সংযোনির পোঁদে ফোস্কা
কলেজ তিনদিন পরপর ছুটি। দু’দিন পরেই শুক্রবারে ছুটি, কিন্তু কেন ছুটি সেই কারণটা সংযোনি জানে না। শুধু জানে ছুটি আছে। আর শনিবারটা কাটিয়ে দিলে রবিবার এমনিতেই ছুটি। সংযোনির ইচ্ছে, হোস্টেলের কয়েকজন মিলে তিনদিন কোথাও ঘুরে আসে। নিজে কিছু করতে পারে না, তবে অন্য কেউ প্ল্যান আয়োজন করে দিলে সে যাবে। তাই সব্বাইকে ডেকে ডেকে ধরছে, চল কোথাও একটা ঘুরে আসি। কেষ্ট এক কথায় রাজি। তাঁর সাথে ল্যুঁজ, চিংড়ি, আর নুনু’দা। সব মিলিয়ে পাঁচ’জন।
কোথায় যাওয়া যায়? সংযোনিকে নিয়ে সমুদ্র বা নদী বা পাহাড়ে যাওয়া যাবে না। পাহাড়ে গেলে পা পিছলে পড়ে যাবে, আর নদী সমুদ্রের কাছে গেলে জলে ভেসে যাবে। কেষ্টর অনেকদিনের ইচ্ছে শান্তিনিকেতন যায়। সংযোনির সেখানে পা হড়কানোর চান্স যে নেই সেই গ্যারান্টি দেওয়া যায় না, কারণ সংযোনির সাথে সবকিছুই হতে পারে, তবে নিরাপত্তার দিকটা ভেবে দেখলে সেটা অবশ্যই ওঁর জন্য একটা সেফ জায়গা। শান্তিনিকেতন শুনেই সে লাফিয়ে উঠেছে। শুনেছে ওখানের মেয়েরা নাকি রাস্তায় নেচে নেচে গান গাইতে গাইতে ক্লাসে যায়। খুবই উত্তেজিত, “শান্তিনিকেতন? শুনেছি শাড়ী পরে বেণী দুলিয়ে সব রবীন্দ্রসংগীত গাইতে গাইতে স্কুলে যায়?”
– হ্যাঁ, সেই শান্তিনিকেতন। তবে তুমি ওখানে গিয়ে রবীন্দ্রসংগীত গাইবার চেষ্টা করবে না।
– হ্যাঁ, আর আমাকেও সবার মাঝে ল্যুঁজ ল্যুঁজ বলে ডাকবে না।
– আমাকেও যেন কেউ চিংড়ি চিংড়ি বলে না ডাকে, খুব খারাপ কেস হয়ে যাবে, আগেই বলে দিলাম।
প্রত্যেকেরই নিজস্ব কিছু শর্ত আছে। শুধু কেষ্টর কেসটা অন্যরকম, “গুরু, তোমরা শুধু আমাকে নিজের মতন করে স্বাধীনভাবে চড়তে দিও, আর ঘাস খেতে দিও।“ আর নুনু’দা সদাহাস্যময়, প্রবীণ বিচক্ষণ ব্যাক্তির মতন। কোনো দাবী নেই, শর্ত নেই।
শান্তিনিকেতন বলে কথা। না সাজলে হয়? হোস্টেলের অন্যদের ভালো ভালো শার্ট, প্যান্ট, এমনকি গেঞ্জি, জাঙ্গিয়া জুতো গামছাও রাতারাতি গায়েব হয়ে গেলো। চাটু অন্য হস্টেলে থাকে। ল্যুঁজ আর হিমাই অনেক ভজিয়ে চাটুর রঙচঙ্গে টি-শার্ট গুলো চেয়ে নিয়ে এসেছে। সেও আরেক ঝামেলা। ওরা জানতো জামাগুলো চাটুর। কিন্তু চাটুও যে জামাগুলো বারো নম্বর হোস্টেলের নারদের থেকে ঝেড়ে এনে ফেরত দিচ্ছে না, সেটা তারা জানতো না। তার ওপর প্রায় দু’মাস জামাগুলো ধোয়াকাচা হয় না। ঘামের দুর্গন্ধ। একজন দুজন নয়। ঐ জামায় আট দশজনের ঘামের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। তখনই ধোপাকে দিয়ে জামাগুলো কাচিয়ে আনাতেই সংযোনি তার থেকে নিজের জন্য একটা ঝেড়ে দিলো। ল্যুঁজের পকেট খালি। বিরিঞ্চির থেকে পয়সা ধার করে ফার্স্ট গেটে স্টুডেন্টস সেলুনে গিয়ে চুলদাড়ি কেটে এলো। বিরিঞ্চি বলেছে, দু’পার্সেন্ট