, পান্তা ভাত? আপনি তো লিখে দিয়েছেন দুধ শশা।“
– দুধ শশা? দেখি দেখি।
ডাক্তারবাবু নিজের লেখা প্রেসক্রিপশন দেখলেন, বললেন, “তাহলে দুধ শশাই খাও।“
হাসপাতাল থেকে বেরোনোর সময় শৈবাল প্রেসক্রিপশনটা কম্পাউন্ডারবাবুকে দেখালো। উনি দেখলেন। শৈবালের ইউরিন স্যাম্পল নিয়ে নিলেন। আর ওষুধও দিয়ে বললেন, “রাতে চুদু চচা আর দুদ।“
– চচা?
– হ্যাঁ, চচা কাবে, আর দুদ কাবে, অন্য কিচু নয়।
পরদিন বিকেলে শৈবাল আর দুই বন্ধু আবার ডঃ জ্যাঙ্গোর কাছে গেলো। “ওঃ, এসে গেছো? তোমায় যা দেখতে বলেছিলাম, দেখেছো?”
– হ্যাঁ স্যার। দেখেছি। একটা প্রায় তিন চার ইঞ্চি লম্বা সিঙ্গল পিস বেরিয়ে এলো। শুধু একটাই পিস স্যার, খুব টাইট।
– ঠিক করে বলো, তিন ইঞ্চি না চার ইঞ্চি?
– স্যার, মনে হয় সাড়ে তিন ইঞ্চি হবে।
– ফার্স্ট ইয়ারে সাড়ে তিন ইঞ্চি খারাপ নয়। মুচিপাড়ায় জল খারাপ। নইলে আরও লারজ সাইজ পেতে। রাত্রে ডালের সাথে কটা রুটি খাও?
– আজ্ঞে, স্যার সব মিলিয়ে সাত আটটা।
– এইজন্যই তো সাইজ ছোট। পনেরোটা কুড়িটা রুটি খাবে। বুঝলে? সাইজ বাড়বে।
শৈবাল মাথা নাড়লো, যেন অনেককিছুই বুঝেছে।
– আর, পায়খানা কি রঙের ছিলো?
– হলুদ স্যার। তবে কিছু লাল আর কালো কালো স্পট আছে।
– হ্যাঁ, হ্যাঁ হ্যাঁ বাব্বা। আমি যা ভেবেছিলাম, ঠিক তাই। লাল কালো রঙ মানেই তোমার পায়খানায় জং ধরেছে।
পায়খানায় জং? শৈবাল বুঝতে পারে না। “স্যার, পায়খানায় জং ধরেছে? মানে মরচে?”
– ইয়েস মাই বয়। তোমাদের মুচিপাড়ায় জল খারাপ, তাই লাল কালো স্পট। সাহেবপাড়ায় এইসব দাগ পাবেনা। ওখানের জল খুব ভালো। তবে চিন্তা করো না, এক নম্বর সবুজ ওষুধে ঠিক হয়ে যাবে।
– আবার স্যার এক নম্বর সবুজ ওষুধ? মানে যেটা ঝিয়ের পায়ে হাজা সারায়?
– চুপ, একদম চুপ। তুমি এক নম্বর সবুজ খাবে, না দশ নম্বর গোলাপি খাবে, সেটা তুমি ঠিক করবে?
এবার ডঃ জ্যাঙ্গো ড্রয়ার থেকে একটা রিপোর্ট বার করে সেটা হাতে নিয়ে একবার বাইরের জানালায়, একবার ছাদের ফ্যানের দিকে তাকিয়ে কি যেন সব ভাবতে শুরু করলেন। মনে হয় গভীর চিন্তায় চলে গেলেন। একটু পরে প্রশ্ন করলেন “তুমি তোমার ইউরিন স্যাম্পেল কাকে গিয়ে দিয়েছিলে?
– স্যার, ওই কম্পাউন্ডারবাবুকে।
ডঃ জ্যাঙ্গো আবার চুপ, কি যেন ভাবছেন। শৈবাল বুঝতে পারছে না যে কি এমন সাংঘাতিক রোগ ধরা পরেছে। “স্যার, আমার কি কোনো কঠিন রোগ হয়েছে?”
