রাইট ব্যাকে বাদল
অসীম দেব
ভুমিকা – খেলাধুলাকে বিষয় করে একটা লেখার চেষ্টা করলাম। আমার কলেজ সতীর্থ বাদল মোদক ছিলো তার সমকালীন যুগে (‘৭২ – ‘৭৭) কলেজের একজন সেরা খেলোয়াড়। সেরা হতে ওকে অনেক কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে আসতে হয়েছিলো। যদিও এটি একটি গল্প, তবে বর্ণিত বেশ কিছু ঘটনাই সত্য। এটি বাদলের বায়োগ্রাফি নয়, তার জেদ ও ফাইটিং স্পিরিট অবলম্বনে একটি কাহিনী। তাঁকে ও শুভঙ্কর’দা কে ধন্যবাদ, ওদের নাম ব্যাবহার করে গল্পটি লিখতে অনুমতি দেওয়ায়। গল্পটি একটু দীর্ঘ, ধৈর্য ধরে সকলকে পড়তে অনুরোধ করছি, বিশেষ করে যারা খেলাধুলা করেছে।
বাদল তাঁর শৈশব, বাংলাদেশে কিভাবে গ্রামে অল্প বয়স থেকে তার ফুটবলে হাতেখড়ি, হাইস্কুল উঠে সাব জুনিয়র ডিসট্রিক্ট টুর্নামেন্ট খেলা, ইত্যাদি অতিক্রান্ত করে ১৯৭২ সালে শিবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সময় থেকে এই গল্পের শুরু।
******
বাদল তার বাবা-মায়ের সাথে ’৭১ এর বাংলাদেশ যুদ্ধের দামামায় নিজেদের ভিটেমাটি পিছনে ফেলে একবস্ত্রে এপার বাঙলায় চলে এসেছে। দীর্ঘ এক বছরের দুঃসহ অনিশ্চিয়তা, বাধাবিপত্তি ও অবসাদের ক্লান্তির পর অবশেষে বাদল শিবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিঙে এসে ভর্তি হ’লো, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিঙের একটা সে সীট পেয়েছে। পাঁচ বছর হোস্টেলে থেকে তাকে পড়াশুনা করতে হবে। বাদলের বাড়ির লোকেরা নিশ্চিন্ত, যে বাদলের মাথার উপর এখন একটা ছাদ অন্তত আছে, আর তাঁকে ঘিরে আছে অসংখ্য সুহৃদ ছাত্রের দল।
যদিও বাদল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে এসেছে, কিন্তু এই আসার আনন্দের সাথে সাথে বাদলের প্রধান চিন্তা, এই কলেজে ফুটবল খেলার কতটুকু সুযোগ সে পাবে? গত বছর নিজের বসতবাড়ি ছেড়ে আসার পর থেকে মাঠে নামার কথা তার মাথায়ই আসেনি। তাঁর বা পরিবাবের অন্যদের মাথার ওপর স্থায়ী এতটুকুও ছাদ ছিলো না। আজ এখানে, কাল ওখানে অন্যের আশ্রয়ে থেকেছে। সেই অবসাদের মাঝে খেলার ইচ্ছেটাই ওর আসেনি।
কলেজে প্রথম দিনেই বাদলের নজরে এসেছে, ক্যাম্পাসে এক বিশাল সবুজ মাঠ। সাহেবদের আমলের মাঠ, নাম ওভাল। এরকম সবুজ সুন্দর মাঠ সে আজ পর্যন্ত দেখেইনি, খেলা তো শতেক যোজন দুরের কথা। ৭২ সালের রাজনৈতিক অস্থিরতায় ওদের কলেজের সেশন শুরু হয়েছে অনেক দেরীতে, শীতকালে ডিসেম্বর মাসে। সেই বছরের ফুটবল সেশন ততদিনে শেষ, তখন ক্রিকেটের সিজন, আর পরের সিজনের ফুটবল শুরু হতে এখনও অনেক দেরী। বাদল খোঁজ নিয়ে জেনেছে, কলেজে একটা এথলেটিক্স ক্লাব আছে। ওভাল মাঠে গিয়ে দেখেছে, রোজ ক্রিকেট খেলা হয়। সামনেই কয়েক সপ্তাহ পরে কলেজের এন্যুয়াল স্পোর্টস। বিকেলে ওই মাঠে দুজন ছেলে পোলভল্ট প্র্যাকটিস করছে। তাদের মধ্যে একটি তো একদম বাচ্চামতন দেখতে। বাদল পরে জেনেছিল ওই বাচ্চামতন ছেলেটি সঞ্জয়’দা, ওর থেকে তিন বছরের সিনিয়র। বাদল স্কুলে কোনোদিন পোলভল্ট দেখেনি। অবাক হয়ে দেখছে ওই বাচ্চামতন ছেলেটি অবলীলায় বাঁশের ডগায় নিজেকে তুলে নিয়ে পনেরো ফুট উঁচু বেড়া ডিঙিয়ে চলে যাচ্ছে। পাশেই লং জাম্প আর হাই জাম্প। মাঠের অন্যকোনে গ্যালারি। তার পাশে ভলিবল কোর্ট। ভলিবল কোর্টের পাশে ছেলেরা একশ মিটার, দু’শো মিটার স্প্রিন্ট প্রাকটিস করছে। বাদলের মনে পড়ে গেলো ওর স্কুলের দিনগুলি। স্কুলের স্পোর্টসে সে একশ মিটার, দু’শো মিটার আর পঞ্চাশ মিটারে সবসময় ফার্স্ট হয়েছে। সেই সব মেডেল আজকের অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের গ্রামের বাড়িতেই ফেলে রেখে এসেছে। জানে না এখন সেগুলি কি অবস্থায় আছে। মেডেলের দুঃখ আজ আবার তাকে নাড়া দিয়ে গেলো। এই সামনের ওভাল মাঠ বাদলকে ডাকছে, আয় এই সবুজ ট্র্যাকে এসে দৌড়ো। কিন্তু ভয়, দুঃখ আর মানসিক জড়তাই এখন বাদলের প্রতিবন্ধকতা। আমি স্কুলে চ্যাম্পিয়ন ছিলাম, এখানে যদি হেরে যাই? স্পোর্টসের দিনে বাদল মাঠের ধারে গ্যালারীতে বসে দেখলো, তার বন্ধুরা ট্র্যাকে দৌড়ে তার চোখের সামনে দিয়ে সবকটা মেডেল নিয়ে চলে গেলো।
জানুয়ারির শেষের দিকে বাদল এথলেটিক্স ক্লাব থেকে একটা ফুটবল জোগাড় করে একলাই ওভাল মাঠে নামলো। অনেক সিনিয়র দাদারা কলেজ ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় তাদের বুট জোড়া রেখে যায়। বাদল এদের মধ্যে থেকেই একটি ভালো বুট জোগাড় করেছে। এথলেটিক্স ক্লাবের দেবেশ স্যার প্রথমে দিতে চাইছিলেন না। এই জানুয়ারিতে একলা একলা কি ফুটবল প্র্যাকটিস করবে? শেষে বলে দিয়েছেন, মাঠের ক্রিকেট বাউন্ডারির মধ্যে এখন ফুটবল খেলা যাবেনা। দেখিয়ে দিয়েছেন, ক্রিকেট স্কোর বোর্ড, প্যাভিলিয়নের দিকটাতে ছোটো জায়গা বানিয়ে ও খেলতে পারে। ফুটবল খেলাটা বাদলের এখনের মুখ্য উদ্দেশ্য নয়। এই প্রথম সে বুট পায়ে মাঠে নামছে। বাংলাদেশে নেতাজী সঙ্ঘের হয়ে খেলার সময় সে বুঝেছিল খালি পায়ে আর কেডস পড়ে কি তফাৎ। তাই বুট পায়ে সে সিজনের আগেই কিছুটা দৌড়ঝাঁপ করে নিতে চায়।