সুদ নেবে। সবচেয়ে বেশী সমস্যায় চিংড়ি। ও স্নান খুব একটা করে না, তাই ওর গামছারও দরকার নেই। শুধু একটা জাঙ্গিয়া চাই, একটা হলেই বছরখানেক আরামসে কাটিয়ে দেবে। চিংড়ির যা বডি তাতে একমাত্র ডাবল এক্সট্রা সাইজের গেঞ্জি জাঙ্গিয়াই ফিট হয়। ওই সাইজের অন্তর্বাস কলেজে কয়েকজনের আছে, তবে এই হোস্টেলে কারোর নেই। সপ্তাহে একদিন হাওড়া হাটে ঐ মাল পাওয়া যায়। সংযোনিই সমাধান করে দিলো, “ভেতরে ডাবল পায়জামা পরে ওপরে প্যান্ট পরে নিবি।”
সকলকে দ্বায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। মদ নেবে ল্যুঁজ আর কেষ্ট, মুখরোচক চানাচুড় নেবে সংযোনি, চিংড়িকে কোন দ্বায়িত্ব দেওয়া হয় নি, কারণ চিংড়িকে যাই বলা হবে, রবীঠাকুরের পুরাতন ভৃত্যের মতন সব ঝুলিয়ে দেবে। সংযোনি বলে, “ওখানে কখন পৌঁছাবো, কি খাবো ঠিক নেই। বিকেলে আমরা যেন হোস্টেলের ব্যারাকে পেট ভরে খেয়ে নিই। সঙ্গে নেবো পাউরুটি, ডিম, বিস্কুট।“
– তাহলে, এগুলো তুই নিজেই কিনে নিয়ে আয়।
– না, মানে কি পাউরুটি? কোন কোম্পানির? কতটা নিতে হবে? কতগুলো ডিম? কতটা বিস্কুট? এগুলো তো আগে জানতে হবে।
নুনু’দা ঠান্ডা মাথার লোক, বলে, “তোকে কিস্যু আনতে হবে না। তুই শুধু মুখরোচক চানাচুড় নিয়ে আয়। আর কিছুই আনতে হবে না।“
– মুখরোচক চানাচুড়? কোথায় পাবো?
ল্যুঁজ জবাব দিলো, “জুতোর দোকানে।“
– জুতোর দোকানে মুখরোচক চানাচুড়?
নুনু’দাই বলে দিলো, “সেকেন্ড গেটের বাব্লু’র দোকানে পেয়ে যাবি।“
সন্ধ্যার সময় সংযোনি ফিরে এলো, “গুরু, মুখরোচক চানাচুড় কোথাও নেই। সেকেন্ড গেট ফার্স্ট গেট কোথাও নেই।“
শুনেই ল্যুঁজ আর কেষ্টর মাথা গরম। “শালা, গান্ডু, পাড়ায় পাড়ায় দোকানে দোকানে পাওয়া যায়। আমরা ফার্স্ট গেট সেকেন্ড গেটের দোকানে নিয়ম করে কিনে আনি, আর তুই বলছিস এখানে পাওয়া যায় না?”
– হ্যাঁ রে, মাইরি বলছি, কোথাও পেলাম না।
বৃহস্পতিবার বিকেলে চার’জন যখন সেকেন্ড গেটের বাসে উঠবে, কেষ্ট তার আগে বাবলু’র দোকানে জিজ্ঞেস করলো, “মুখরোচক চানাচুড় আছে?”
– আছে, কটা নেবেন?
– এই, তিন চারটে দিয়ে দিন।
দাম দেওয়ার সময় কেষ্ট প্রশ্ন করলো, “বাবলু’দা, গতকাল বিকেলে তোমার দোকানে এই মুখরোচক চানাচুড় ছিলো না?”
– হ্যাঁ, ছিলো। কেন? হঠাত এই প্রশ্ন করছেন?
– না, এমনি। তেমন কিছু নয়।
হাওড়া স্টেশনে ওঁরা ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছে। সংযোনির চুপচাপ বসে থাকার অভ্যাস নেই। ভূমিকায় শুরু হলো, “এই হাওড়ায় প্রথম যখন ট্রেন চালু হয়……. “
ল্যুঁজ থামিয়ে দিলো, “কোন সালের বা কোন সময়ের কথা হচ্ছে?”
– না, মানে যখন প্রথম চালু হয়েছিলো, সে যে সালেরই হোক, ইঞ্জিনের কয়লা আসতো রাণীগঞ্জ থেকে।
– কেন? রাণীগঞ্জ থেকে কেন?
সংযোনির মনে হলো যে ল্যুঁজের ফালতু প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার দরকার নেই। সে চালিয়ে গেলো, “তখন ওয়াগনগুলো ছিলো খুব ছোট ছোট, লোডিং করার সময় ক্রেন দিয়ে … “
আলোচনা আর এগুনোর আগেই ট্রেন প্ল্যাটফর্মে ঢুকছে। তাড়াতাড়ি জায়গা নিতে হবে। ওয়াগনের কয়লা লোডিং এর ইতিহাস নিয়ে সংযোনির অনেক কিছু বলার ইচ্ছে ছিল, সুযোগ হলো না।
যখন সবাই ট্রেনে উঠে সীট দখল করে বসেছে, কারোর গায়ে বা ব্যাগে নিজেদের জামাকাপড় নেই। সব এদিক ওদিক থেকে চেয়ে বা ঝেড়ে নিয়ে এসেছে। এমনকি জুতো, সানগ্লাস, টুপীও। চিংড়ি ঠিক সুবিধে পাচ্ছে না। জানেও না কার গেঞ্জি সে ঝেড়ে এনেছে। গায়ে দিতেই একপাশের সেলাই ছিঁড়ে গেলো। বগলে গেঞ্জিটা যেন দাঁত বসিয়েছে। কেষ্ট বুঝিয়েছে, এটাই পাওয়া গেছে। আর বড় সাইজের পাওয়া যায়নি। পড়তে হয় পড়। এর সাথে আরও অস্বস্তি যোগ হয়েছে ডাবল পায়জামার ওপর ফুলপ্যান্ট।
এদিকে সংযোনি কিছুটা বিমর্ষ কারণ রাণীগঞ্জে কয়লা লোডিং অধ্যায়ের সম্পুর্ণ বিবরণ দেওয়া বাকী। চুপচাপ আর বসে থাকা যায় না। খানিক পরেই শুরু হলো, “হ্যাঁ, যা বলছিলাম। কয়লা আসতো রাণীগঞ্জ থেকে, আর রেল ইয়ার্ড ছিলো উগান্ডায়। উগান্ডায় বিরাট রেল ইয়ার্ড, মাইলের পর মাইল শুধু ওয়াগন আর ওয়াগন…… “
সংযোনিকে থামিয়ে দেওয়া হলো, “উগান্ডায় রেল ইয়ার্ড?”
“আরে ওই যে, যে জায়গাটায় অনেক কয়লার খনি টনি আছে রে, দুর্গাপুরের কাছে।”
– গুরুজী, ওটা অণ্ডাল হবে, অন্ডাল। উগান্ডা নয়।
সংযোনি তৎক্ষণাৎ জিভ বার করে, “হ্যাঁ, হ্যাঁ ওই অণ্ডাল। অণ্ডাল হবে অন্ডাল। সরি, ঠিক মনে আসছিলো না রে।“
সংযোনির কখন যে কি কৌতুহল হয়। “আচ্ছা, এই অন্ডাল থেকে উগান্ডা কত দূরে হবে রে?”
– বেশী নয় রে, এই দশ বারো হাজার কিলোমিটার মতন।
– মাত্র? এটা কি এমন একটা দূরত্ব আজকের দিনে? যদি অন্ডাল থেকে যাই, কতক্ষণ লাগবে উগান্ডা এখান থেকে?
– ফ্লাইটে গেলে এই ঘন্টা বারো মতন।
– ওঃ, মানে খুব একটা দূরে নয়।
আবার কিছুক্ষণ পরে “আমি একটু ঘুমিয়ে নি। ব্রহ্মপুত্র এলে আমায় ডেকে দিস।”
– ব্রহ্মপুত্র? আবে, এইজন্যই বলেছিলাম দুপুরে এত এত কচুশাক না খেতে।
– তাহলে, কোন রুটে আমরা যাচ্ছি?
– আমরা হাওড়া থেকে ভাইজাগ, কটক, পাটনা, এলাহাবাদ, ডায়মন্ডহারবার হয়ে বোলপুর যাচ্ছি।
– ইস, ব্রহ্মপুত্রটা মিস হয়ে গেলো রে।
এসব সামান্য ব্যাপার। গন্ডগোলটা হয়ে গেলো আর কিছুক্ষণ পর। আজ রাতে কি খাওয়া হবে তার কোন ঠিক নেই, তাই সংযোনি দুপুরে আর বিকেলে ঠাসিয়ে খেয়েছে। সংযোনি নিজেও বুঝতে পারছে দুপুরে এতটা কচুশাক না খেলেই ভালো ছিলো। সংযোনির পেট এখনই খানিকটা হালকা না করলেই নয়। “তোরা বস, আমি একটু বাথরুমে যাই। পেট ভারী লাগছে। হাল্কা করে আসি।”
– তখনই তোকে বলেছিলাম সংযোনি, এরকম ঠেসে ঠুসে খেয়ো না। কে শোনে আমার কথা?