– আগে বলো তো, তোমার কি বমি হয়?
– হ্যাঁ ডাক্তারবাবু, প্রায়ই হয়।
– হয়? সিওর হয়?
– হ্যাঁ, ডাক্তারবাবু, হয়।
ডঃ জ্যাঙ্গোর চোখদুটো যেন খুশিতে ভরে গেলো, “তাহলে আমার ধারনাই ঠিক।“
ডঃ জ্যাঙ্গো এবার শৈবালকে আর দুই বন্ধু আশোক, তনোজকে অন্য একটা ফাঁকা ঘরে নিয়ে গেলেন।
– তাহলে শোনো। উত্তেজিত হবে না। আগে মন দিয়ে মাথা ঠান্ডা করে শোনো। তোমার ইউরিন স্যাম্পেল বলছে তুমি এখন প্রেগন্যান্ট। মানে তুমি পুরুষ মানুষ হয়েও অন্তঃসত্বা হয়েছো।
শৈবাল মানতে রাজি নয়। কিসব আবোলতাবোল বকছে? “স্যার, এই রিপোর্টের মানে খুবই সিম্পল। ইউরিন রিপোর্ট ভুল এসেছে। বা রিপোর্ট বদলে গেছে। আমি একটা ব্যাটাছেলে। আমি মেয়ে নই।“
– সেটাই তো বলছি। তুমি একশো পার্সেন্ট ব্যাটাছেলে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তুমি এখন সায়েন্সের জগতে প্রথম অন্তঃসত্ত্বা পুরুষমানুষ। আরও শোনো, গতকাল তোমার ছাড়া আর অন্য কারোরই ইউরিন টেস্ট হয়নি। সুতরাং, রিপোর্ট যে পাল্টাপাল্টি হবে, সেটাও অসম্ভব।
– কি বলছেন স্যার?
– আমি কিছুই বলছি না। তোমার ইউরিন রিপোর্ট বলছে।
আবার বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ। শৈবাল দুরের লোকজনদের দেখছে, তাঁরাই বা শুনলে কি ভাববে? পাশের অশোক আর তনোজ শৈবালকে ধরে আছে, যেন অজ্ঞান না হয়ে যায়।
ডঃ জ্যাঙ্গো একটু শান্ত হয়ে বললেন
– শোনো। মাথা ঠান্ডা করে শোনো। এইসময় তোমার টেনশন করা উচিৎ নয়। সবার আগে জানা দরকার তুমি কিভাবে প্রেগন্যান্ট হলে? লজ্জা লাগলে তুমি আমায় গোপন জবানবন্দী দিতে পারো। তারপর তোমার বডির স্ট্রাকচারটা আমাকে জানতে হবে। মেয়েদের একটা ডেলিভারির সিস্টেম আছে। কিন্তু পুরুষদের? তোমার বাচ্চাটাকে তোমার বডির থেকে কিভাবে ডেলিভারি করিয়ে বার করে নিয়ে আসবো সেটাই তো বুঝতে পারছি না।
শৈবাল,অশোক, তনোজদের মাথায় কিছুই ঢুকছে না। কেউ কিছু বলতেও পারছে না।
– এই যে বন্ধুরা। তোমাদের রুমমেট প্রেগন্যান্ট হয়ে গেলো, আর তোমরা জানতেই পারলে না?
বন্ধুরাও শুনছে। কেউ কথা বলছে না।
– শোনো বন্ধুরা, এবার আর গাফিলতি নয়, তোমাদের খেয়াল রাখতেই হবে। যদি তোমার বন্ধুর লেবার পেন হয়, নেগলেক্ট করবে না। সঙ্গে সঙ্গে আমাকে খবর দেবে।
ডঃ জ্যাঙ্গো প্রেসক্রিপশন লিখে দিলেন। বন্ধু অশোক অনেকক্ষন পরে মুখ খুললো। “ডাক্তারবাবু ওর রোগটা কি খুব সিরিয়াস?”
