Asim Deb Writings

অবাক তেলজ্ঞান

অবাক তেলজ্ঞান
অসীম দেব

“আচ্ছা, মশাই, একটু তেল পাই কোথায় বলতে পারেন?”
হারাধনবাবু নিক্কো পার্কে বেড়াতে এসেছেন। নিজের গাড়ি নিয়েই এসেছেন, এসেই মনে হয়েছে যে গাড়িতে তেলটা ভরার দরকার ছিলো, আগেই ভরে নিলে ভালো হতো। নইলে বাড়ি ফেরার সময় অসুবিধে হতে পারে। সম্ভব হলে খোঁজ নিয়ে রাখবেন যে কোথায় পেট্রল পাওয়া যায়? আর ফেরার পথে তেলটা ভরে নেবেন। তাই এই প্রশ্ন।
– আসলে জানেন তো, আমি না, একটু মুস্কিলে পড়েছি, এখানে একটু তেল পাই কোথায় বলতে পারেন?

সেখানে উপস্থিত কেউই জানেন না তেল এখানে ধারেকাছে কোথায় পাওয়া যায়। এরই মধ্যে একজন বললেন
– তেল? আপনি তেল খুঁজছেন? ঐ যে ওখানে, চশমা পরা ভদ্রলোক, মাথায় টাক, নাম তরুণবাবু, উনি তেলের ব্যাপারে অনেক জানেন। ওখানে যান, উনি হয়তো বলে দেবেন।

হারাধন ধীরে পায়ে এগিয়ে গিয়ে আন্দাজমতন লোকটিকে আইডেনটিফাই করে বললেন “আপনি, তরুণবাবু?”
তরুণবাবু সেইসময় ভেন্ডর ও কন্ট্রাকটর নিয়ে বন্ধুমহলে নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন।
– হ্যাঁ, বলুন।
– বলছিলাম, এখানে একটু তেল পাওয়া যাবে?
আশেপাশের উপস্থিত সকলেই ছিলেন আড্ডার মেজাজে। তাঁরা খানিক বিরক্তই হলেন। তবে অন্যরা অখুশী হলেও তরুণবাবু খুব খুশি হয়েছেন। তিনি তেল বিশেষজ্ঞ। তেল সম্বন্ধীয় কেউ কিছু প্রশ্ন করলেই উনি তাঁকে সাদরে আপ্যায়ন করেন। এখানেও তার ব্যাতিক্রম হলো না।
– তেল? আপনি তেলের খোঁজ করছেন? বাঃ, বেশ বেশ! কি নাম আপনার?
– আজ্ঞে, আমার নাম হারাধন। হারাধন বসাক।
তরুণ হারাধনকে একবার আপাদমস্তক দেখে নিলেন। তবে এনাকে যাচাই না করে তেলের ব্যাপারে তরুণ কোন আলোচনাতেই আসবেন না। “আপনি কি করেন?”
– আমি কোল ইন্ডিয়ায় ইঞ্জিনিয়ারিং কাজ করতাম।
এবার তরুণ নিশ্চিন্ত হলেন, কথা বলা যেতে পারে।

তরুণের মনে একটা ক্ষোভ আছে। উনি তেলের এক্সপার্ট, মানে বিশেষজ্ঞ, অথচ তেলের ব্যাপারে সাধারণ লোকের কোন চেতনাই নেই। বহুকাল পরে একজনকে পেয়েছেন, যিনি তেলের খোঁজ করছেন। এনার সাথে খোলা মনেই আলোচনা করা যাবে।
– জানেন, আমি ছিলেম তেলের জিএম, মানে তেলের গ্র্যান্ড মাস্টার। তেল আমার প্রিয় বিষয়। এই ব্যাপারে অনেক পড়াশোনাও করেছি।

