বিই কলেজের হস্টেলের খাওয়া
অসীম দেব, ১৯৭৭ ইলেকট্রনিকস ও টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জনিয়ারিং
না না না আজ রাতেও আর মাংস খুঁজে পেলাম না।
শুনেছি কিলো চারেক মাংস নাকি এসেছে আজ রাতে।
রেঁধেছে ওড়িশার নামকরা সব পাচক কোম্পানি।
তবু যে থালাটি পেলাম আমি শুধুই দেখি ঝোল।
বুঝলে নটবর, শুধুই ঝোল। মাংস তুমিও পেলে না আমিও পেলাম না।
শুধু ঝোল দিয়ে আজ বিশটা রুটি ক্যমেল নামিয়ে দিলে।
আর তোমরা সবাই ঝোলের মাঝে মাংস খুঁজেই গেলে।
(বুঝলে নটবর শুধুই খুঁজে গেলে)
শুধু ঝোল দিয়ে আজ বিশটা রুটি ক্যমেল পেঁদিয়ে দিলে।
সি আর পি, দৈত্য, রঘু তোমরা সবাই মিলে।
হতভাগা এই রাতের ঝোলের কি যে গ্যাঁড়াকল?
বুঝলে নটবর, মাংস তুমিও পেলে না আমিও পেলাম না।
(শুধুই ঝোল, শুধুই ঝোল, মাইরি)
মোরা এই ঝোলেতে ডুবিয়ে রুটি রাতের পেট যে ভরি।
আমরা আবার খাবো এই ঝোলটাই সারা বছর ধরি।
(বুঝলে নটবর সারা বছর ধরে এই ঝোলই খাবো)
ভাগ্যে যে নেই মাংস খাওয়া হায় রে কর্মফল।
বুঝলে নটবর, শুধু হাড্ডি আর হাড্ডি।
মাংস কিছুতেই পেলাম না, তুমিও পেলে না আমিও পেলাম না।
শুধু হাড্ডি আর চর্বি।
শ্যালা, শুধু ঝোল দিয়েই রুটি খাবো।
******
(“বিই কলেজের ডাল” – অতল জলের আহ্বান, সুজাতা চক্রবর্তী, ভুল সবই ভুল – এই গানটি অবলম্বনে)
জল, সবই জল।
এই গামলার হাতায় হাতায় যাই ওঠে সে জল।
জল, সবই জল।
প্রশ্ন করি নিজের কাছে কি খেলাম?
ভাতের সাথে মেখে খেয়ে বড়ই স্বাদ পেলাম।
ওইতো, সবাই ভাবছে যে আজ ডাল খেলাম, সে জল।
পূর্ণদাকে প্রশ্ন করি ডাল কোথায়?
যাই খুঁজি আজ জল ওঠে যে এই হাতায়।
জলের ফাঁকে একটু হলুদ কি দেখায়?
সে জল।
জল, সবই জল।
******
নিয়ম ছিলো, যে মাসে ফোর্থ ইয়ারের ছেলেরা পরীক্ষা দিয়ে ফিফথ ইয়ারের সিঙ্গল সিটেড হোস্টেলে চলে যাবে, সেই শেষের মাসে ফোর্থ ইয়ারেরই কেউ একজন মেস ম্যানেজার হবে। আর অন্যদের আতঙ্ক ছিলো সেই মাসের ম্যানেজার আমাদের এলাহি খাইয়ে পরের মাসে আমাদের জন্য ভালো ডেফিজিট রেখে যাবে। ডেফিজিট সেই মাসে হবে, এটা একটা ট্র্যাডিশন, তবে কমলদাও বুঝতো অনাবশ্যক টাকাপয়সার চাপ ফেলা উচিৎ নয়। ’৭৫ সালের সেই মাসে যাওয়ার আগে কমলদা (মিত্র) আমাদের ১১ নম্বর হস্টেলে সত্যি খুব ভালো খাইয়েছিল, এবং খুব সামান্যই ডেফিজিট হয়েছিলো।
সেই বছর আমারও মেস ম্যানেজার হবার টার্ন এলো। নতুনত্ব কিছু নেই, শুধু প্রতি দিনের মেনু ঠিক করা, খরচের হিসেব রাখা। ইয়ারের নানাজনের নানারকম দাবী। এই মেনু কর, ওই খাওয়া। অথচ খরচ বেশী হলে শুধু ম্যানেজারই গালাগালি খাবে। এইখানটায় একটু সাবধানে ম্যানেজ করতে হতো।