– সিরিয়াস হতেও পারে, আবার নাও হতে পারে। বোঝার চেষ্টা করো। একে প্রেগন্যান্ট। তার উপর গ্যাসের গোলমাল, পেটে গণ্ডগোল, পায়খানায় জং। কমপ্লিকেটেড কেস। সবার আগে পেটের বাচ্চাটাকে বাঁচিয়ে তোমার বন্ধুর পাইপলাইন এসিড দিয়ে ধুয়ে দেবো, সব জং পরিষ্কার হয়ে যাবে।
– এসিড দিয়ে ওয়াশ করবেন?
– হ্যাঁ। পিচকিরিতে সালফিউরিক এসিড ভরে ওর পিছনের নালীতে স্প্রে করলেই জং মরচে সব একবারেই গলগল করে বেরিয়ে আসবে।
ডঃ জ্যাঙ্গো প্রেসক্রিপশন লিখে দিলেন, কাউন্টারে গিয়ে ব্লাড প্রেশারটা চেক করতে হবে। সেখানে গিয়ে আরেক সমস্যা। কম্পাউন্ডারবাবু আবার এলেন, “ছ্যার, আমাদের বেলাড প্রেচার মাপার যন্তর তো গত বছর বিলেতে চার্ভিচে পাঠিয়েছি, এখনও ফেরত আসে নি।”
– সামান্য একটা প্রেসার মাপার যন্ত্র বিলেতে রিপেয়ার হবে? কেন?
– ছ্যার, ১৯৩০ সালে বিলেত তেকে কে একজন উলফেনদেন না রিচারদসন সাহেব ঐ যন্ত সঙ্গে করে নিয়ে এচেচিলেন। সেই যন্ত গত বচরেই কারাপ হয়ে গেচে। এখন আমাদের প্রেচার মাপার কোন যন্তই নেই।
– কি মুশকিল? আমাকে জানিয়ে রাখবেন তো। এখন আমি কি করি? তা আপনার ঐ মেশিন কবে ফেরত আসবে?
– জানিনা ছ্যার। এদেচে ওই যন্তরের ইস্পেয়ারস নেই। বিলেতে রিচারদসন চাহেবের এক নাতনীর পুলনো গাড়ি সারানোর গ্যারেজ আচে। ওখানেই যন্তরটার চার্ভিচ হবে।
– গাড়ির ওয়ার্কশপে ডাক্তারির ব্লাড প্রেসার মাপার যন্ত্র সারানো হবে? তাও আবার বিলেতের গ্যারাজে? কেন? আমাদের এত বড় ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের অটোমোবাইল ওয়ার্কশপে একটা বিপি মাপার যন্ত্র সারাতে পারলো না?
– না ছ্যার। ভঞ্জবাবু, অমিয়বাবু রিতায়ার করার পর আমাদের ওয়ার্কচপে ভালো কেউ আর নেই স্যার।
– কিসসু হবে না, এই কলেজের ইঞ্জিনিয়ারদের দিয়ে কিসসু না। এত বড় একটা অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ। ডাক্তারির সামান্য একটা বিপি মাপার যন্ত্র সারাতে পারে না?