– চিল্লাস না নুনু’দা, এটা আমার পেট, আমি এই পেটের মালিক। আমি কি ঠাসবো আর কি মাল বডি থেকে বের করবো, কখন কোন মুখ দিয়ে বার করবো, সেটা আমার ইচ্ছে। আমি তোর ইচ্ছেমতন নিজেকে ভারী বা হাল্কা করব না।
এইবার নাটকের শুরু। এতক্ষণ ছিলো ভূমিকা।
বাথরুমে গিয়ে সংযোনির পেটটা হালকা হয়ে গেলো। কিন্তু যেখানে সংযোনি সেখানেই বিপদ! পেট তো ক্লিয়ার হয়ে গেলো, কিন্তু ট্রেনের বাথরুমে যে এক ফোঁটাও জল নেই। ট্রেনভর্তি লোক, দরজা খুলে যে বাইরে আসবে, সেই উপায়ও নেই। নিজের গ্যাঙের অন্যরা অনেক দূরে। দরজা ফাঁক করে কাউকে যে ডাকবে তারও উপায় নেই। মাথায় আসছে না, এখন কি করা যায়? একবার ভাবলো, নিজের গায়ের গেঞ্জি বা জাঙ্গিয়া খুলে তাই দিয়ে মুছে নেয়, সাহেবরা তো এরকমই করে, টিস্যু পেপার দিয়ে।
একটা ষ্টেশনে ট্রেন এসে থেমেছে। আবছা অন্ধকার, বিশেষ কিছু দেখা যায় না। শুনতে পাচ্ছে, “চা, চা। গরম চা”। “কফি, গরম কফি”।
আইডিয়া! আইডিয়া! এইতো সহজ উপায়! জল না থাক, অন্য জিনিষ তো আছে? ইঞ্জিনিয়ারিং আর এমারজেন্সিতে প্রাথমিক নিয়মই হলো যে মাথা ঠাণ্ডা রেখে সমস্যার সমাধান করা। এখন যে কাজের জন্য জল লাগবে, তাতে জল না পেলেও চা কফি, দুধ, নারকেল তেল, বা সরষের তেল, কেরোসিন তেল যে কোনো তরল পদার্থই চলবে। পরিষ্কার করা নিয়ে কথা।
– এই চা, এখানে, এখানে।
ট্রেনের বাথরুমের জানালা পুরো খোলে না। ওপরের একটুখানি ফাঁক দিয়ে সংযোনি চাওয়ালাকে হাত নেড়ে ডাকছে “এই যে ভাই, এই যে এখানে। ও চাওয়ালা এখানে ভাই এখানে।”
চাওয়ালা ডাক শুনতে পেয়েছে কিন্তু ডাকটা কোন জানালা থেকে আসছে বুঝতে পারছে না। পাশেই এক কফিওয়ালা ছিলো। সংযোনিকে দেখতে পেয়েছে। “বাবু কফি নেবেন? ভালো কফি।”
– কফি? কফির তো অনেক দাম হবে। কত করে ভাই?
– বাবু, এক’টাকা এক কাপ।
– এক’টাকা? না না, এ অনেক দাম! ওই চাওয়ালাকেই একটু ডেকে দাও না ভাই।
– আপনি ডাকুন। আমি যাই।
সংযোনি পড়লো মুশকিলে। ট্রেন এক্ষুনি ছেড়ে দেবে। জল যখন নেই, চা পেলে কাজটা সস্তায় হয়ে যেতো। আর কফি তো ওই ছোট্ট ছোট্ট এক কাপে হবে না, অন্তত দশ বারো কাপ লাগবে। “ভাই, ঠিক আছে, দশ কাপ কফি নেবো। একটু সস্তায় দাও না ভাই প্লীজ”।
– না, সে দশ কাপ নিলেও একই দাম। তাড়াতাড়ি বলুন। ট্রেন ছাড়লো বলে।
– আছা, ভাই। তাহলে স্টুডেন্টস ডিস্কাউন্ট দাও।
– আমি চললাম। আপনি অন্য কোথাও দেখুন।
– এই দাঁড়াও, দাঁড়াও, যেওনা। আগে তোমার কাপের সাইজ দ্যাখাও।
– আমি যাই দাদা, ফিরবার পথে ডাউন ট্রেনে কাপের সাইজ দেখিয়ে দেবো।
– ঠিক আছে, ঠিক আছে। দাও, দশ কাপ দাও। কাপে ভর্তি ভর্তি করে দিও।
– আগে টাকা দিন। আপনি বাথরুমের জানলা দিয়েই কফি নেবেন? দশ কাপ?