দুটি ঘটনা খুব মনে আছে। শীতকালের বিকেল। আমাদের এগারো নম্বরের হেড ঠাকুর পূর্ণ একদিন বিকেলে এসে আমাকে জোর করে শিবপুর বাজারে নিয়ে গেলো। সপ্তাহের সবজি কিনতে হবে, ওখানে অনেক সস্তায় পাওয়া যায়। অনেক দড়াদড়ির পরে ঠিক হলো আমি একা যাবো না, সঙ্গে মামু আর ব্যাতাই সন্দীপও (কুচবিহার) যাবে। সঙ্গে নেওয়া হলো পাঁচ সাতটা বিরাট বিরাট খালি বস্তা, আর একজন হেল্পার। মুইয়া বা সিরিয়া, এই দুজনের কেউ একজন ছিলো, এখন ঠিক মনে আসছে না।
শিবপুর সবজি বাজারে গিয়ে দেখি আমাদের পূর্ণ ঠাকুরের কি খাতির! বাজারের সব সবজিওয়ালাই ওঁকে চেনে, পূর্ণবাবু পূর্ণবাবু বলে ডাকছে। পূর্ণ ওঁদের সাথে সোজা “তুই” তোকারি করে দড়াদড়ি শুরু করে দিলো। “তোর দোকানের আলু পেঁয়াজ ফুলকপি বাঁধাকপি আরও যা যা আছে, সব কিনে নেবো। কত দাম?” মানে পুরো দোকানের সমস্ত মালই আমরা কিনে নেবো। পূর্ণর কি খাতির কি খাতির, না দেখলে বিশ্বাস হয় না।
মাত্র এক ঘণ্টার মামলা। কয়েকটি দোকানের সব মাল একদম সাফ। আমরা সব কিনে নিলাম। সব আনাজ ফুলকপি, বাঁধাকপি, গাজর, মুলো, আলু, পেঁয়াজ এসব যা পেয়েছি সবই বস্তায় ভরে এক রিক্সায় হয় না; তিন চারটে রিক্সায় মাল চাপিয়ে পূর্ণ আর ওর হেল্পার হোস্টেলে ফিরে গেলো। পরে বুঝলাম, শীতকালে এ এমন কিছু বিরাট ব্যাপার নয়। শীতকালে বাজারে সবজি বেশী ওঠে, হোস্টেলেও এই সময় আমাদের থালায় তরকারীর পরিমান বেশী থাকে। একবস্তা ফুলকপি বা বাঁধাকপি মাত্র দু’দিনের ব্যাপার। সুতরাং পাঁচ বস্তা তরিতরকারি মানে সপ্তাহ খানেকের রসদ।
আরও একটা জিনিষ জানলাম, হোস্টেলে কোয়ালিটি কন্ট্রোল বলে কোনো কিছু নেই। আগেই জানতাম, আমাদের ঠিকাদার কাটিয়াবাবু বাজারের বাছা বাছা পচা মাল প্রতিদিন দিয়ে যান। উনার রোজকারের সাপ্লাই দেওয়া পচা মাছ, জনশ্রুতি যে বেড়ালেও নাকি খায় না। কিন্তু আমরা সানন্দে খেয়ে নিতাম। সুতরাং আমরা বাজারে যাওয়ায় কিছুটা অন্তত টাটকা বাজার হস্টেলে এলো। অবশ্য, টাটকা বা বাসি, আমাদের কোনো ফারাকই পড়তো না। আমাদের ক্যামেল (প্রদীপ ঘোষ), যাই দাও, দিনের বেলায় দেড় থালা ভাত আর রাতে গোটা কুড়ি রুটি অনায়াসে নামিয়ে দিতো।
দ্বিতীয় ঘটনাটি, ইয়ারের জনতা চাইছে, আমার গ্র্যান্ড ফিস্টে এমন কিছু করতে হবে যা অন্যরকম, অন্যদের থেকে আলাদা। মানে লোকে ধন্য ধন্য করবে, সেটাই আমাদের ইচ্ছে। কিন্তু ইচ্ছে থাকলেই তো হবে না, ভালমন্দের একটু মার্কেট রিসার্চ করতে হয়, মার্কেট সার্ভে করতে হয়। ভালো নতুন কিছু করতে চাইলে পয়সাও লাগে। জ্যাঠামশাইয়ের দোকানে গেলাম। একটু অন্যরকম বা বড় সাইজের মিষ্টি চাইলেই দাম বাড়ছে। আমরা, মানে মামু, পিপি, সন্দীপ দত্ত (কুচবিহার) এবং আরও কয়েকজন মিলে ঠিক করলাম কিছু না পেলে কোনো একটা নতুন ব্র্যান্ডের সিগারেট খাইয়েই জনতাকে চমকে দিতে হবে। তখন গ্র্যান্ড ফিস্টের স্ট্যান্ডার্ড সিগারেট মানে ডানহিল, ৫৫৫ স্টেট এক্সপ্রেস, বেনসন হেজেস আর রথম্যান। পয়সা কম থাকলে ইন্ডিয়া কিংস।