শৈবালকে বললেন, “এখন যাও। কালকে আবার আসবে, তোমাকে প্রেগন্যান্সির অন্য টেস্টগুলোও করতে হবে।“
খবরটা চাপা রইলো না। ইউরিন টেস্টে শৈবালের প্রেগন্যান্ট হওয়ার খবর কলেজে রটে গেলো। পরদিন ক্লাসে অঞ্জনা তো বলেই দিলো “কিরে। তোর নাকি লেবার পেন শুরু হয়েছে?” ডিপার্টমেন্টে অঞ্জনা একটাই মেয়ে, বাকিগুলো আর্কিটেকচারের, ওরা আলাদা গ্রুপ নিয়ে থাকে। নইলে শৈবালের ক্যাম্পাস ছেড়ে পালানো ছাড়া আর উপায় থাকতো না।
পরদিন শৈবাল দুই বন্ধুকে নিয়ে গেলো ডঃ জ্যাঙ্গোর কাছে। ডাক্তারবাবু এক রোগীকে দেখছিলেন। কলেজেরই ছাত্র, সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। গতকাল এসে জ্বরের ওষুধ নিয়ে গিয়েছিলো। সেই ওষুধ খেলেই সঙ্গে সঙ্গে পেট ছাড়ছে। ডাক্তারবাবু খুব জোরে জোরে টিংটিং টিংটিং বেল বাজালেন। এই বেল বাজানোর সাঙ্কেতিক নির্দেশ আছে। একবার বাজালে পরের রোগীকে ডাকছেন। দু তিনবার আস্তে আস্তে বাজালে কম্পাউন্ডারকে ডাকছেন। আর জোরে একটানা বাজালে হয় এমারজেন্সি, নয়তো উনি ঘাবড়ে গেছেন বা ভীষণ রেগে আছেন। কম্পাউন্ডারকে তখনই সেই মুহূর্তেই দৌড়ে আসতে হবে। তাই হয়েছে। কম্পাউন্ডার বাবু দৌড়ে এসেছেন। প্রথমেই স্টাডি করছেন ডাক্তারবাবুর কি হয়েছে। বুঝলেন না। “কি হয়েচে ছ্যার?”
– আপনি জানতে চাইছেন কি হয়েছে? আপনাকে পই পই করে বলেছিলাম যে এই জ্বরের ওষুধটা কেরোসিনের জারে রাখবেন না। পই পই করে মানা করেছিলাম। কিন্তু আপনি শুনলেন না। এখন দেখুন অবস্থা। এই ছেলেটা এক চামচ করে জ্বরের ওষুধ খাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে এক বোতল স্যারররররর করে বেরিয়ে যাচ্ছে।
রোগী ডাক্তারবাবুকে শুধরে দিলো। “ডাক্তারবাবু। সকাল থেকে কতবার যে বাথরুমে দৌড়লাম?”
ডঃ জ্যাঙ্গো রাগে আগুন। “শুনছেন? শুনছেন? জ্বরের ওষুধ খেয়ে পেট ছাড়ে, কোথাও শুনেছেন? এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে একমাত্র আমাদের এই হাসপাতালেই এটা সম্ভব।”
– ছ্যার, আমি কি করবো। একতাও জার খালি নেই।
– তাই বলে কেরোসিনের জারে রোগীর খাওয়ার ওষুধ রাখবেন? কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টে থেকে একটা জার আনতে পারলেন না?
– গিয়েচিলাম ছ্যার। ওদের বোতলগুলো ফাইনাল ইয়ারের ছেলেরা হস্তেলে নিয়ে গেচে। গ্রান্দ ফিসতের আগে ওরা নাকি ভাত আর আঙুরের রস পচিয়ে চরবৎ বানাবে।
ডঃ জ্যাঙ্গো এতই রেগে আছেন যে কম্পাউন্ডারবাবুকে বকেই ভাগিয়ে দিলেন।
ডঃ জ্যাঙ্গোর টেবিলে ফোন বেজে উঠলো। শৈবাল দেখছে কথা বলার সাথে সাথে ডঃ জ্যাঙ্গোর মুখের হাসি, মুখের হাঁ, আর চোখদুটি ছোট থেকে আস্তে আস্তে ক্রমেই বড় হচ্ছে। “ঠিক আছে স্যার, ঠিক আছে।…….. সিজারিয়ান ডেলিভারি? ……. হ্যাঁ স্যার………… হ্যাঁ স্যার, আমি ওর রেগুলার খেয়াল রাখবো। ……. হ্যাঁ স্যার, হোস্টেলও চেঞ্জ করে দেবো। ঠিক আছে স্যার, রাখছি।”
ডঃ জ্যাঙ্গো ফোনটা নামিয়ে রাখলেন। চোখ মুখের চেহারা কিরকম যেন? রিলিফ? না টেনশন? বোঝা যাচ্ছে না।
ডঃ জ্যাঙ্গো বেশ পুলকিত হয়ে বললেন, “শুনলে? হাওড়া হাসপাতালের মেডিক্যাল বোর্ড থেকে ফোন আসছে। বিশ্বের এই প্রথম একজন পুরুষের সিজারিয়ান কেস। আমার হাসপাতালেই হবে। গিনেস বুক অফ রেকর্ডে তোমার নাম উঠবে। কিন্তু আমি যে কি করি? আমি তো আর গাইনোকলজিস্ট নই। কিছুই জানি না কিভাবে পুরুষ মানুষের সিজারিয়ান হয়। বুঝতে পারছো, তুমি নিজের ফুর্তি করতে গিয়ে আমায় কি বিপদে ফেলেছো?”