স্কুলে বাদলের সুবিধে ছিলো। হাতে অনেক সময় ছিলো। ভোরে উঠে গ্রামের মাঠে পঞ্চাশ মিটার স্প্রিন্টের প্র্যাকটিস করতো। আর এখন কলেজে সকাল সাতটা থেকে ক্লাস শুরু। বিকেলে ক্লাস চলে চারটে পর্যন্ত। তাঁর আগে মাঠে আসার সুযোগ নেই। তাই এখন রোজ বিকেলে ক্লাস থেকে ফিরেই বুটজোড়া নিয়ে একলাই মাঠে চলে আসে। দেবেশ স্যার অবাক হয়ে ভাবেন বুট পড়ে ছেলেটা খেলে কাদের সাথে? রোজ তো বল নিয়েও যায়না? বলই বা পায় কোথায়? একদিন নিজেই গিয়ে দেখলেন। দেবেশ স্যার প্রায় আঠারো বছর এই কলেজের এথলেটিক্স ক্লাবে আছেন। কখনও দেখেননি কেউ ফুটবলের জুতো পায়ে দিনের পর দিন একশ মিটার দৌড় প্র্যাকটিস করছে। কিছু বললেন না, চলে এলেন। সন্ধ্যে হয়ে গেছে, মাঠ অন্ধকার, বাদল তখনও দৌড়চ্ছে।
মোটামুটি বাদল যখন বুট পায়ে নিজের আত্মবিশ্বাস ফিরে পাচ্ছে, তখন সে বল নিয়ে নামতে শুরু করলো। স্কুলের হাকিম স্যার যেমন শিখিয়েছিলেন তেমনি শুরুতে বুট পায়ে শুধু কিক প্র্যাকটিস করতে হবে। শুধুই কিক প্র্যাকটিস, অন্য কিছু নয়। কিন্তু এখন ক্রিকেট সিজন, ওভাল মাঠে এখন ফুটবলের গোলপোস্ট নেই। বাদল দেখলো একটাই উপায়। যেখানে ভলিবল খেলা হয়, তার পাশেই একটা দোতালা গ্যালারী আছে। ওই গ্যালারীকেই টার্গেট করে শট প্র্যাকটিস করা যাক। দু তিনদিন পরে দেবেশ স্যার দেখতে এলেন, কি হচ্ছে। গত কয়েকদিন তিনি খেয়াল করেছেন, অন্ধকার হলেও বাদল বল ফেরত দিতে অনেক দেরী করে। এসে দেখলেন, গ্যালারিকে বারপোস্ট বানিয়ে বাদল অন্ধকারে একা একাই কিক প্র্যাকটিস করছে।
দিনকয়েক পরে দেবেশ স্যার আবার এলেন, সঙ্গে একজন। বাদলকে ডাকলেন, পরিচয় করিয়ে দিলেন, তিন বছরের সিনিয়র। নাম শুভঙ্কর, কলেজ ফুটবল টিমের ভাইস ক্যাপ্টেন। “তোমার কথাই হচ্ছিলো, বাদল। শুভঙ্কর তোমার কথা শুনে নিজেই তোমার সাথে দেখা করতে এসেছে।”
বাদল বুঝতে পারছে না কি বলবে, কি করবে। ওদের বাংলাদেশের গ্রামের স্কুল বা নেতাজী সঙ্ঘের থেকে এখানের ব্যাপার স্যাপার অনেক আলাদা। ও চুপ করে আছে। শুভঙ্করই আলাপটা সহজ করে দিলো “তোর নাম বাদল? ফ্রেশার? দেবেশদা বলছিলেন তুই নাকি রোজ বুট পায়ে স্প্রিন্ট করিস?” বাদল বেশ খানিক ভেবে ছোট্ট করে উত্তর দিলো “হ্যাঁ।”
– আর অন্ধকারে এই গ্যালারীতে একা একা কি প্র্যাকটিস করছিস?
– আমি বুট পরে আগে কখনও খেলিনি, তাই শট প্র্যাকটিস করছিলাম।
– আগে বল এই শর্ট ডিসটেন্স স্পটকিক মেরে তোর কি প্র্যাকটিস হবে?
বাদলের মনে হলো প্র্যাকটিস ঠিকমতন হচ্ছে না, সেটাই দেবেশ’দা বা শুভঙ্কর’দা হয়তো বলতে চায়। বোধহয় অন্যরকম কিছু করতে হবে। শুভঙ্করই বললো “এক কাজ কর। তুই তোর প্র্যাকটিসের পর আমার সাথে জিমে এসে দেখা কর। আমি ওখানে আছি।” বাদল জানে না জিম কি বস্তু। “ওঃ, তুই তো নতুন। এই এথলেটিক্স ক্লাবের বাড়িটাকেই আমরা জিম বলি। চলে আয়, আমি ওখানেই আছি।”
সন্ধ্যার অন্ধকারে আর যখন কিছুই দেখা যায় না, বাদল তখন বল নিয়ে জিমে ফিরে এলো। বাদল শুনলো, বাদলের জন্য শুভঙ্করই ব্যাবস্থা করে দিয়েছে। কাল থেকে জিমের মালী রামজীবন বাদলের সাথে সাথে থাকবে। বাদল ওভালের ওই প্যাভিলিয়নের পাশেই প্র্যাকটিস করবে। বল দূরে চলে গেলে রামজীবন এনে দেবে। আর কিছুদিন পরেই ফেব্রুআরির মাঝামাঝি সময় থেকে যখন অনেকেই ফুটবল খেলতে মাঠে আসবে, তখন বাদলও এই ওভাল মাঠে বাইশজনের একজন হয়ে খেলতে পারবে।
মাঠের কোনায় ক্রিকেট প্যাভিলিয়নের জায়গাটাই বাদলের বেশি পছন্দ। সামনেই ক্রিকেট নেট প্রাকটিসের জন্য কংক্রিটের পিচ। মাঠের লোহার বেড়ার ওপাড়ে একটা বিশাল পুকুর। পুকুরের একপ্রান্তে টাওয়ারের উপর চারদিকে চারটে ঘড়ি। মাঠের বাউন্ডারির ধার বরাবর দেবদারু গাছের সারি। আর প্যাভিলিয়নের পিছনের দিকে কোনা বরাবর দোতালা একটা পুরনো বাড়ি আছে। ওটা নাকি সাহেবদের সময়ের কলেজ ছিলো, প্রায় দেড়’শ বছরের পুরনো, তার সাথে লাগোয়া একটা চার্চও আছে। বিল্ডিং এর ডানদিকে কলেজের প্রফেসরদের ক্লাব আর আশেপাশে স্টাফ কোয়ার্টার। খুব সুন্দর একটা পরিবেশ। ওভালের এই জায়গাটাতেই শুভঙ্করদা প্র্যাকটিস করতে বলেছে।
বাদল প্যাভিলিয়নের পাশের জায়গাটায় প্রথমে লম্বা স্পটকিক দিয়ে শুরু করলো। একা একাই। লম্বা লম্বা কিক মারছে, আর রামজীবন বল ফেরত নিয়ে আসছে। প্রথম দিনে ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই বাদল স্পটকিক খানিকটা শিখে নিয়েছে, যেরকম বলা হয়েছিলো। হাকিম স্যারের কথা মনে পড়ে গেলো। দুই পায়েই কিক চাই। ডান পা নিয়ে সমস্যা নেই, বাঁ পায়ে এখনও অনেক কাজ বাকী।
প্র্যাকটিস চলাকালীন মাঝে মাঝেই বাদলের চিত্তচাঞ্চল্য দেখা দিচ্ছে। দুটি সুন্দর মেয়ে, নিশ্চয়ই কলেজের কোন এক প্রফেসরের মেয়ে হবে, বিকেলবেলায় মাঠের বেড়ার ওধারে ঘুরে বেড়ায়। মেয়ে দুটিকে বাদলের ভালো লেগেছে, একদম সামনে থেকে দেখেছে, বেশ সুন্দর। মনে হয় দুই বোন হবে। আরও অনেক ছেলেমেয়েরাও বিকেলের দিকে ওখানে ঘুরে বেড়ায়, বাদলের ধারণা সবাই এই স্টাফ কোয়ার্টারেই থাকে। তবে বিশেষ করে ওই দুটি মেয়েকেই বাদলের খুব ভালো লেগেছে।
দুদিন শুভঙ্কর বাদলকে দূর থেকে খেয়াল করেছে, যাকে বলে অবসার্ভ করেছে। ছেলেটি নিজের মতন একা একাই প্রাকটিস করে চলেছে, আন্তরিকতার কোন অভাব নেই। ফুটবল শিখতে চায়। পরের দিন শুভঙ্কর এসে বাদলকে ডাকলো, নিয়ে গেলো ক্রিকেট প্যাভিলিয়নের কাছে। “শোন বাদল। তুই কতটুকু ফুটবল শিখতে চাস?”