হারাধনও নিশ্চিন্ত হলেন। সঠিক জায়গাতেই এসেছেন।
– এখানে তেল পাই কোথায় বলতে পারেন?
প্রশ্নটা শুনে তরুণ চিন্তিত হলেন। নামটা নতুন লাগলো।
– তেলপাই? তেলপাইটা কিরকম তেল? এই নাম আমি তো আগে কোনদিন শুনি নি।
– না, না, তেলপাই নয়। তেলপাই নয়। তেল। তেল কোথায় পাই সেটা জানতে চাইছিলাম।
– ওঃ, তেল। তেল খুঁজতে এসেছেন? সে তো ওএনজিসির কাজ, অয়েল এক্সপ্লোর করা। যেমন বম্বে হাইতে ওরা করছে, আসামের শিবসাগরে করছে। তা আপনি এই নিক্কো পার্কে অয়েল এক্সপ্লোর করবেন?
– না, না, সেসব নয়। আমার মারুতি গাড়ির জন্য তেল চাই।
– তাই বলুন। গাড়ির জন্য? কিরকম তেল? ইঞ্জিন অয়েল? না ল্যুব্রিকেন্ট? না পেট্রল, ডিজেল?
– সাধারণ তেল, মানে পেট্রল।
– কিরকম পেট্রল? ফিল্টার? না সেমি ফিল্টার? না র’?
– আমার মারুতি গাড়ি, তার জন্য কিছু একটা পেলেই হলো।
– আরে, তেলের ব্যাপার! কিছু একটা পেলেই হলো? আপনাকে তো ভেবেচিন্তে তেল কিনতে হবে। আপনার ইন্ডিয়ান অয়েল চাই, না ভারত পেট্রলিয়াম চাই, না রিলায়েন্স চাই? সেটা বলবেন না?
– আপনিই বলে দিন, কোনটা ভালো?
– আমার মতে হলে আপনি ইন্ডিয়ান অয়েলটাই নিন। তবে কোনটা নেবেন? ৯৩ অক্টেন? হাই স্পীড?

হারাধন এবার একটু চিন্তায় পড়ে গেলেন।
– চিন্তা করছেন কেন? আমি তো আছি। আগে বলুন তো আপনি কোন ফিল্টার অয়েল ব্যাবহার করেন?
হারাধন জানেনই না, সার্ভিসিং এর সময় কোন ফিল্টার অয়েল ওরা ঢেলে দেয়। মুখ কাঁচুমাচু করে জবাব দিলেন, “জানি না, কিছু একটা হবে।“
– আরে জানি না মানে? যা খুশি দিলেই হলো? আপনার স্ত্রী রান্না করেন?
– হ্যাঁ, করেন। কিন্তু রান্নার সাথে গাড়ির তেল? মানে কি সম্পর্ক?
– আছে। অবশ্যই আছে। আপনার স্ত্রী পুঁই শাকে, আর বেগুনপোড়া কি একই তেল দিয়ে রাঁধেন?
– না, সে তো জানি না।
– তাহলেই বুঝুন তেল কাকে বলে? ধরুন রান্নার তেল, মানে সরষের তেল, নুনু’দার বাড়ি গেলে মাছ ভাজা হবে গনেশ মার্কা তেলে, কিন্তু বম্বেতে ল্যুজের বাড়িতে সেটাই হবে কানোরিয়ার তেল। আবার বিলেত গেলে সেটা হবে সয়াবিন অয়েল, বা রাইসব্যান। কি? ঠিক কি না?
– হ্যাঁ, ঠিক ঠিক।
– আবার দেখুন, মাছ রান্নার জন্য রিফাইন্ড তেলও হতে পারে। সানফ্লাওয়ার হতে পারে। বাদাম তেল হতে পারে। সাউথে যান, সেখানে নারকেল তেলের রান্না হয়। গুজরাটে যান, মাদার ডেয়ারির ধারা তেল। সুতরাং? কি বুঝলেন?
হারাধন কিছু না বুঝেও বললেন
– বুঝলাম, শুধু মাছ রান্নার জন্যই অনেক রকমের তেল আছে।
– না, আপনি কিসস্যু বোঝেন নি। তেলের ব্যাপারে অত সহজেই বুঝে গেলেন? মাছের তেলে যে মাছ রান্না হয় সেটা জানেন?

একটু জিরিয়ে নিয়ে শুরু করলেন, “আমার এক বন্ধু দুবাই থাকে, ওর ওখানে আবার পাম তেলে মাছ রান্না করে। সুতরাং বুঝলেন? শুধু মাছের জন্যই কত রকমের তেল?