শৈবাল ভেবেই পায় না কি বলবে? আর ডঃ জ্যাঙ্গোর চিন্তা অন্যখানে।
– বাচ্চারা মায়ের দুধ খায়। আর তোমার বাচ্চা বাবার দুধ খাবে। সেটা কিভাবে সম্ভব? ভেবেই তো কূলকিনারা পাচ্ছি না! তার উপর তোমার গ্যাসের গোলমাল। পেটের বাচ্চাটা তো গ্যাস চেম্বারের ছটফট করবে। দমবন্ধ হয়ে মরবে।
আরও বললেন, “শুধু তাই নয়। তোমার পেটে যদি উকুন হয় তাহলে চান্স আছে তোমার ওই বাচ্চা জন্ম থেকেই মাথায় সারাজীবনের টাক নিয়ে জন্মাবে।“
হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এসে শৈবাল ভাবলো একবার ফার্স্ট গেটের বিপিন ডাক্তারকে দেখালে কেমন হয়?
ফাস্ট গেটের বিপিন ডাক্তার বিড়ি ফুঁকছিলেন। জানতে চাইলেন, “তুমাদের জন্যি তো জঙ্গা আচে। আমার কাচে ক্যানে আও?”
– না ডাক্তারবাবু, আপনি যদি একবার দেখে নেন।
– তবে দ্যাখাও দেখি তুমার জঙ্গা কি ইংরাজি লিখে।
বিপিন ডাক্তার ডঃ জ্যাঙ্গোর রিপোর্ট দেখলেন। “এতো সামান্যি ব্যাপার। আর তুমার যে নালিতে মরচে ধরিছে, ইটায় গরম সেঁক দিবা। সাথে গরম ধুঁয়া লাগাইলেই ঠিক হইয়া যায়।”
– গরম সেঁক? গরম ধুঁয়া?
– হ্যাঁ, গরম সেঁক। হুসটেলে থাকো তো? ছাদে গিয়া তুমাদের হুস্টেলের রান্নার বড় লোহার কড়াইটা রোদে গরম করবা। খুব গরম করবা। ভীষণ রকমের গরম। তারপর ঐ রোদের মধ্যেই গরম কড়াইটা উলটাইয়া উটার উপর বসি থাকবা। সব কাপড় চোপড় খুইল্যা বসবা। উই লুহার গরম তুমার পিছনে যেন ভালোমতে সেঁকা লাগে। দিনে তিনবার রদ্দুরে বসি পিছনে গরম সেঁক অবশ্যই দিবা। সব মরিচা সারি যাইবো।
– কিন্তু পিছনে গরম ধুঁয়া লাগাবো কেমন করে?
– তুমাদের হস্টেলে লোহার জালির খাট আছে না? তার নীচে আগুন জ্বালাইয়া শুইয়া থাকবা। অন্তত দুই ঘন্টা। ব্যাস, ওই রকম গরম সেঁক আর ধুঁয়া লাগাও, নালি পরিষ্কার, ঠিক তিনদিন লাগে।
না, বিপিন ডাক্তারের কাছে গিয়ে সুবিধে হলো না। কাছেই একজন লেডি ডাক্তার আছেন, তাঁর কাছে গেলে কেমন হয়? তিনজনে একসাথেই গেলো। লেডি ডাক্তার অল্পবয়সী, শৈবালের সব কথাই শুনলেন।
– পেট ব্যাথা, পেটে অস্বস্তি? ঠিক আছে, সব ঠিক হয়ে যাবে। এই বেডে শুয়ে পড়।
লেডি ডাক্তার শার্ট তুলে পেট আর তলপেট টিপে টিপে পরীক্ষা করলেন। তারপর স্টেথো লাগিয়েও নানারকমের চেক করে বললেন, “তোমার প্যান্টটা লুজ করে একটু নীচে নামাও।“
– মানে? প্যান্ট কেন খুলবো?