বাদল কিছুই বুঝলো না।
– আচ্ছা, তাহলে বুঝিয়ে বলি। এখানে সবাই বিকেলে ওভালে ফুটবল নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করে, ব্যাস এইটুকুই। কিন্তু কেউ দুটো গোল দিয়েই খুশী, আবার কেউ বেস্ট প্লেয়ার অফ দ্যা ইয়ার হয়েও আরও কিছু হতে চায়। কেউ ইউনিভার্সিটি টিমে খেলতে যায়, কেউ আবার ইন্টার কলেজের টুর্নামেন্টের বেস্ট প্লেয়ার হয়। তুই কি হতে চাস?
বাদল হঠাৎ করে এরকম প্রশ্ন আশা করেনি। মাথায় কোন উত্তরই আসছে না,
– ঠিক আছে, আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু একটা টার্গেট রাখ, অন্তত বেস্ট প্লেয়ার হতে হবে। তবে সেটা হতে গেলে শুধু কিক মেরে মেরে তো আর ভালো ফুটবল হবে না। বলের উপরেও কন্ট্রোল চাই। এবার তোকে বলের সাথে সাথে দৌড়াতে হবে, যাকে বলে উইথ দ্যা বল। যখন উইথ দ্যা বল দৌড়াবি, তখন বল তোর থেকে ঠিক দু’তিন গজ আগে থাকবে, খুব বেশি হলে চার গজ। তার বেশী নয়। স্পীড আস্তে আস্তে রেখে শুরু কর। তাড়াহুড়োর কিছু নেই। বুঝলি?”
বাদল ঘাড় নাড়লো, মানে বুঝেছে। “ঠিক আছে? যা, ওই মাঠের শেষ পর্যন্ত যাবি, আবার ফিরে আসবি।”
বাদল কাজটা যতটা সহজ ভেবেছিলো, বুঝলো অতটা সহজ নয়। বলে পুস করে দৌড়োতেই বল সাত আট গজ আগে চলে যাচ্ছে। শুভঙ্কর থামিয়ে দিলো। “আরে? অত দূরে বল গেলে বলের ওপর তোর কনট্রোলে আর কোথায় থাকলো? অপনেন্ট তো আরামসে বলের দখল নিয়ে নেবে। নে। আবার কর। মনে রাখবি, মাত্র দু’তিন গজ।”
আবার শুরু। এবার পঁচিশ মিটারও হয়নি। শুভঙ্কর আবার ডাকলো। “এটা স্পীড হলো? ক্লাস ফোর ফাইভের বাচ্চারাও এর থেকে জোরে দৌড়ায়। আস্তে দৌড়োতে বলেছি মানে কিছুটা তো ফুটবলের নর্মাল স্পীড চাই, স্পীড। নে, আবার শুরু কর।”
বাদল মাথা নাড়ছে। খানিকটা স্পীড চাই, তার সাথে বলও নিজের তিনগজের মধ্যে রাখতে হবে। বুঝতে পারছে গলদ হচ্ছে, আর কোথায় গলদ সেটাও বুঝতে পারছে। প্র্যাকটিস করতে হবে, প্র্যাকটিস। সেই বিকেলটা এইভাবেই প্রাকটিসে কেটে গেলো। ফিরবার সময় শুভঙ্কর বললো, “আমরা আইআইটি খড়গপুরে খেলতে গিয়েছিলাম। আমাদের সুবীর মিত্রের খেলা দেখে ওঁরা বলেছিলো ভাড়াটে প্লেয়ার নিয়ে এসেছে। তাহলে বুঝে দেখ সুবীরের স্কিল কিরকম। আমি চাই তোর খেলা দেখে অন্যেরা এরকমই বলবে।“
শুভঙ্কর আরও একটা দামী কথা বলেছে। “শোন। দৌড়ানোর সময় তোর তো আর তিন গজ চার গজ খেয়াল থাকবে না। তুই যখন মাঠে আসবি, তখন বিকেল সাড়ে চারটে। সূর্যকে তোর পিছনে রাখবি। দেখবি তোর শ্যাডো ওইরকমই হবে, লম্বায় তিন চার ফিট। তোর দৌড়ানোর সাথে সাথে তোর শ্যাডোও তোর পাশাপাশি বা পিছন পিছন দৌড়াবে। বলটাকে ওই শ্যাডোর মধ্যে রাখার চেষ্টা করবি, দেখবি বলটা যেন তোর শ্যাডোর বাইরে না যায়। প্রথমে স্পীড কম দিয়ে শুরু কর। তারপর আস্তে আস্তে বাড়াবি।”
পরের দিনই বাদল শ্যাডোইং করে কম স্পীডে বল কন্ট্রোল প্র্যাকটিস শুরু করে দিলো। তবে বাদল এটাও জানে, এরকম কম স্পীডে ফুটবল খেলা হয়না। স্পীড আরও বাড়িয়ে বলের ওপর কন্ট্রোল আনতে হবে। শুভঙ্কর একটু পরেই এলো। এবার শ্যাডোর মাঝে বল রেখে স্পীডে দৌড়াতে হবে। তারপর ড্রিবলিং। রামজীবন মাঠের ধার থেকে কয়েকটা ইট নিয়ে এলো। শুভঙ্কর পাঁচ গজ দূরে দূরে এক একটা ইট বসিয়ে দিলো “এবার প্রথমে, বল ছাড়াই, ইটগুলোর সাথে স্পীডে ড্রিবল কর, সাপের মতন এঁকেবেঁকে। মনে রাখবি, বল সঙ্গে থাকবে না। আর লাস্ট ইটে একটাই স্টেপে এক সেকেন্ডের মধ্যে হান্ডরেড এইটটি ডিগ্রী ঘুরে ফেরত আসতে হবে। মনে রাখবি, লাস্ট ইটে মাত্র একটাই স্টেপ নিতে পারবি, আর এক সেকেন্ড সময়ের মধ্যেই শরীরটাকে একশো আশী ডিগ্রী ঘুড়িয়ে আনতে হবে। স্পীড না কমিয়ে। পারতে হবে। ঠিক আছে?”