– হ্যাঁ ভাই, বাথরুমের জানলা দিয়েই নেবো। আমার সমস্যা তুমি বুঝবে না।
সংযোনি গুনে গুনে দশ টাকা দিয়ে দশ কাপ কফি নিলো। কফিওয়ালা বলতে বলতে যাচ্ছে, “তেইশ বছর এ লাইনে আছি। বাপের জন্মে দেখিনি, বাথরুমের জানলা দিয়ে দশ কাপ কফি! আবার জানলায় স্টুডেন্টস ডিস্কাউন্ট কাউন্টারও খুলেছে।”
বাথরুমের মেঝেতে সংযোনির সামনে দশ কাপ কফি একসাথে সাজানো। এবার সংযোনি তার “ঐ জায়গা” পরিস্কারের কাজ শুরু করবে। কিন্তু কফি যে বেজায় গরম। “ওখানে” গরম কফি লাগালে নরম মোলায়েম সংবেদনশীল জায়গা হয়তো পুড়েই যাবে। ফোস্কা পড়ে যাবে না তো? তখন আবার মলম কিনে লাগাতে হবে। কি ঝামেলায় মাইরি। আবার পরক্ষনেই ভাবলো, পুরো দশ কাপ কফি কি এই কাজে লাগবে? যদি না লাগে, তাহলে দু’এক কাপ কি খেয়ে নেবো?
ভাবতে ভাবতে সংযোনি এক কাপ কফি খেয়েই নিলো। বেশ গরম। ভালোই হয়েছে তাড়াহুড়োয় “ওখানে” লাগালে ফোস্কায় জ্বলিয়ে দিতো। ভাবতে ভাবতে আরও এক কাপ। এবার ট্রেন ছেড়ে দিতেই, এই মরেছে! ট্রেনের দোলায় কফি তো ছলকে ছলকে উপচে পড়ে। তাড়াতাড়ি, আর দেরী নয়। ওই গরম কফিতেই “ওই জায়গাটা” অনেক কায়দা করে মনের মত করে পরিষ্কার ধোয়া গেলো। এক কাপ কফি এখনও আছে। সংযোনির কি তৃপ্তি, কি আনন্দ। শেষ কাপের কফিটা সংযোনি অনেক তৃপ্তি করে খেলো। একবার ভাবলো বন্ধুদের গিয়ে কলার উঁচু করে বলে, “আমি দশ টাকার কফি দিয়ে নিজের গু পরিস্কার করি।“ আবার ভাবলো, না থাক। কি না কি খোরাক করে দেয়! এদিকে গরম কফির ছ্যাঁকায় “ওই জায়গাটা” এবার জ্বলছে। ইলেকট্রিক স্পার্কের মতন লাগছে।
ওদিকে কেষ্ট ও তার সঙ্গীরা ফেঁসেছে টিকিট চেকারের ঝামেলায়। টিকিট সংযোনির কাছে। সংযোনি ফিরে এসেছে। কিন্তু টিকিট কোথায়? এবার বোঝো!! “এজন্যি বলেছিলাম …… ।“ সংযোনিকে কিছু বলা না বলায় কিস্যু ফারাক হয় না। টিটি মনে হয় সহৃদয় ছিলেন। মাত্র দশ টাকা ফাইন করে রসিদ দিয়ে ছেড়ে দিলেন। টিকিটের ঝামেলা আপাতত মিটলো।
মাঝরাতে ট্রেন বোলপুর এসে পৌঁছালো। কেষ্ট আগেই খোঁজ নিয়েছিলো যে শাতিনিকেতনে স্টুডেন্টস গেস্ট হাউসে বাইরে থেকে বেড়াতে আসা স্টুডেন্টদের জন্য কম খরচে থাকার ব্যাবস্থা আছে। রাত্রিটা ওরা বোলপুর ষ্টেশনের ওয়েটিং রুমেই কাটিয়ে দিয়ে, এবং ভাগ্য ভালো পরদিন সকালেই শান্তিনিকেতনের গেস্ট হাউসে গিয়ে দুটি রুমও পেয়ে গেলো।
এবার সকালে কি ঝামেলা, কি ঝামেলা! সংযোনি প্রাতঃকৃত্যে গিয়ে ফিরে এসেছে। পিছন জ্বলছে। বসতেও পারছে না, দাঁড়িয়ে আছে। সকালের চাও খেতে চাইছে না। বলছে, চা খেলেই বাথরুম ছুটতে হবে। গরম কফিতে “ঐ জায়গায়” নাকি ফোস্কা পড়েছে, মলম চাই।
নুনু’দা, কেষ্ট, ল্যুঁজ, চিংড়ি সকলেই অবাক। সংযোনি কফি খেলো কখন? পেলোই বা কোথায়? আর গরম কফি খেলেও ফোস্কা তো শুধু জিভেই পড়বে, তাতে প্রাতঃকৃত্য করতে অসুবিধা কোথায়? আর কোথা থেকে, আর কিভাবেই বা গরম ছ্যাঁকা লাগলো? কোথায় ফোস্কা হয়েছে?