ফিস্টের দিনে দুপুরে ক্লাস কেটে আমরা কয়েকজন এসপ্ল্যানেডে সিগারেট খুঁজে বেড়াচ্ছি, নতুন কিছু চাই। বিজাতীয় এবং অজানা নতুন হাই ফাই ব্র্যান্ড খুঁজতে খুঁজতে আমরা একটা সিগারেট পেলাম পার্সোনাল প্রেফারেন্স। এটার নামই কোনোদিন শুনিনি। প্যাকেটটা সুন্দর, মনে হচ্ছে মালটা খারাপ হবে না। ভাবছি একটু স্যাম্পেল টেস্ট যদি করা যায়। কিন্তু ওসব চলবে না। দোকানীর ভাষায়, নগদ কড়ি ফেলে, পুরো প্যাকেট কিনে যত খুশী টেস্ট করো। ওইসব স্যাম্পেল টেস্টিং ফেস্টিং চলবে না। অনেক ভাবনা চিন্তার পরে, রিস্ক নিয়ে ওই পার্সোনাল প্রেফারেন্স ব্র্যান্ডই নিয়ে এলাম। না, গালাগালি খেতে হয়নি। আসলে আমাদের আমলে ফোকোটে বিজাতীয়, বিলাইতি বা মার্কিনী সিগারেট, কিছু একটা হলেই চলতো। যাহা ডানহিল, তাহাই পার্সোনাল প্রেফারেন্স, তাহাই উইলস ফ্লেক।
গ্র্যান্ড ফিস্টে আরও একটা ব্যাপার ছিলো সিগারেট বুকিং। মানে অনেকেই সিগারেট খায় না (কেউ কেউ শুধু গ্র্যান্ড ফিস্টের দিনে ফোকোটে পেয়ে কয়েকটা টান মেরেই ছেড়ে দেয়), তাঁদেরকে এডভান্স লাইন করা হয় “গুরু, তোমার মালটা আমায় দিয়ো”।
– না, অমুকে আগেই বুকিং করে দিয়েছে।
গ্র্যান্ড ফিস্টের দিনে, বা তারও আগে থেকেই সিগারেট বুকিং চালু হয়ে যেতো।
মেসের খাওয়ায় কোনো বৈচিত্র্য নেই। বৈচিত্র্য আনলেও রিস্ক আছে, খরচ বেড়ে যাবে। মে-জুন আর সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে কলেজ ছুটি, মেস তখন বন্ধ। অথচ সেই সময় আমাদের পুরো মাসের রেশন এসে স্টোরে জমা হতো। তাই মে-জুন আর সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের ঠিক পরের মাসে মেসের খরচাও অনেক কম। মেস কমিটির সব মেম্বারই চাইতো সেই জুলাই অথবা শীতের সময় ম্যানেজার হবে। আর কলার তুলে ক্রেডিট নিয়ে যাবে। গরমের সময়ে বাজারে পটল আর ঢ্যাঁড়শ ছাড়া সবজি নেই। সেসময় কেউ ম্যানেজার হতে চাইতো না। সবাই চায় শীতকালে ম্যানেজার হবে। আর এখানে সিনিয়রদেরই দাপট।
যেই ম্যানেজার হোক, ছকে বাঁধা মেনু। শীতের সময় তাও এক্সপেরিমেন্ট করা যায়। নানান রকমের সবজি। আর গরমকালে শুধু পটল আর ঢ্যাঁড়স। অথবা পালং শাক আর লাউ মিশিয়ে লাবড়া। যদি আলু-পোস্ত হয়, তো দুপুরে ক্লাসে গিয়ে ঘুম পাবে। তাই ঘরেই ঘুমিয়ে নাও। খরচ বেশী হয়ে গেলে, মাঝে মধ্যে পেঁয়াজ আর শুকনো লাল লঙ্কা দিয়ে আলুসেদ্ধ মেখে ডালের সাথে খারাপ লাগতো না। কয়েকবার স্বাদ বদলানোর জন্য বেগুনী করা হয়েছে, কিন্তু তেলের খরচ অনেকটাই বেড়ে যায়। সস্তায় একটু অন্যরকম চাইলে রাত্রে আটার লুচি, তাঁর সাথে ছোলার ডাল। ময়দার লুচি হোস্টেলে খেয়েছি বলে মনে পড়ে না। শীতকালে ফুলকপির তরকারি হলে বুঝতেই পারতাম না। পাশ থেকে কেউ বলে না দিলে তো জানতেই পারবো না যে খুঁজলে তরকারীতে একটু ফুলকপির ট্রেস হয়তো পাওয়াও যেতে পারে।
শীতকালে দিনের পর দিন আমরা মুলো খেয়েছি। মুলো সবথেকে সস্তা। খরচের রেশ টানতে আমি নিজেও ম্যানেজার হয়ে মাঝে মাঝেই মুলো খাইয়েছি। তবে সবার দাবী একটাই, একটু খারাপ হলে ক্ষতি নেই, কিন্তু ডেফিজিট যেন না হয়। তাই ভালো মন্দ মিশিয়েই আমরা যা পেতাম খেয়ে নিতাম। গ্যাঁটের পয়সা আর হোস্টেলের খাওয়া, এই দুটিকে বাজেট এবং সামর্থ্য এবং মানসিকতা, এই দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে আমি বলবো আমাদের সময় হোস্টেলের খাওয়া নিয়ে জনতার কোনো অভিযোগ ছিলো না। এগারো নম্বরের ওই বিখ্যাত পাতলা ডাল আর ততোধিক বিখ্যাত মাংসের ঝোল দিয়েই আমার চোখের সামনে ক্যামেল, ব্যান্ডোদা, আরও কতজন পনেরো বিশটা রুটি অনায়াসে মেরে দিতো।
সম্প্রতি বিই কলেজের হোস্টেলের খাওয়ার মানের অনেক উন্নতি হয়েছে। তবে মেসেও এখন প্রচুর বিল ওঠে। যদি ভালো খাওয়া হয়, সেটাই স্বাভাবিক। ষাট সত্তরের দশকে থালায় ফুল চিকেন আমরা ভাবতেই পারতাম না। ফিস্টের রাতেও না। দৈনন্দিন দুপুরে আমাদের বরাদ্দ ছিলো ভাত, ডাল, একটা মাত্র তরকারী আর বিশ্বের ক্ষুদ্রতম একটি মাছের পিস। রাতে রুটি, ডাল, একটা মাত্র তরকারী আর ভাগ্য ভালো থাকলে তিরিশ বা চল্লিশ গ্রাম পাঁঠার মাংস। কিন্তু এখন অনেক পরিবর্তন হয়েছে। হোস্টেলে শুধু তরকারী কেন? মাছ মাংসের পরিমানও যথেষ্ট ভালো। আমরা ষাটের সত্তরের প্রাক্তনীরা কি হোস্টেলের খাওয়ায় সন্তুষ্ট ছিলাম না? মতামত বিভিন্ন্য হতে পারে। কিন্তু যা পেতাম, সেটাই আমরা ন্যায্য মনে করতাম। আর আমাদের ক্যামেল, সিআরপি, ব্যাণ্ডোদা, দৈত্য, কুমার শঙ্কর, এরা ওই বজরা রুটি, ডালের জল, আর পঞ্চাশ গ্রাম মাংস দিয়েই কুড়িটা পঁচিশটা রুটি নামিয়ে দিতো।
প্রতিটা হোস্টেলের ফিস্টে একজন সম্মানিত অতিথি আসতেন, তিনি আমাদের টেলিফোন দাদু। সেই রাতে যদি দশটা হোস্টেলে ফিস্ট হয়, তাহলে তিনি ওই দশটা হোস্টেলের প্রতিটায় যাবেন। এবং উনি আমাদের সকলের থেকে যথাযোগ্য সম্মানও পেতেন, কেউ কোনোদিন ওনার সাথে দুর্ব্যাবহার করে নি। খুবই অমায়িক ছিলেন। হয়তো বলবেন “ডাউনিং থেকে এলাম, ওখানে মাংসটা ভালো করেছিলো। এখানে বেশী কিছু খাবো না, শুধু একপিস মাছ আর একটু দই মিষ্টি দিয়ে দাও।”
– দাদু, ফিস ফ্রাই হয়েছে, খাবেন না?