– খুলতে বলিনি, শুধু একটু নীচে নামাতে বলেছি।
বাধ্য ছেলের মতন শৈবাল নিজের প্যান্ট সামান্য নীচে নামিয়ে দিলো। আর লেডি ডাক্তার সেটাকে আরও খানিকটা নীচে নামিয়ে দিয়ে স্টেথো আর মিটার লাগানো আরেকটা কি যেন যন্ত্র লাগিয়ে তলপেটের টেস্ট করলেন। শৈবাল কিছুই বুঝলো না। শুধুই হাঁ করে সব দেখলো।
– তোমার নিশ্চয়ই ঘন ঘন স্বপ্নদোষ হয়?
যেমন অস্বস্তিকর অবস্থায় সে শুয়ে আছে, ততটাই অস্বস্তিকর প্রশ্ন।
– কি? স্বপ্নদোষ হয় তো? ঠিক বলছি? আর সেটা প্রায়ই হয়। অন্তত তোমার সিম্পটম তাই বলছে। কি? ঠিক তো?
শৈবাল চুপ করে শুয়ে আছে।
– শোনো, আমাকে লুকিয়ে লাভ নেই, আমি একজন গাইনোকলজিস্ট, ……
শৈবাল আবার একটা ঝটকা খেলো, “আপনি গাইনোকলোজিস্ট?
– হ্যাঁ, গাইনোকলজিস্ট। তাতে কি? আমার প্রথম পরিচয় আমি একজন ডাক্তার। আর যে রোগ তোমার পেটের গোলমালের কারণ, সেটাও আমার ইন্সট্রুমেন্টে ধরা পড়েছে। তোমার পেটের গোলমাল খাওয়া বা লিভারের কারণে নয়। তোমার পেটে ব্যাথার কারণ তোমার অতিরিক্ত যৌন অনুভূতি। সেক্সসুয়াল টেম্পারামেন্ট।
– সেক্সসুয়াল টেম্পারামেন্ট?
– হ্যাঁ, ঠিক তাই। তোমার বয়সের ছেলেদের নর্মাল ফ্যাক্টর সেভেন পয়েন্ট নাইন, আর তোমার সেটা নাইন পয়েন্ট ফোর। তোমার এত ঘন ঘন স্বপ্নদোষের কারণও সেটাই। আর তার ফলে তোমার লিভারে অনেক প্রেসার পড়ছে।
লেডি ডাক্তার পেসক্রিপশন লিখে দিলেন।
– সবার আগে তোমার বডি কুল করাতে হবে। একটা ওষুধ দিলাম, সেক্সোকুল, দিনে তিনবার খাবে। আর একমাস রাতে শোয়ার আগে তোমার তলপেটে আর অর্গ্যানে আগে বরফ ঘষে তারপর চন্দন লাগাবে। তাহলেই তোমার সেক্সসুয়াল টেম্পারামেন্ট নর্মাল হয়ে যাবে। আর স্বপ্নদোষটাও আশাকরি বন্ধ হয়ে যাবে। ।
লেডি ডাক্তার ঠিকই ধরেছেন। আজকাল শৈবালের ভীষণ স্বপ্নদোষ হচ্ছে। লেডি ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন নিয়ে ফার্স্ট গেটের ওষুধের দোকানে দেখাতেই ওঁরা বললো, ‘এই সামান্য ব্যাপারে ডাক্তারের কাছে কেন গেলেন? আপনার হস্টেলের ধোপাকে বললেই বলে দিতো।
শৈবাল অবাক।
– হস্টেলের ধোপা ওষুধ প্রেসক্রাইব করবে?