সংযোনি বুঝলো যে এঁদেরকে ঘটনাটা না জানালে এরা সমস্যার গুরুত্বটাই বুঝবে না। সবার প্রশ্নবানে জর্জরিত সংযোনি বাধ্য হয়ে গত সন্ধ্যার বাথরুম ও গরম কফির ব্যাপারটা বিস্তারিত শোনালো। “সংযোনি, তোকে তো কোথাও নিয়ে যাওয়াও বিপদ রে। আমরা পাহাড় সমুদ্র গেলামই না তোর ভয়ে। তুই তো সমতলের মাটিতেও ভয়ঙ্কর খেলিস রে সংযোনি। তোকে নিয়ে তো বাসে ট্রেনে যাওয়াও মুশকিল।”
– মাইরি বলছি, আমার অবস্থাটা বুঝে দ্যাখ। জল নেই। সামনে গরম কফি। কফি ঠাণ্ডা করতে গেলে ট্রেনের ঝাঁকুনিতে কফি ছলকে পড়ে যাচ্ছে। কি করি তখন বল?
– সংযোনি। আমার ঠাকুরদাকে দেখেছিলাম। শেষ বয়সে আয়া রেখেছিলো। এরপর আমরা যেখানেই যাবো, তোর জন্য একটা আয়াও সঙ্গে নিয়ে নেবো। বেডপ্যান আর অয়েল ক্লথও থাকবে। এখন থেকে ঠ্যালাগাড়ি বা রিকশায় যাবো। বাসে ট্রেনে তোর সাথে আর নয়।
– তুমি পারো সংযোনি। ওই অবস্থায় তুই ওই তিন কাপ কফি খেতে পারলি?
– কি করি বল? দাম দিয়ে কিনেছি, পয়সা নষ্ট হলে গায়ে লাগে না? তাই একটু খেয়েও নিলাম।
নুনু’দা শান্ত স্বভাবের। মাঝেমধ্যে কিছু বলেন। “তোরা এটাকে অন্যভাবে দেখ। দশ টাকার কফি দিয়ে নিজের পোঁদের গু পরিস্কার করা। টাটা বিড়লা আম্বানী এটা পারবে?”
এরকম করুন কাতর সংযোনিকে কখনও দেখা যায়না। “ভাই নুনু’দা, এখনও তো দোকান খোলেনি। তুই তো মুখে ভালো ভালো ক্রিম মাখিস। দে না একটু, ভাই।”
– চোপ বে। ওই ক্রিম মুখে লাগানোর জন্য, তোমার পোঁদে লাগানোর জন্য নয়। হেমা মালিনী, রেখা, মৌসুমি, শর্মিলারা ওই ক্রিম মুখে লাগিয়ে বিজ্ঞাপন দেয়। ওরা যদি খবর পায় তুমি ওই ক্রিম তোমার ইয়েতে লাগাও, তোর নামে কেস ঠুকে দেবে।
– দে না রে ভাই, আমার ওই ছোট্ট মুখটা বড্ড জ্বলছে। আচ্ছা, আমি না হয় তোকে ওই ক্রিম নতুনই একটা কিনে দেবো। মা কালীর দিব্যি, কিনে দেবো।
– সংযোনি, আমার ক্রিম মানুষের মুখে লাগায়। বডির অন্য কোনো ছোট্ট মুখে নয়।
কেষ্ট গেস্ট হাউস থেকে একটা চামচ জোগাড় করে সেই চামচের ডগায় ক্রীম রেখে যত্ন সহকারে সংযোনির ইয়েতে মলম লাগিয়ে দিলো। মানে নুনু’দার থেকে মলম নিয়ে তখনকার মতন অবস্থা সামলানো গেলো। গেস্ট হাউসে খোঁজ নিয়ে জানা গেলো যে কাছেই একটা ডাক্তারখানা আছে। কেয়ার টেকার জানতে চাইলো, কিসের সমস্যা। কেউ কোন উত্তর দিলো না। যাই হোক, জানা গেলো, সকাল দশটায় ডাক্তার আসেন।