হারাধন ভুলেই গিয়েছিলেন কি জন্য এখানে এসেছিলেন। তরুণের ভাষণে সংবিত ফিরে পেলেন
– আপনি কি জানেন আপনার বাড়িতেই কত রকমের তেল আসে?
হারাধন মন্ত্রমুগ্ধের মতন শুনছেন।
– তাহলে শুনুন। রান্নার তেল, মাথার চুলে মাখার তেল, গায়ে মাখার তেল, বাতের ব্যাথার জন্য তেল, উকুন মারার তেল, উনুনের জন্য কেরোসিন তেল, মশা মারার তেল, এমনকি সন্ধ্যাবেলায় ঘরে প্রদীপ জ্বালাতেও তেল। এইরকম কত তেল যে আপনার বাড়ি আসে আপনি সেটা জানেন?

হারাধনের মনে পড়লো, তাঁর একবার পায়খানা এঁটে গিয়েছিলো। বললেন
– হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমার একবার হাগায় সমস্যা হয়েছিলো। তখন ডাক্তার আমার পাছায় কি যেন একটা তেল মাখতে দিয়েছিলো। ব্যাস, দু’দিনেই আমার পাইপ পরিস্কার হয়ে সব ক্লিয়ার হয়ে গেলো।
– তাহলে? সবই তো বোঝেন! বলি শুনুন। তেলের আরও কতরকমের ব্যাবহার। আমাদের হস্টেলে শীতকালে স্নানের আগে একজন আরেকজনকে সরষের তেল মাখিয়ে দিতো। সে তেল মাখার যে কি আরাম, কি বলবো মশাই! আর সেইজন্য আমাদের স্বাস্থ্যও ভালো থাকতো।
হারাধনের মনে পড়লো,
– হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমার যখন ছেলে হয়, এতটুকুন, তখন আমি ওর গায়ে মাখার জন্য জনসন কোম্পানির তেল আনতাম।
– তাহলে, বুঝেই দেখুন। হস্টেলে আমাদের গায়ে মাখার জন্য সরষের তেল। আর শিশুদের জন্য জনসন তেল।

তরুণ একটু থেমে আবার যোগ করে দিলেন,”একবার মুর্শিদাবাদে আমার পিসির বাড়ি গিয়ে রাতে মাছের তেলের বড়া খেয়ে সে যে কি পেট ব্যাথা, কি বলবো হারাধনবাবু! সেই পিসি, তখন পেটে বাবুই পাখীর তেল মালিস করে দিলো, আর ব্যাস, আমার পেট ব্যাথাও উধাও। মানে তেলের বড়া খেয়ে তেল মালিস।“
হারাধন ভাবলেন তিনিও বা কম যাবেন কেন? বললেন, “একদিন কি হয়েছে, বাড়ির পুরনো তালা জ্যাম হয়ে গেছে, চাবি দিয়ে আর খুলছে না। দিলাম কয়েক ফোঁটা তেল, ব্যাস, তালা খুলে গেলো।“
– হ্যাঁ, এইখানেই তাহলে বুঝে দেখুন হারাধনবাবু, তেলের কত কি উপকারিতা।
হারাধনের মনে পড়ে গেলো, “ছোটবেলায় আমাদের বাড়িতে সেলাই মেশিন ছিলো। তখন দেখেছি, সেই উষা বা সিঙ্গার মেশিনের জন্য প্লাস্টিকের তেলের বোতল ছিলো।“

এবার হারাধন বুঝতে পারছেন, তেল কতরকমের হয়, আর কতটাই যে প্রয়োজনীয়।
– আমি তো সেটাই বলি হারাধনবাবু, তেল একটা হেলাফেলার জিনিষ নয়। তবে কনফিউজড হবেন না। আপনার গাড়ির জন্য এখানে ইন্ডিয়ান অয়েল। আর এই আপনিই যদি বিলেত যান, সেই তেল হবে মোবিল। আবার আমেরিকায় এই তেলকেই বলবে গ্যাস।
– তেলকে গ্যাস বলে?
– অজ্ঞতা, মশাই অজ্ঞতা। নইলে দেখুন, এই আমার টাক। আমি একজন তেলের জিএম। অথচ আমার অজ্ঞতায় না জেনে ভুল করে মাথায় জবাকুসুম না দিয়ে লক্ষীবিলাস তেল দিলাম,আর টাক পড়ে গেলো?
– সে কি মশাই? ভুল তেলে মাথায় টাক পড়ে যায়? আমি তো ডাবর তেল মাথায় দি।
– এই বয়সে ডাবর ঠিক আছে, তবে আরও বয়স হলে ক্যান্থারাইডিন মাখবেন, অন্য কিছু নয়।