– কেন নয়? ঐ ধোপাই তো আপনাদের কাপড় কেচে পরিস্কার করে।
শৈবাল পাগল হয়ে যাবে। হোস্টেলে ফিরে আসছে, রাস্তায় পাগলাবাবুর সাথে মুখোমুখি দেখা। “কি হয়েছে? এরকম মুখ বানিয়েছো? শরীর খারাপ নাকি?”
– হ্যাঁ স্যার। কয়েকদিন ধরেই খুব পেট খারাপ।
– না না, পেট খারাপ নয়। পেট খারাপ নয়। তোমার মাথাটাই খারাপ হয়েছে। তোমাদের মাথায় গোবরে ঠাসাঠাসি। মাথার ট্যাঙ্কে গোবর রাখবার আর জায়গাই নেই। অথচ রোজ তোমার মাথায় বালতি বালতি গোবর তৈরি হচ্ছে, থামার নাম নেই। অত গোবর তুমি রাখবে কোথায়? তাই মাথার গোবর এইভাবেই বেরিয়ে যাচ্ছে।
পাগলাবাবুর কথাটাও কানে লাগলো। উনিও বলছেন মাথায় গোবর, মানে মাথার গোলমাল। তাহলে মাথারও একটা চেক আপ করাতে হবে। অবজ্ঞা করা উচিৎ হবে না।
ডাক্তার জ্যাঙ্গোর কথামতন পরদিন শৈবাল এসেছে, ওর বডি স্ক্যানিং হবে। হাসপাতালে পৌছতেই ডঃ জ্যাঙ্গো ঘণ্টি বাজিয়ে কম্পাউন্ডারকে ডাকলেন “একে কেবিনে নিয়ে যাও, আর লাল্লুকেও খবর দাও”।
শৈবাল কেবিনে এলে কম্পাউন্ডারবাবু দরজা জানালা বন্ধ করে দিলেন। একজন নার্সও সঙ্গে আছেন। মিষ্টি হেসে অভয় দিলেন “মাই বয়। ডোন্ট বি নার্ভাস। সিম্পল শেভিং হবে। স্ক্যানিং এর আগে ফুল বডি শেভিং করতে হয়। সেটাই নিয়ম।”
– শেভিং হবে?
– হ্যাঁ, আগে মাথা ন্যাড়া তারপর ফুল বডি। এমনকি তোমার গোঁফটাও। তারপরই স্ক্যানিং হবে।
– আপনারা আমার মাথার চুল, গোঁফ, বডি সব শেভ করে দেবেন?
– সব, সব, সব। আমাদের বিহারী নাপিত লাল্লু, এক্সপার্ট, মল্লিকফটক থেকে ডেকে এনেছি। এক্কেবারে নিখুঁত হাতের কাজ। তোমার সারা শরীরে চুলের কোন চিহ্নই থাকবে না।”
শৈবাল একবার ভালো করে নার্সকে আর লাল্লুকে দেখে নিল। লাল্লুর বিহারী খোট্টা চেহারা। কালো গায়ের রঙ, ছ’ফুট লম্বা, অন্তত এক’শ কিলোর ওপর ওজন হবে। হাতে একটা বাক্স, শৈবাল দেখে লাল্লু তাঁর বাক্স খুলে বিভিন্ন সব যন্ত্রপাতি বার করেছে। প্রায় ছ’ইঞ্চি লম্বা ক্ষুর? বাপরে। তার সাথে ম্যাগ্নিফায়িং গ্লাস, একটা কিরকম ক্রিমের ডিব্বা, দাড়ি কামানোর ব্রাশ, হাতুড়ি, বাটালি, ছেনি, রান্না করার হাতা খুন্তি, কত রকমের জিনিষ।
লাল্লু প্রায় এক ঘণ্টা ধরে শৈবালের পুরো বডি শেভ করে দিলো। নার্স ঠিকই বলেছিলো, শৈবালের শরীরে এখন কোথাও একটাও চুল, দাড়ি, বা গোঁফেরও চিহ্নমাত্র নেই।
শেভিঙের শেষে শৈবাল আবার ডঃ জ্যাঙ্গোর সাথে দেখা করতেই ডঃ জ্যাঙ্গো হাসতে হাসতে বললেন “কি, এখন কেমন লাগছে?”