সংযোনি ডাক্তারখানায় লাইনে সবার আগে। ডাক্তার চেম্বারে এসে সবার আগে সংযোনিকেই ডাকলেন। সমস্যা শুনলেন, কিন্তু ফোস্কার জায়গাটা দেখলেন না। “দ্যাখো ছেলেরা। ওই ফোস্কার জায়গাটা না দেখে ওষুধ দেওয়া যাবেনা। আমি ডাক্তার ঠিকই। তবে আমারও একটা সংস্কার আছে। বুঝতেই পারছো, আমি রোগীর মুখ, চোখ, হাত, পা দেখে দিনের শুরু করি। পেশেন্টের পোঁদের ফুটো দেখে আমার দিনটা শুরু করতে চাইনা। ফোস্কার জায়গাটা, মানে পোঁদের ফুটোয় টর্চ জ্বালিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে হবে। বুঝতেই পারছো, ওটা ঠিক সকালবেলার শুভদর্শন নয়। আমি বরং তোমায় এখন একটা মলম দিয়ে দিচ্ছি। পরে বারোটা নাগাদ এসো, ভালো করে ওই জায়গাটা দেখবো। ভিজিট লাগবে না, এমনি দেখে দেবো। আর এখন বাড়ি গিয়ে একটু বরফ ঘষে দাও।”
– বরফ ঘষতে হবে?
– মানে আস্তে আস্তে ঘষবে।
– ডাক্তারবাবু, সকাল থেকে পায়খানা চেপে আছি।
– আগে বরফ লাগাও, তারপর।
– স্যার, আমার গ্যাসের দোষ আছে। প্রতিবার মনে হচ্ছে চল্লিশ হাজার ভোল্টের স্পার্ক হচ্ছে।
– ঠিক আছে, বরফ লাগাও, ঐ স্পার্ক ঠিক হয়ে যাবে।
বোঝো? এখন বরফ কোথায় পাওয়া যাবে? গেস্ট হাউসে ফিরে কিচেনে বরফ চাইতেই ম্যানেজারের প্রশ্ন “বরফ? বরফ কেন? সকালে উঠেই মদ খাবে? না না এসব এখানে চলবে না।“
– না না, মদ নয়। মদ নয়। ফোস্কা পড়েছে। এই দেখুন ডাক্তারবাবু প্রেসক্রিপশনে লিখে দিয়েছেন বরফ লাগাতে হবে।
– বরফ? ঠিক আছে, বরফ দিচ্ছি, কিন্তু তোমরা যা করবে ঘরের দরজা খুলে করবে। দরজা বন্ধ করতে পারবে না।
– আরে না না, ম্যানেজার বাবু, সে সম্ভব নয়। কেউ হটাৎ ঘরে এসে গেলে সে এক বিচ্ছিরি ব্যাপার হয়ে যাবে।
“ম্যানেজার বাবু, আপনি এদিকে আসুন, আপনাকে বুঝিয়ে বলি”।
ম্যানেজারবাবু শুনলেন, প্রেসক্রিপশন দেখলেন। তারপর ফ্রিজ থেকে কয়েক ব্লক বরফ বার করে দিলেন। কিন্তু বললেন, “যাই বলো, দরজা লাগিয়ে কিছু করতে পারবে না।“
এবার বরফ লাগাতেই “উঃ বাবা, কি ঠাণ্ডা রে। জায়গাটা শিরশির করছে, এরকম হবে জানতাম না রে”।
– শিরশির করছে? পোঁদে আরও গরম কফি লাগাও। বরফ কি ঠাণ্ডা না হয়ে তোমার চ্যালাকাঠের আগুন হবে?
– রাগ করছিস কেন? দ্যাখ বরফ গলে গিয়ে আমার পায়জামার কিরকম অবস্থা হয়েছে।
– নাও, এখন অয়েল ক্লথ আর কাঁথা কিনে নিয়ে এসো।
– আমার ব্যাগে একটা গামছা আছে, ওটা নিয়ে আয়।
– গামছা? তোমার আবার গামছা? কবে কিনলে?
– আরে, আগে তো নিয়ে আয়। ব্যাগেই আছে।
ল্যুঁজ সংযোনির ব্যাগ খুলে অবাক। আসবার সময় ওর নতুন কেনা লুঙ্গিটা খুঁজেই পাচ্ছিলো না। সংযোনির ব্যাগে আবিষ্কার হল। হাতে নিয়ে দেখে অর্ধেক কাটা। “সংযোনি, এটা কি? আমার লুঙ্গির এই অবস্থা কেন? আর আমি কাল আমার লুঙ্গি খুঁজেই পাই না।”
– ওটা লুঙ্গি নয় রে, লুঙ্গি নয়, ওটা এখন কেটে গামছা বানিয়েছি।
– এর বাকি অর্ধেক কোথায়?