এবার তরুণ একটু থামলেন। অনেকদিন পরে তেলের ব্যাপারে উৎসাহী একজন শ্রোতা পেয়েছেন, এনাকে খাতির না করলেই নয়। “আপনি একটু ড্রিংকস নেবেন?”
হারাধনের মনেও পুলক জেগে উঠলো। কতদিন মদ ছুঁয়েই দেখেন নি। একটু লোভও হলো কিন্তু চারিদিকে অচেনা লোকের মাঝে ইতস্তত করছেন। আবার তরুণও এরকম শ্রোতাকে ছাড়বেন না।
– আরে মশাই লজ্জা করবেন না। এখানের বিগ বস আমার কলেজের বন্ধু, আজকের এই চিংড়ি উৎসবের হোস্ট। চলুন, এই দু’চুমুক তো দেবেন, আমি তো আছি।

দুজনেই খানিকটা করে হুইস্কি সোডা নিয়ে নিভৃতে বাইরে ওয়াটারস্পোর্টসের পাশে গিয়ে বসলেন।
– হারাধনবাবু, আপনি মুলোর তরকারি সরষের তেলে রান্না করা, খেয়েছেন?
– বলতে পারছি না। প্রচুর মুলো খেয়েছি, কিন্তু কোন তেলের রান্না ছিলো সেটা জানি না।
– এই যে। এখানেই আমরা ব্যর্থ। মুলোটাই খেলাম, আর তেলের ব্যাপারে জানলামই না?
– না, না, সেরকম নয়। কিছুটা জানি। যেমন আমার বড় জেঠিমা, কেরালার মেয়ে, জলন্ধরে থাকেন। উনি তো সব রান্নাই নারকেল তেলে করেন। আবার দুর্গাপুরের মাসী ফরচুন কাচ্চে ঘানি মার্কা ছাড়া অন্য কিছুই ছোঁবেন না। সেটাও জানি।
– তবে? এখানেই দেখুন শুধু মুলোর তরকারিতেই কতরকমের তেলের ভ্যারাইটি। আরও আছে, পতঞ্জলি তেল, ইমামি তেল। এখন তো ডাবর কোম্পানিও তেল বানায়।
– আচ্ছা তরুণবাবু, আমি শুনেছি তার্পিন তেল না হলে মেয়েদের নাকি কসমেটিক ক্রিম হবে না?
– একদম ঠিক শুনেছেন। শুধু তাই নয়, অয়েল পেন্টিং? তেল না থাকলে তো অনেক আর্টিস্ট অয়েল পেন্টিংও করতেই পারবেন না।
আরও যোগ করে দিলেন, “শুনুন হারাধনবাবু, বিয়ের আগে আমাদের বাড়ির মেয়েরা বরকনের গায়ে যে তেল হলুদ মাখিয়ে দেয়, সেটা কেন জানেন? সেখানেও তেলের ব্যাপার, সকলকে বুঝতে হবে।“

এবার এগিয়ে এসে কানে কানে বললেন, “আপনি কি জানেন, এখন সেক্সের সময়েও ছেলেমেয়েরা স্পেশাল তেল ব্যাবহার করে?”
এটা হারাধন জানতেন।
– হ্যাঁ মশাই, তেল। জাপানি তেল। আমি শুনেছি।
– এই, এই বিলিতি ব্যাপারেই আমার আপত্তি। কেন? জাপানি কেন? ভারতীয় বৈদ্যনাথের ভিটাএক্স নেই? আমাদের জলন্ধরের কোম্পানির হার্বাল প্রোডাক্ট নেই? এইসব ভারতীয় প্রোডাক্ট ছেড়ে কেন আমরা জাপানি তেল নেবো?
হারাধন অবশ্য এত কিছু জানেন না, শুধু জাপানি তেলটাই শুনেছেন।
– জানেন, এই ব্যাপারেও আমাকে অনেক পড়াশোনা করতে হয়েছে। এমনি এমনি কি আর আমি জিএম হয়েছি?
হারাধন ভাবেন কি যুগ যে এলো? সেক্সের সময়েও তেল লাগাতে হয়?