– আচ্ছা।
– নে শুরু কর।”
বাদল স্কুল থেকেই স্প্রিন্টার। সাপের মতো এঁকে বেঁকে দৌড়ে ইটের পাশ দিয়ে সহজেই ড্রিবল করে চলে গেলো। কিন্তু লাস্ট ইটের পর একটা স্টেপে ঘুরে রিটার্ন করতেই তাড়াতাড়িতে স্লিপ খেয়ে পড়ে গেলো। শুভঙ্কর ছাড়বে না। “নো প্রবলেম। গেট আপ, কুইক কুইক। ট্রাই এগেইন।” বাদলের পায়ে হালকা চোট লেগেছে। শুভঙ্কর দেখতে এলো কতটা চোট লেগেছে। সামান্যই। দু মিনিটেই ঠিক হয়ে যাবে। “তুই যে পড়ে গেলি। জানিস এবার কি হবে?” বাদল প্রশ্নটা ঠিক বুঝলো না। বোকার মতন শুভঙ্করের দিকে তাকিয়ে রইলো। “তুই পড়ে গেলি। আর তোর অপনেন্ট স্ট্রাইকার ফাঁকা জমিতে বল নিয়ে চলে গেলো।”
সেদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত শুভঙ্কর বাদলকে শুধুই ইটের সাথে ড্রিবলিং আর রানিং উইথ দ্যা বল প্র্যাকটিস করালো। যাবার আগে বলে গেলো, সামনে দু তিনদিন সে আসবে না। বাদল যেন মন দিয়ে প্র্যাকটিসগুলি করে। ড্রিবলিং উইথ দ্যা বল, ড্রিবলিং উইদাউট বল, রানিং উইথ দ্যা বল আর সবথেকে যেটা কঠিন, একটাই স্টেপে এক সেকেন্ডের মধ্যে হান্ডরেড এইটটি ডিগ্রী ঘুরে যাওয়া। তারপর বাঁ পায়ের ক্লিয়ারেন্স তো আছেই।
চারদিন পরে শুভঙ্কর এলো। বাদল এই ক’দিন বিকেলে তিনঘণ্টা, মানে রাতের জানুয়ারির সন্ধ্যের অন্ধকারে সাতটা পর্যন্ত প্র্যাকটিস করেছে। বাদল নিজেই বুঝতে পারছে, তার কিছুটা হয়তো উন্নতি হয়েছে। তাঁর সাথে এই কদিনেই বাদলও শুভঙ্করের অনেক কাছাকাছিও চলে এসেছে। কখন যে “শুভ’দা” আপনি থেকে তুমি হয়ে গেছে বাদল নিজেও বুঝতে পারেনি। সেদিন জিমে ফিরবার পথে মনে অনেক সাহস নিয়ে একটা প্রশ্ন করলো “শুভ’দা, একটা প্রশ্ন আছে, কিছু মনে করবে না তো?”
– হ্যাঁ, বল।
– আমি দেখেছি দুটো মেয়ে রোজ বিকেলবেলায় ওই স্টাফ কোয়ার্টারের কাছে দাঁড়িয়ে গল্প করে। ওরা কারা?
শুভঙ্কর দাঁড়িয়ে গেলো। বুঝতে একটুও অসুবিধে হয়নি বাদল কাদের দেখেছে।
– বাদল, তুই ওদের বয়স জানিস?
– হ্যাঁ, এই বারো চোদ্দ হবে।
– তুই এখানে এইজন্য রোজ প্র্যাকটিসে আসিস?
– না না শুভ’দা। একদম নয়। মেয়ে দুটো দেখতে সুন্দর। হলদে সবুজ জামা পড়ে স্কুল যায়। আমার দেখতে ভালো লাগে। তাই জিজ্ঞেস করলাম।
বাদলের এই সরল কথাগুলো শুভ’দার ভালো লাগলো। হেসে জবাব দিলো।
– শোন। ওরা আমাদেরই একজন ডিপার্ট্মেন্ট হেডের দুই মেয়ে। এই ডিপার্ট্মেন্ট হেড কিন্তু খুব কড়া, মনে রাখিস। আর দ্যাখ বাদল, তুই ফুটবল খেলতে এসেছিস, তাই খেল। অন্যদিকে মন দিস না।
বাদলের ইচ্ছে ছিলো অন্তত নামগুলো কি, সেটা জানা যায় কিনা। ভয়ে শুভদাকে আর প্রশ্নই করলো না।
******
ওভালে ফুটবলের বারপোস্ট লেগে গেলো। এবার পুরোদমে ফুটবল হবে। প্রথম দিনেই শুভ’দা কলেজ ফুটবল টিমের ক্যাপ্টেন ফিফথ ইয়ারের মানস রায়ের সাথে বাদলের পরিচয় করিয়ে দিলো। নিজেদের মধ্যে টিম ভাগাভাগি করে রোজ যেমন খেলা হয় আজ তেমনিই হবে। বাদলের প্রথম দিনের খেলা। মুখ চেনাচেনিতেই খেলাটা শেষ হয়ে গেলো। খেলার শেষে শুভ’দা বাদলকে গোলপোস্টের কাছে ডেকে নিয়ে ফার্স্ট ইয়ারের অন্য একটি ছেলেকে ডেকে আনলো। সোমনাথ। সে এখন কর্নার কিক করবে, শুভ’দা ওই কর্নার থেকে হেড দিয়ে গোল করার চেষ্টা করবে, আর বাদলকে তার আগেই স্পটজাম্প করে হেড দিয়ে বল ক্লিয়ার করতে হবে। মাত্র তিনজনের প্র্যাকটিস। সোমনাথ একের পর এক পনেরোটা কর্নার কিক করলো। অনেক চেষ্টা করেও বাদল মাত্র ছ’টা বল হেডে ক্লিয়ার করতে পেরেছে। আর শুভ’দা বাদলকে টপকে হেড দিয়ে সাতখানা গোল করেছে। দুটো বল মিস হয়েছে। শুভ’দা বাদলকে সাবধান করে দিলো “বাদল। পনেরোটা কর্নার কিকে সাতখানা গোল। ভেরি ব্যাড, ভেরি ব্যাড। চলবে না। একদমই চলবে না। ডিফেন্সের প্লেয়ারের স্পটজাম্প না থাকলে টিমে চান্স পাওয়া মুস্কিল হয়ে যাবে।”
বাদল নিজেও বুঝেছে, ভেরি ব্যাড। “কাল থেকে তোর এটাও শিখতে হবে, স্পটজাম্প করে হেড দিয়ে ক্লিয়ারেন্স। ওকে?”