– জ্বালা করছে, কুটকুট করছে।
ডঃ জ্যাঙ্গো ঘণ্টি বাজিয়ে কম্পাউন্ডারকে ডাকলেন। “একটু হিট ট্রিটমেন্ট করে দাও। উকুনগুলোকে তাড়াতাড়ি মারতে হবে।”
– ডাক্তারবাবু। বগলে জ্বলছে, গরম ছ্যাঁকা দিয়েছে। বলছে ওটা নাকি হিট ট্রিটমেন্ট। আর আমার মাথায়ও চুলকাচ্ছে।
– এক নম্বর সবুজ ওষুধটা লাগিয়ে নাও।
– স্যার স্যার, ওটাতো আপনি লেডীজ হোস্টেলের ঝিকে দিয়েছেন, পায়ে হাজার জন্য।
– শোনো। তুমি ফার্স্ট ইয়ারে পড়, এত নিজের পছন্দের ওষুধ ডিম্যান্ড করবে না। এখন আমাদের স্টোরে বেশী ওষুধ নেই। যা পাচ্ছ, ওতেই খুশী থাকো। পায়ের হাজায় লাগানোর ওষুধটাই এখন ন্যাড়া মাথায় লাগিয়ে নাও।
সন্ধ্যাবেলা নিজের রুমে শৈবাল তার বন্ধুদের সাথে এই নিয়েই আলোচনা করছিল, সকলেই চিন্তিত। এমন সময় মেসের বড় ঠাকুর চূর্ণদা ঘরে এলো। চূর্ণদা কয়েকদিন ধরেই লক্ষ্য করেছে শৈবালের কোনো একটা সমস্যা আছে। সে এই মেসে বাইশ বছর আছে। নজর খুব তীক্ষ্ণ। হোস্টেলের ছেলেদের সমস্যা, বিশেষ করে যারা নতুন আসে, তাঁদের সমস্যা সে খুব ভালো বোঝে। “কি তকলীফ বাবু, কয়েকদিন দেখছি তবিয়ৎ আপনার ঠিক নাই। আজকে মাথাটাও মুণ্ডন করেছেন। গোঁফ নাই, দাড়ি নাই, হাতের লোমগুলিও দেখি না। কি ব্যেপার বাবু?”
ছেলেরা কোনো জবাব দেয়না। চূর্ণদা বোঝে কিছু একটা হয়েছে যা ছেলেরা বলতে চাইছে না। শৈবাল যে গেঞ্জি আর পায়জামায় ঘন ঘন চুলকাচ্ছে এটাও চূর্ণদার নজরে পড়েছে। “আগে বলুন কিসের তকলীফ?” বন্ধুরা শেষে বুঝিয়ে বলল যে অনেকদিন ধরেই পেটের গণ্ডগোল চলছে, হাসপাতাল গিয়েছিলো, মনে হয় বড় কিছু রোগ হয়েছে।
– আরে বাবু ছোরো তুমার হাস্পিতাল আর পেটের গরবর, আমি এখানে বাইশ সাল আছি, একবার আমার দাওয়াই লিয়ে দেখ, একবার, স্রিফ একবার, তারপর কালকে আমায় বলবে।
চূর্ণদা পাড়ার জ্যাঠামশাইএর দোকান থেকে স্বর মাখানো মোষের ঘন দুধ আনালো। মেসের স্টোর থেকে নিলো আদা আর শুকনো লাল লঙ্কা। “আরে ও মুইয়া। একঠো তেরা ছাপড়া জিলা কা দাওয়াই বানাকে দিও।”
“আর বাবু, এখন একবার। রাত্রে খাবার পর একবার খেয়ে দেখুন। কালকে সকালে বলবেন কি হালচাল।”
পরদিন সকালেই শৈবালের সাড়ে তিন ইঞ্চি সিংগল পিসের সাথে বেশ কয়েকটা তিন চার ইঞ্চি কৃমিও বেরিয়ে গেলো।
আঃ। কি আরাম !! পেটে কোন ব্যাথা নেই।
আর হাসপাতাল যাবার দরকারই নেই।
Add comment