হঠাৎই তরুণের মনে হলো, ইনি তো মারুতির তেলের ব্যাপারে খোঁজ নিতে এসেছিলেন।
– একটা কথা বলুন, আপনি বলছেন জানেন না আপনার গাড়িতে কোন কোম্পানির ইঞ্জিন অয়েল ঢেলে দেয়?
– সত্য বলছি তরুণবাবু, জানি না।
– আর অয়েল ফিল্টার? ল্যুব্রিক্যান্ট? কিছুই জানেন না?
– না তরুণবাবু।
এবার তরুণ বেশ বিরক্ত হয়েই বললেন
– আর না। অনেক হয়েছে। আর এভাবে চলবে না। এখন থেকে তেলের ব্যাপারে আপনাকে জানতেই হবে। আপাতত আপনি ইন্ডিয়ান অয়েল তেলই নেবেন। আর আপনার ফোরস্ট্রোক ইঞ্জিন তো, ভালো তেল চাই। ক্যাস্ট্রল ইঞ্জিন অয়েল নিতে পারেন, তবে শেল অয়েলটাও ভালো। ভিআইপি তেলটাও ভালো, ওটা হাইস্পীডের জন্য। ভালো ল্যুব্রিকেন্ট মানে মতুল, বা হেলিক্স। আর সেরকম দরকার পড়লে আমি আছি। যখনই দরকার হবে, যে কোন রকমেরই তেল হোক, আমায় বলবেন।

খানিক থেমে আবার শুরু করলেন, “এই যে আমার বন্ধু, দুবাই থাকে, ওর দুবাইএর চারপাশের দেশগুলো পুরো তেলের উপর ভাসছে। এই তেল আছে বলেই তো আরবদেশে কত লোক চাকরী করছে। আবার এই তেলের জন্যই দেখুন কত যুদ্ধ হয়ে গেলো। আবার রাশিয়া, আলাস্কা নিজেদের দেশটাকেই যেন তেলের ট্যাংকার বানিয়ে রেখেছে। ওঁদের এত তেল, এত তেল, কিন্তু কিনবে অন্যদের থেকে।

খানিক থেমে আবার বললেন,
– ধরুন, আপনি বসকে খুশি রাখতে গেলে লোকে বলবে তেল মারছেন, বা তেল দিচ্ছেন। বলবে তো?
– হ্যাঁ, হ্যাঁ, অফিসে তো সবসময়ই দেখি লোকজন উপরওয়ালাকে তেল দিচ্ছে।
– তাহলে দেখুন, অফিসে বসকে তেল না দিয়েও তেল দিচ্ছেন। আবার ধরুন, আপনি বাড়িতেই আছেন গভীর ঘুমে, লোকে বলবে নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছেন। সুতরাং, ব্যাপারটা কি হলো? আপনি নাকে তেল দিলেন না, অথচ লোকে বলবে নাকে তেল দিয়েছেন।
হারাধন যতই শুনছেন, ততই মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছেন।
– এটা কি জানেন, যে সর্দি হলে নাকে সরষের তেল দিয়ে টানতে হয়?
হারাধন অবাক হয়ে শুনছেন। আর তরুণ বলে চলেছেন, “এই পশ্চিম বাংলায়, যদি তেল না থাকে, তাহলে কত তেলেভাজার দোকান যে বন্ধ হয়ে যাবে, একবার ভাবুন তো। এত বড় তেলেভাজা শিল্প, কত লোকে এই ব্যাবসা করেই তিনতলা বাড়ি বানিয়ে নিলো। কেন? শুধু এই তেলেভাজার জন্য।“