পরের সপ্তাহে ফ্রেশারদের সাথে কলেজ টিমের ওয়েলকাম ম্যাচ। শুভ’দা বাদলকে বলে রেখেছে ওই ম্যাচে বাদলকে ভালো খেলতেই হবে। তার তিনদিন পরে শিবপুর দীনবন্ধু কলেজের সাথে নিজেদের মাঠে ফ্রেন্ডলি ম্যাচ। যদি ফ্রেশারদের ম্যাচে বাদল নজর কাড়তে পারে, তবে দীনবন্ধুর বিরুদ্ধে ওর টিমে ঢোকার একটা ভালো সুযোগ আছে।
সিনিয়রদের সাথে ম্যাচে বাদলের ফ্রেশাররা দু গোলে হেরে গেলো। সিনিয়রদের পাগলা দিলীপ আর উইঙে দেবু’দা বারবার ফ্রেশারদের ডিফেন্স ভেঙ্গে দিয়েছে। তবে দুজন ফ্রেশার সকলের নজর কেড়েছে। রাইট ব্যাকে বাদল আর রাইট উইঙে সোমনাথ। কলেজের প্রোক্টর প্রোফেসর দত্ত জিমের প্রেসিডেন্ট। দেবেশ স্যার বাদলকে আর সোমনাথকে প্রোফেসর দত্তের কাছে নিয়ে গিয়ে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আর ম্যাচের পর শুভদা বাদলকে নিজের হোস্টেলে নিয়ে গেলো। আট নম্বর হোস্টেল। এই নিয়ে দ্বিতীয়বার। বাদলের মনে পড়ে গেলো, প্রথমবার র্যাগিং-এর সময় ওকে এখানে ধরে আনা হয়েছিলো।
শুভদা নিজের রুমে এসে প্রথমেই ব্যারাক থেকে চা আনালো। কলেজের তখনের চ্যাম্পিয়ন সুইমার “দাদা” তুষার ঘোষ বাদলকে দেখেই বলল “তুই আজকে ফ্রেশারদের টিমে দারুন খেলেছিস রে।” বাদলের ভালো লাগলো। স্কুল আর নেতাজী সঙ্ঘের দিনগুলো মনে পড়লো। ভালো খেলে ওখানেও অনেকবার প্রশংসা পেয়েছে। শুভদা বললো “বাদল। তুই আজ সত্যি ভালো খেলেছিস। কি খাবি বল?”
বাদল হঠাৎই আবেগপ্রবণ হয়ে গেলো। কে এই শুভ’দা? কিসের টানে সে গত দশদিন ধরে ওকে ওভালে এত প্র্যাকটিস করাচ্ছে? কেনই বা হোস্টেলে নিয়ে এসে খাওয়াবে? বাদল কি খাবে কি বলবে তার কোনো জবাবই দিতে না পেরে চুপ করে বসে রইলো।
শুভ’দা বাদলের আবেগ বুঝেছে। বললো “বাদল। তোকে সুখবর দি। ক্যাপ্টেন মানস’দার সাথে আমার কথা হয়েছে। বৃহস্পতিবার দীনবন্ধুর এগেন্সটে তুই খেলবি। তবে একটা ব্যাপার আছে।”
বাদল মুখ তুলে তাকালো। “ব্যাপার? কি ব্যাপার?”
– শোন। আমাদের কলেজ টিমে এখন তিন তিনটে রাইট ব্যাক। বাঁদিকে ভালো কেউ নেই। আগে আমি রাইটে খেলতাম। এখন রনেন ওখানে খেলে, রনেন কুন্ডু। তোর দু’বছরের সিনিয়র। আর আমি রাইট ব্যাক থেকে মাঝখানে স্টপারে চলে এসেছি। রনেন ডানদিকে সেট করে গেছে, তাই সরাতে চাইছি না। আমি মানস’দাকে বলেছি তুই লেফট ব্যাকেই খেলবি। আমি বলছি, তুই পারবি।”
বাদল উঠে দাঁড়ালো। “আমি পারবো শুভ’দা, আমি বাদিকেই খেলবো।”
“দ্যাটস হোয়াট আই ওয়ান্ট। আমি জানি তুই পারবি। কিন্তু এই কথাটা আমি সবার মাঝে জিমে বলতে পারছিলাম না, তাই তোকে এখানে আলাদা করে ডেকে এনে বলছি। চল, আমার সাথে আয়।”
শুভ’দা বাদলকে ব্যারাকে নিয়ে এলো। “ধরণী’দা, কি আছে?” জানা গেলো লুচি আছে, আলুর দম আছে। আর আছে কেক, পাউরুটি অমলেট। শুভ’দা বাদলকে পেট ভরে লুচি আলুর দম খাওয়ালো। সাথে ডাবল ডিমের অমলেট। তারপর আবার নিজের ঘরেই ডেকে নিয়ে এলো। “শোন, এবার কাজের কথা শোন। বৃহস্পতিবার ম্যাচ। মানে মাঝে তুই মাত্র দু’দিন সময় পাচ্ছিস। এই দু’দিন তোর শুধু বাঁ পা চলবে। ধরে নিবি তোর ডান পা বলে কিছু নেই। পারবি?”
– পারবো, শুভ’দা। একশোবার পারবো।
– গুড। তবে দেখলাম তুই এখনও হেডে বল ভালো করে ক্লিয়ার করতে পারছিস না। ডিফেন্সে খেলতে হলে ওটাও ইমপ্রুভ করতে হবে। দীনবন্ধু কিন্তু ভালো টিম, খেয়াল রাখতে হবে।
দু’দিন বাদল মনপ্রান দিয়ে শুভ’দার কথামতন প্র্যাকটিস করলো। বৃহস্পতিবারের ম্যাচ বাদলের নার্ভের ম্যাচ, কলেজের জার্সি গায়ে প্রথম ম্যাচ। বাংলাদেশের নেতাজী সঙ্ঘের প্রথম ম্যাচের কথা মনে পড়ছে, এইরকমই নার্ভের টেনশন ছিলো।
খেলার দিন বাদলকে সাপোর্ট দিতে ওর হোস্টেলের অনেকেই মাঠে এসেছে। মেসো, মাসী, পটকা, চন্দন, সেনা, পদু, আরও অনেকে। বাদল দেখছে ওভালের গ্যালারীর পুরোটাই সাপোর্টারে ভরে গেছে, মাঠের সাইড লাইনের ধারেও ওদেরই সাপোর্টার। গোলপোস্টের পিছনে সেই দুটি মেয়েও দাঁড়িয়ে আছে। খেলা দেখতে এসেছে। কয়েকজন প্রফেসরও এসেছেন, মাঠের কোনে চেয়ারে বসে আছেন। এই মেয়ে দুটি, প্রফেসর আর এত সাপোর্টার দেখে বাদলের টেনশন আরও বেড়ে গেলো। টেনশনের ম্যাচে ক্যাপ্টেন মানস’দা আর শুভ’দা খেলবে ডিপ ডিফেন্সে, আর সাইডে একদিকে রনেন’দা আর অন্যদিকে বাদল।
যারা খেলাটা দেখলো, ম্যাচের শেষে সবাই একবাক্যে স্বীকার করলো যে কলেজের ডিফেন্স দুর্ভেদ্য। বাদলরা জিতলো দু গোলে। ওই ম্যাচের শেষে আরও একজন সিনিয়রের সাথে বাদলের পরিচয় হ’লো। ফোর্থ ইয়ারের সুবীর’দা। মিডফিল্ডে খেলে, দারুণ বল কন্ট্রোল, আর ড্রিবলিং। মানে শুভ’দা যার কথা বলেছিলো, আইআইটি বলেছিলো বিই কলেজ ভাড়াটে প্লেয়ার নিয়ে এসেছে।