– ওটা চিংড়ি নিয়েছে, ওরও একটা গামছার দরকার ছিল।
– মানে আমার নতুন কেনা লুঙ্গি তোমরা দুজনে মিলে কাটাকুটি করে নিজেদের গামছা বানিয়েছ?
এবার চিংড়ি নিজের সাফাই দিলো। “আমি জানিনা। কেষ্টই আমায় এনে দিলো।”
– কেষ্ট?
সংযোনি তখন অসহায় সদ্যজাত শিশু। পায়জামা ছেড়ে একটা গামছা জড়িয়ে, মানে ওরিজিনাল লুঙ্গির অর্ধেক ছিঁড়ে গামছা বানিয়ে সেটা শরীরের মধ্যপ্রদেশে জড়িয়ে উপুড় হয়ে মেঝেতে শুয়ে আছে। আর কেষ্ট একটা রুমালে বরফ বেঁধে মিনিট পাঁচেক পরে পরেই সংযোনির পিছনে গুঁজে দিচ্ছে। সংযোনির কাহিল অবস্থা। “শ্যালা বরফেও যে এত ছ্যাঁকা লাগে জানতাম না।”
গেস্ট হাউসের ম্যানেজার ঘরের দরজায় টোকা মেরে ব্যাপারটা দেখতে এলেন। তাঁর গেস্ট হাউসে কি কি ঘটছে তাঁর জানা দরকার। সব দেখে বললেন, “আমি কি একটু চুন হলুদ পাঠিয়ে দেবো?”
– না না, বাপরে। একেই ফোস্কা, তার উপর চুন হলুদ শুকিয়ে জমে গেলে আরেক কেলেঙ্কারি হবে।
– তাহলে একটা টেবিল ফ্যান পাঠিয়ে দিচ্ছি?
– টেবিল ফ্যান দিয়ে কি হবে?
– না যদি ওখানটায় ভালো হাওয়া লাগাতে চান, নিতে পারেন। ঠাণ্ডায় আরাম লাগবে।
বেলা বারোটা নাগাদ আবার সবাই মিলে ডাক্তারের কাছে যেতেই উনি ক্ষতস্থান দেখলেন। “একটা কথা আমায় বোঝাও তো ভাই, গরম ছ্যাঁকা শরীরের অনেক জায়গায় লাগে, এখানে কিভাবে গরম ছ্যাঁকা লাগলো?”
– গরম কফি ডাক্তারবাবু, সে অনেক কমপ্লেক্স ব্যাপার।
– গরম কফি? এই জায়গায়?
– সেই তো বলছি ডাক্তারবাবু, কমপ্লেক্স ব্যাপার।
– গরম কফি তো মুখে চুমুক দিয়ে খায়। নাকি তুমি বাজি ধরে এই কাজ করেছো?
– না না, জায়গাটা শুধু ধুয়েছি।
– ধুয়েছ? গরম কফি দিয়ে ওখানটা ধুয়েছ? তুমি গরম জলেও তো সেটা করতে পারতে। কফি কেন?
– তাহলে শুনুন।
ডাক্তারবাবু বিস্তারিত শুনলেন। তারপর জানলেন এরা কারা, কোথা থেকে এসেছে। একটা মলম দিলেন। সেরে যাবে। আর ছোট্ট মন্তব্য করলেন “ইঞ্জিনিয়ারিঙের ছাত্রদের অনেক গল্পই শুনি। তোমাদের নানান রকমের বুদ্ধির কথাও শুনতে পাই। তবে এই আইডিয়াটা ভাই, অনবদ্য। তুলনা নেই।”
আরও কৌতুহলী হয়ে জানতে চাইলেন, “তোমরা কি দেবজ্যোতিকে চেনো? বারো নম্বর হস্টেলের, এখন সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে।“
– হ্যাঁ,হ্যাঁ চিনি চিনি। সকলেই ওঁকে চেনে, বিখ্যাত চরিত্র।
– হ্যাঁ, এখন এই অবস্থায় কিছুদিন তুমি ওঁর ধারেকাছে যেও না। ওঁর থেকে সাবধানে থাকবে।
*****
সংযোনি এখন গর্ব করে সবাইকে বলে, আমি দশ টাকার কফি দিয়ে নিজের হাগু পরিস্কার করি।
Add comment