তরুণ হটাৎই ইমোশনাল হয়ে গেলেন। “জানেন, একবার কুমারটুলি থেকে পাড়ায় দুর্গাঠাকুর এসেছিলো। মায়ের মুখটা কেমন যেন লাগছে। বাড়ি থেকে একটু তেল এনে মায়ের মুখে আলতো করে মাখিয়ে দিলাম। বলবো কি হারাধনবাবু, মায়ের মুখটা এক্কেবারে জ্বলজ্বল করে উঠলো”
– আসলে আমাদের জন্ম থেকেই তেল নিয়ে কারবার। এই যে আপনি বললেন, ছেলের জন্মের সময় দিলেন জনসন তেল। বাড়িতে রান্নার তেল, মাথায় মাখছেন তেল, আপনার পায়খানা আটকে গেলো সেখানেও তেল, বাতের ব্যাথায় তেল, স্টোভের রান্নায় তেল, গাড়িতে তেল, বাসে এরোপ্লেনে লাগে তেল। বিয়ের সময় বাড়ির মেয়েরা আপনার গায়ে তেল মাখিয়ে দিচ্ছেন, তারপর অয়েল পেন্টিং করতে গেলে তেল চাই, বসকে খুশি করলে তেল দিচ্ছেন। নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছেন। তেলের জন্য দেশে দেশে যুদ্ধ হচ্ছে। আর এমনকি এখন সেক্সের সময়েও তেল। তেল না থাকলে আপনার রান্নার সিলিন্ডার গ্যস হবে না। সারাজীবন শুধু তেল আর তেল আর তেল। খোঁজ নিয়ে দেখুন, আপনার কোল ইন্ডিয়ার মেশিনেও কত তেল লাগে। অথচ আমরা তেলকে গুরুত্বই দি না?”

কোল ইন্ডিয়া বলায় হারাধন উৎসাহ পেলেন। “হ্যাঁ, আমাদের তো কত রকমের মেশিন, প্রত্যেকটাতে কতরকম আলাদা আলাদা তেল লাগে।“
– লাগবেই তো। লাগবেই। আপনারা কোল ইন্ডিয়ায় কি তেল ব্যাবহার করেন?
– সেটা জানি না, আমাদের স্টোর থেকে যে তেল দেয়, সেটাই আমরা মেশিনে ঢেলে দি।
– বাঃ, ভালো বললেন তো। তেল ঢালছেন, অথচ কি ঢালছেন সেটাই জানেন না। আমি শুনেছি হাইড্রলিক ইনকম্প্রেসিবল তেল, যেমন সার্ভো সিক্সটি এইট। এর ভিস্কোসিটি খুব ভালো।

সত্যি তো, হারাধন এসব জানতেনই না। তরুণ খুব হতাশ হলেন।
– না, শুধু আপনি নয়। ঐ যে সবাই আমার বন্ধুরা ওখানে সব দলবেঁধে মদ গিলছে, তারাও তেলের ব্যাপারে উদাসীন। এটাই আমাদের জাতির দুর্ভাগ্য।
হারাধনের একটা কৌতুহল হলো, “সত্যি, আপনার মতন লোকের কদর না হওয়া একটা জাতির দুর্ভাগ্য। আপনি তাহলে তেলের উপর একটা বই লিখুন না, লোকে তাহলে জানবে।“
– আরে, মজা করছেন? কার ইন্টারেস্ট আছে তেলের ব্যাপারে, যে পয়সা দিয়ে বই কিনে পড়বে?
হারাধনের খুব খারাপ লাগলো। এই তরুণবাবু সত্যি এত গুণী পন্ডিত লোক, তেলের ব্যাপারে কত জ্ঞান, অথচ ওনার বন্ধুদেরই এব্যাপারে কোনই ইন্টারেস্ট নেই।

এর খানিক পরে তরুণ হারাধনকে গেস্ট করে চিংড়ি উৎসবেই লাঞ্চ খাইয়ে দিয়েছেন। বিকেল হতে চললো, সকলেই বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। হারাধনও অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলেন। উনি আজ একজন বিরাট গুণী লোকের সান্নিধ্যে এসেছেন। তেলের ব্যাপারে কি জ্ঞান!!

পার্কিং এ এসে গাড়িতে চড়ে মনে পড়লো, আরে তেল নিয়ে এত জ্ঞান অর্জন করলেন, অথচ তেল কোথায় ভরবেন সেটাই তো জানা হলো না? এখন কি উপায়? কিভাবে ওনাকে খুঁজে পাবেন।

মোবাইলেও তো ওনাকে পাওয়া যাবে না, কারণ কে এক খোকার বাপ নাকি ওনার মোবাইলটাই ঝেড়ে দিয়েছে।

Asim Deb

Add comment