দিন পনেরো পরে আরও একটা ফ্রেন্ডলি ম্যাচ, এবার কলকাতায় গিয়ে প্রেসিডেন্সী কলেজের সাথে, ওদেরই মাঠে। দুপুরের খাওয়ার পর জিমের ওখান থেকে একটা বাস ছাড়বে। এদিক ওদিক থেকে শুনেছে এই বাসটার নাম নাকি মুড়ির টিন। কলেজের ওয়ার্কশপের বাস, এই বাসের বয়স কেউ জানে না। বাদল এইরকম চেহারার বাস আগে কখনো দেখেও নি। সামনের দিকটা অদ্ভুত রকমের। ভেতরটা সত্যি মুড়ির টিন। একের পর এক কলেজের ছেলেরা ঢুকে যাচ্ছে। চেপেচুপে ঠাসাঠাসি করে জায়গাও করে নিচ্ছে। বাসের ছাদেও অনেকে চড়ে গেলো। সবাই চলেছে নিজের কলেজের সাপোর্টার হয়ে।
বাদল এই প্রথম এক জায়গায় খেলবে যেখানে তার নিজের দলের সাপোর্টার কম, অন্য দলের লোকেরা সংখ্যায় অনেক বেশী। আরও দেখলো প্রেসিডেন্সী কলেজের মেয়েরাও নিজেদের কলেজকে সাপোর্ট করতে এসেছে। বাদল এর আগে মাঠে কখনও এত মেয়ে সাপোর্টার দেখেনি। হটাৎই ওভালের প্যাভিলিয়নের পাশের ওই দুটি মেয়ের কথা মনে পড়ে গেলো। শুভ’দা বারন করে দিয়েছে, কিন্তু বাদল রোজই ওভালে খেলার ফাঁকে ফাঁকে ওই দুজনকে অনেকবার এক ঝলক দেখে নেয়। আজ খেলতে নেমে বাদলের বারে বারেই ওদের কথা মনে পড়ছে। বাদল আজ অন্যমনস্ক, মাঠের খেলায় অত মন নেই। কাউন্টার অ্যাটাকে লাস্ট ডিফেন্স লাইনে পেনাল্টি বক্সের মাথায় বল ওর পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেলো। সামনে একা গোলকিপার দীপেশ’দা। দীপেশ’দার কিছুই করার ছিলো না। মানস’দা, শুভদা দুজনেই লক্ষ্য করলো বাদল ওই সময় বোধহয় অন্যমনস্ক ছিলো, নইলে এইভাবে বাদলের পাশ দিয়ে কখনই বল বেরিয়ে যেতে পারে না। কলেজ প্রেসিডেন্সীর কাছে এক গোলে হেরে গেলো।
ম্যাচের শেষে শুভ’দা আলাদা ডেকে বাদলকে জিজ্ঞেস করলো যে বাদলের ঠিক কি হয়েছিলো? কেন ওইভাবে বলটা পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেলো? “এনি প্রবলেম?” বাদল লজ্জায় মুখ নিচু করে বসে আছে। বাদল বুঝতে পেরেছে ওর কয়েক মুহূর্তের মানসিক অস্থিরতায় কলেজ বাজে গোল খেয়ে হেরে গেলো। মানস’দা, দীপেশ’দা এগিয়ে এসে ওকে তুলে ধরল। “চল, একআধ দিন এরকম সকলেরই হয়। আর তুই তো খারাপ খেলিস নি। সবারই এরকম একআধ দিন হয়।” বাদল কাউকে সত্যি কথাটাও বলতে পারছে না যে ওই অচেনা অজানা দুটি মেয়ের কথা ভাবতে গিয়ে গোল খেয়ে হেরে বসলো।
জুলাই মাসে যখন কলেজের নিজেদের ফুটবল টুর্নামেন্টের সময় এলো, বাদলরা তখন অন্য হোস্টেলে চলে গেছে, বারো নম্বরে। মরসুমের প্রথম টুর্নামেন্ট ইন্টার হোস্টেল। ফার্স্ট ইয়ারের তেরো নম্বর হোস্টেলের সাথে বারো নম্বরের কম্বাইন্ড টিম তৈরি হবে। বারো নম্বরে তখন বেশ কিছু ভালো সিনিয়র প্লেয়ার আছে বিনিময়, শোভন, দেবব্রত। নিজের ইয়ারের আছে তপন। মোটামুটি ব্যালেন্সড টিম তৈরি হয়েছে। প্রথমে একটা সহজ ম্যাচ খেলে জিতে গেলো। এবার ফাইন্যালে চোদ্দ পনেরো নম্বর হস্টেলের কম্বাইন্ড টিমের সাথে খেলতে হবে। চোদ্দ পনেরোর ভালো টিম, চিন্তা রাইট উইঙে সোমনাথকে নিয়ে। অসম্ভব স্পীড ওর। টিমের স্ট্র্যাটেজি ঠিক হলো বাদলকে লেফট সাইড ব্যাকে খেলাবে, সোমনাথকে আটকাতে।
খেলার শুরু থেকেই বাদল সোমনাথকে নজরে রেখেছে। বাদল জানে স্পীডে পারবে না, তাই কড়া নজর আর ট্যাকল করে সোমনাথকে বারবার আটকে দিলো। এভাবে বারবার বাদলের কাছে আটকে গিয়ে শান্ত ঠান্ডা মাথার সোমনাথ হঠাৎই মাথা গরম করে বাদলকে পিছন থেকে বিশ্রী ফাউল করতেই বাদল খোঁড়াতে খোঁড়াতে একদম মাঠের বাইরে। মাঠে উত্তেজনা। নিজেদের মধ্যে খেলায় এরকম বিশ্রী ফাউল কেন হবে? ততক্ষণে সোমনাথ নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। নিজে গিয়ে বাদলকে তুলে ধরলো। বাদল মাঠে ফিরে এলো, মনে সেই একই চ্যালেঞ্জ নিয়ে, সোমনাথকে আটকাতে হবে। সোমনাথ এবার চলে গেলো লেফট উইঙে, আর বাদলও চলে এলো রাইট ব্যাকে, ওর নিজের পছন্দের জায়গায়, সোমনাথকে ব্লক করতে হবে। সেদিন কলেজের ট্র্যাক ইভেন্টের স্প্রিন্টার আর কলেজ ফুটবল টিমের উইংগার সোমনাথকে আটকে দিয়ে, বাদলের বারো তেরো নম্বর হস্টেল এক গোলে জিতে সেদিন ইন্টার হোস্টেল চ্যাম্পিয়ন। আর বাদল ফাইন্যালের বেস্ট প্লেয়ার। বাদল আজ কলেজ জীবনের ফুটবলের চ্যাম্পিয়ন টিমের প্লেয়ার হওয়ার গৌরবের স্বাদ পেলো, সঙ্গে বেস্ট প্লেয়ারের মেডেল।
তবে ইন্টার ইয়ার আর ইন্টার ডিপার্টমেন্টে বাদলরা একদমই সুবিধে করতে পারলো না। ইন্টার ইয়ারে ফোর্থ ইয়ারের পাগলা দিলিপ হটাৎ হটাৎ ঝলসে উঠে বাদলদের ফার্স্ট ইয়ারের ডিফেন্স তছনছ করে দিলো।
শীতকালে বিই কলেজে ইন্টার ইঞ্জিনিয়ারিং উইন্টার মিট। এসেছে যাদবপুর, দুর্গাপুর, জলপাইগুড়ি। কলেজের এখন ছুটি, এই কারণে আইআইটি খড়গপুর আর তারাতলা মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং কথা দিয়েও শেষ সময়ে নাম তুলে নিয়েছে। ফুটবল, হকি, বাস্কেটবল, ভলিবল, ব্যাডমিন্টন, টেনিস, এথলেটিক্স, অনেক ইভেন্টের খেলা হবে। বাদল আছে কলেজের ফুটবল আর বাস্কেটবল টিমে। পঁচিশে ডিসেম্বরের সকালে কলেজের লর্ডস মাঠে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী যাদবপুরের সাথে প্রেস্টিজ ম্যাচ। টুর্নামেন্ট চ্যাম্পিয়ন হওয়া বা না হওয়া বড় কথা নয়, প্রেস্টিজ ম্যাচে যাদবপুরের কাছে ফুটবলে কিছুতেই হারা চলবে না। তাও নিজেদের মাঠে। চ্যালেঞ্জটা ওখানেই।
সেটা ছিলো বড়দিন, ২৫ সে ডিসেম্বর। শীতের সকালে লর্ডস মাঠে প্রচুর ভিড়। শিবপুর যাদবপুরের যে কোনো খেলাতে উত্তেজনার পারদ এমনিতেই চড়ে যায়। শিবপুর জানে প্রতিপক্ষের শক্তি অনেক বেশী। যাদবপুরে কলকাতা সিনিয়র ডিভিশন ফুটবলের তিনজন খেলবে, তারা সকলেই প্লেয়ার’স কোটায় যাদবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে। আর যাদবপুর আজকে প্রচুর সাপোর্টারও এনেছে, এদের সমর্থনে ওরা চায় শিবপুরকে ওদের নিজেদের মাঠেই হারিয়ে ফিরবে। আর শিবপুরও চ্যালেঞ্জ নিয়েছে। নিজেদের মাঠে কিছুতেই হারবে না।
বাদলরা নব্বই মিনিট হাড্ডাহাড্ডি লড়ে গেলো। কলকাতার মোহনবাগান ক্লাবের ফরোয়ার্ড প্রদীপ দত্ত যাদবপুরের হয়ে খেলছে। বাদলের ওপর আজ অতিরিক্ত দায়িত্ব, সে কড়া নজর রেখেছে প্রদীপ দত্তের ওপর। প্রতিটি বলের দখলে কড়া ট্যাকল করছে। কলকাতার মোহনবাগান দলের এক ফরোয়ার্ড এভাবে অখ্যাত বাদলের কাছে বারে বারে আটকে যাবে, এটা যাদবপুর ভাবতেই পারেনি। যাদবপুর যতটা সহজে ম্যাচ বার করে নেবে ভেবেছিলো, সেটা হলো না। ওদিকে রাইট উইঙে সোমনাথের স্পীডের সাথে তাল রাখতে গিয়ে ওদের লেফট ব্যাকের নাজেহাল অবস্থা। পাগলা দিলিপ হটাৎ হটাৎই ঝলসে উঠে যাদবপুরের ডিফেন্স ভেঙে দিচ্ছে। নব্বই মিনিট পরে খেলা গোলশুন্য ড্র। তবে বাদলের সময় নেই। লর্ডস থেকে ওই ফুটবলের ড্রেসেই দৌড়ালো বাস্কেটবল কোর্টে, এখনই জলপাইগুড়ির বিরুদ্ধে নামতে হবে।
******
একটি বছর কেটে গেছে। শুভ’দা এখন বাদলের ভালো বন্ধু। একদিন খেলার পর সন্ধ্যায় ওভালের গ্যালারীতে বসে কথায় কথায় বাদল স্বীকার করলো কেন প্রেসিডেন্সীর সাথে খেলার দিন হটাৎ সে অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলো যার ফলস্বরূপ ওরা গোল খেয়ে এক গোলে হেরে যায়।
শুভ’দা খুব হেসেছিলো। “ওই মেয়েদুটিকে তোর এতো ভালো লাগে? তাহলে গিয়ে আলাপ কর।” বাদলের উত্তর যেন তৈরিই ছিল “তুমিই তো আমায় সাবধান করে দিয়েছ, ওদিকে যেন না যাই।”
– হ্যাঁ। আমি বলেছি, ঠিকই। কিন্তু তুই যে মাঠে নেমে খেলা ভুলে ওদের কথা ভাববি, সেটা আমি তো জানিনা।
– তাহলে?
দুজনেই চুপ। শুভদা খুব হাসছে। বাদলের সারল্য ওর খুব ভালো লাগে।
– আচ্ছা শুভ’দা, ওদের নাম কি?
এবার শুভদা অবাক। বাদল ওদের নাম জানে না, বিশ্বাসই হয়না। কলেজের সবাই ওদের নাম জানে।
– তুই সত্যিই ওদের নামই জানিস না?
– সত্যি বলছি শুভ’দা, আমি ওদের নাম জানিনা। তুমি সাবধান করে দেওয়ার পর আমি কাউকেই ওদের কথা বলিনি। আমার রুমমেটদেরও নয়।
শুভ’দা অবাক। বাদল শুভ’দাকে এতটাই মান্য করে?
– একটা কথা আগে বল, ওদের নাম জেনে তুই কি করবি?
বাদলের কাছে এই প্রশ্নের উত্তর নেই। এটা মনের ভালো লাগার ব্যাপার, যুক্তি তর্কের উর্ধে।
– তুমিও ওদের নাম জানো না শুভ’দা?
– ভালো নামগুলো জানি না রে। সবাই তুলি আর লিলি নামেই ডাকে। তবে কোনটা তুলি আর কোনটা লিলি সে আমিও জানিনা, সে তোদের ইয়ারের মেটু, বা তোদের হোস্টেলের এক বছরের সিনিয়র উত্তম জানবে।
কিন্তু বাদলের দুর্ভাগ্য। মেটুর চেহারা কত সুন্দর! শহরের ছেলে। কত দামী দামী জামাকাপড় পড়ে। যেমনটি মেয়েরা চায়, সেই চেহারা, বা সহুরে আদবকায়দা তো বাদলের জানা নেই।
ঐসব তুলি, লিলি ভুলে গিয়ে বাদল এখন দিনের পর দিন ওভালে খেলার শেষে সন্ধ্যাবেলা একলা একলা প্র্যাকটিস করে নিজেকে অনেক ঘষামাজা করে নিয়েছে। হাওড়ার নামী ফুটবল টিম সহযাত্রী এখন বাদলকে ওদের টিমে নিয়ে ম্যাচ খেলতে যায়।
বাদল ইতিমধ্যে হস্টেল টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন, সেরা প্লেয়ারও হয়েছে। টার্গেট এখন একটাই, এবার সেকেন্ড ইয়ারের নিজেদের ভালো ফুটবলের টিম বানাতে হবে। চ্যাম্পিয়ন হওয়া চাই। এখন তার সাধনা বল কন্ট্রোল, হেডিং, স্পীড, স্পটজাম্প।
তারপর শুধু ইয়ারের বা হস্টেল টুর্নামেন্টের বেস্ট প্লেয়ার নয়, কলেজের বেস্ট প্লেয়ার অফ দ্যা ইয়ারের ট্রফিটাও হাতে নিতে হবে।
*******
ফার্স্ট ইয়ারেই একদম শুরুর দিকে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এসেছে। বাদল দেখে ওভালের অন্যদিকে উলফেনডেন হোস্টেলের সামনে ফ্লাড লাইটের বাস্কেটবল কোর্টে একজন নিজের মনে একা একা বল নেট করার চেষ্টা করছে। আশেপাশে আর কেউ নেই। কলেজে আসার আগে বাদল বাস্কেটবল খেলার ব্যাপারটা জানতোই না, এখনও পর্যন্ত একদিনও খেলেনি। এখানে এসে বাদলের মনে হয়েছে, বাস্কেটবলও তো এক ইন্টারেস্টিং খেলা, একটু চেষ্টা করে দেখলে হয়। এছাড়া আরও একটা কারণ আছে। রাতের অন্ধকারে এরকম ফ্লাড লাইটে খেলা সে আগে দেখেনি। সেই ফ্লাড লাইটের আলোয় খেলারও একটা আকর্ষণ তাকে টানছে।
বাদল বাস্কেটবল কোর্টে গিয়ে দেখে, আরে? এ তো পোলভোল্টের সেই ছোটোখাটো দেখতে সিনিয়র ছেলেটা। বাদল নিজেই গিয়ে একেবারে সোজা পরিষ্কার কথায় জানালো, তার নাম বাদল। ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। বাস্কেটবল সে কোনোদিন খেলেনি, কিন্তু শিখতে চায়। সিনিয়র ছেলেটি হেসে ফেললো। “ঠিক আছে। আমিও এখানে এসেই বাস্কেটবল শিখেছি। আমার নাম সঞ্জয়। সঞ্জয় চক্রবর্তী। ফোর্থ ইয়ার, সিভিল। পনেরো নম্বরে থাকি। আয় দুজনে প্র্যাকটিস করি।” প্রথমদিনে সঞ্জয়দা বাদলকে শুধু বল নেট করা শেখলো। “ধর, তোর হাতে একটা ঢিল আছে, ওটাকে ছোট একটা গর্তে ছুঁড়ে ফেলতে হবে। সেইরকমই ভাব। এইখানে এই নেটের সামনে দাঁড়িয়ে তোর হাতের বলটাকে বিভিন্ন দিক থেকে ছুঁড়ে ওই রিঙের মধ্যে ফেলতে হবে।”
এরপর কয়েকদিন বাদলের রুটিনে পরিবর্তন হয়ে গেলো। বিকেলে ওভালে বুট পরে ফুটবলের প্র্যাকটিস। সন্ধ্যের পর কেডস পরে বাস্কেটবল। সেখানে ফ্লাড লাইটে সঞ্জয়দার সাথে একঘণ্টা মতন প্র্যাকটিস। যতটা সহজ বাদল ভেবেছিলো অতটা নয়। বাস্কেটবলে ষাট মিনিট, মানে এক ঘণ্টা বলের সাথে প্রতিটি প্লেয়ার উঠবে, আবে সেভাবেই নেমে আসবে। নব্বই মিনিট ফুটবলে যতটা দৌড়াতে হয়, বাস্কেটবলের ষাট মিনিটে তার চেয়ে অনেক বেশী দৌড়ে ওঠানামা করতে হয়। দেবেশ স্যার ততদিনে বাদলের দেবেশ’দা হয়ে গেছেন। তিনি চিন্তিত। বাদলকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, “বাদল, আড়াই তিন ঘণ্টা ধরে তুমি রোজ দৌড়াচ্ছ। পারবে তো?” বাদলের উত্তর তৈরি, “হ্যাঁ দেবেশ’দা, আমি এর পরেও আরও একঘণ্টা দৌড়াতে পারবো।” সাতটা নাগাদ সঞ্জয়দা হোস্টেলে ফিরে যায়। যারা ওই রাস্তা দিয়ে যায়, তারা দেখে একটা ছেলে রাত আটটা পর্যন্ত একলা একলা বল নিয়ে বাস্কেট করার চেষ্টা করছে। কোর্টের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে একলাই বল ড্রিবল করতে করতে ছোটাছুটি করছে।
কিছুদিনের মধ্যেই বাস্কেটবলের ইন্টার ইয়ার টুর্নামেন্ট শুরু হয়ে যাবে। কিন্তু বাদলদের টিম নেই। এখনও পর্যন্ত ফার্স্ট ইয়ারের একজনকেও তো কোর্টে দেখল না। হোস্টেলে নিজের ফ্লোরে গিয়ে জানালো, যদি ফার্স্ট ইয়ার ছ’জনের একটা টিমই দিতে না পারে, তবে সেটা ইয়ারের প্রেস্টিজ ইস্যু হয়ে যাবে। পরের দিনই বাদল তাঁর হস্টেলের তপন, বিমল, পটকা, সঞ্জীব মিত্র, উৎপল, দেবব্রত আর সেনাকে ধরে ধরে কোর্টে নিয়ে এলো। সঞ্জীব লম্বায় ছ’ফুটের ওপর, ডিফেন্সে ব্লক করবে। আর সেনা তো নিজেই অবাক যে কেউ তাঁকে মাঠে ডাকবে? বাদলের দু’টো যুক্তি। এক, দু’জন এক্সট্রা প্লেয়ার টিমে রাখতে হয়, আর দুই, সেনা লম্বা। তাই সেনা টিমের অষ্টম প্লেয়ার।
কয়েকদিন ধরে লাগাতার প্র্যাকটিস হলো। বাস্কেট করা, ব্লকিং, ড্রিবলিং, রোলিং, বাউন্স পাসিং, দু হাতের ডাবল ড্রিবলিং, সব কিছুই এদের কাছে নতুন। তবে সঞ্জয়’দার কোচিঙে টিমটা কয়েকদিনের চেষ্টাতেই মোটামুটি দাঁড়িয়ে গেলো। গ্রুপের ফার্স্ট ম্যাচ থার্ড ইয়ারের সাথে। বাদলরা সহজেই জিতে গেলো। পরের ম্যাচটাও। ফাইন্যাল খেলা ফিফথ ইয়ারের বিরুদ্ধে। বাদল, বিমল, তপন ওরা সবাই চার্জড। কলেজের প্রথম টুর্নামেন্ট জেতার দোরগোড়ায়। দু দলই একের পর এক বাস্কেট করছে, কে শেষ পর্যন্ত জিতবে বলা কঠিন। ফিফথ ইয়ারের বিশালদেহি এডওয়ার্ডদা আট গজ দশ গজ দূর থেকে এক একটা বাস্কেট করছে। বাদলের দলে লম্বা সঞ্জীব মিত্রকে বলা হয়েছে এডওয়ার্ডদাকে সবসময় ব্লকে রাখতে, কিন্তু সে তো দুরের জোন থেকেই স্কোর করে চলেছে।
খেলা চলাকালীন থার্ড কোয়ার্টারে ড্রিবল করতে করতে ব্যাল্যান্স রাখতে না পেরে তপন সোজা গিয়ে ধাক্কা খেলো বাস্কেট রিঙের লোহার পিলারে। মাথাটা জোরে ঠুকে গেছে। মাথাটা মাটির দিকে, তপন কোর্টের ঠিক বাইরে ঘাসের ওপর পড়ে আছে। উঠতে পারছে না। সবাই দৌড়ে গিয়ে তপনকে তুললো। তপনের মাথা চুইয়ে রক্ত বেরোচ্ছে। অবস্থা কতটা সিরিয়াস সেটা বোঝা যাচ্ছে না। ওকে ধরাধরি করে ক্যাম্পাসের হাঁসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। মাথা ফেটে গেছে, সটীচ করতে হবে। ওদিকে ম্যাচ চলছে। তপনের এই দুর্ঘটনার খবর কোর্টে পৌঁছে যেতেই বাদলদের খেলার স্পিরিটটাই মেরে দিলো। ফিফথ ইয়ারের কাছে হেরে গিয়ে বাদলরা হলো রানার্স আপ। কলেজের প্রথম টুর্নামেন্টের আনন্দ ওরা কেউ উপভোগ করতে পারলো না।
*******
সেকেন্ড ইয়ারে উঠে বাদলের মনে দুঃখ রয়ে গেছে। ফার্স্ট ইয়ারে ইন্টার ইয়ার, ইন্টার ডিপার্টমেন্ট আর উইন্টার মিট, এই তিনটে টুর্নামেন্টের একটাতেও উইনিং ট্রফি পায়নি। একমাত্র সান্তনা ইন্টার হোস্টেলের চ্যাম্পিয়ন আর বাস্কেটবলের রানার্স। ওর প্রতিজ্ঞ্যা, এবার সেকেন্ড ইয়ারে উইনার্স ট্রফি চাইই চাই।
Add comment