– ফিস ফ্রাইও করেছো? তাহলে দু’পিস দাও।
– ঠিক আছে, একটু বসুন।
– শোনো, দেরী করো না। আমাকে আবার সাত নম্বর আর দশ নম্বরে যেতে হবে। ওদিকে সেনগুপ্ত, পনেরো আর ষোলো নম্বরেও যেতে হবে। তাড়াতাড়ি দাও।
এই ছিলেন আমাদের টেলিফোন দাদু, বিই কলেজের অজাতশত্রু প্রপিতামহ।
গ্র্যান্ড ফিস্ট মানেই কিছু পাবলিকের সন্ধ্যেবেলার আহ্নিক। এখন জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে দামী ক্রিস্টাল গ্লাসে বরফ দিয়ে সবাই চুমুক দাও। কিন্তু সবার হাতেখড়ি হয়েছিলো হোস্টেলের স্টিলের গ্লাসে, আর বরফের কোনো বালাই ছিলো না। ডাউনিঙ এবং তেরো নম্বর অনেক ছেলের হাতেই স্টিলের গ্লাস ধরিয়েছে, হাতেখড়ি দিয়েছে। সোডা? সে তো বিলাসিতা। কলের জল মিশিয়ে নাও। তখন কি ভেবেছিল পরে ক্রিস্টালের গেলাসে দামী দামী বস্তু খাবে?
দাদাদের সময়ে, মানে ষাটের দশকে শুনেছি, প্রেস্টিজ সিগারেট মানে ফোর স্কোয়ার, এমব্যাসি, রেড অ্যান্ড হোয়াইট, নাম্বার টেন, পানামা, সিজার্স, ক্যাপ্সটেন। আর দৈনন্দিন কাজে সেই চারমিনার। সত্তরের দশকে প্রেস্টিজ সিগারেট উইলস ফ্লেক, আর এমনি সময় সেই চারমিনার। সকালে চারমিনারে দম না দিলে প্রাতঃকৃত্য হতো না। এখন পারবে বউয়ের সামনে চারমিনার ধরাতে?
(Statutory warning: Cigarette smoking is injurious to health)
শীতকালের বিকেল। আমাদের এগারো নম্বরের হেড ঠাকুর পূর্ণ একদিন বিকেলে এসে আমাকে জোর করে শিবপুর বাজারে নিয়ে গেলো। সপ্তাহের সবজি কিনতে হবে, ওখানে অনেক সস্তায় সবকিছু পাওয়া যায়। সঙ্গে নিলাম মামু আর ব্যাতাই সন্দীপকে (কুচবিহার)। নেওয়া হলো পাঁচ সাতটা বিরাট বিরাট খালি বস্তা, আর একজন হেল্পার। মুইয়া বা সিরিয়া, এই দুজনের কেউ একজন ছিলো, এখন ঠিক মনে আসছে না।
শিবপুর সবজি বাজারে গিয়ে দেখি আমাদের পূর্ণ ঠাকুরের কি খাতির! বাজারের সব সবজিওয়ালাই ওঁকে চেনে, পূর্ণবাবু পূর্ণবাবু বলে ডাকছে। পূর্ণ ওঁদের সাথে সোজা “তুই” তোকারি করে দড়াদড়ি শুরু করে দিলো। “তোর দোকানের আলু পেঁয়াজ ফুলকপি বাঁধাকপি আরও যা যা আছে, সব কিনে নেবো। কত দাম?” মানে পুরো দোকানের সমস্ত মালই আমরা কিনে নেবো।
মাত্র এক ঘণ্টার মামলা। কয়েকটি দোকানের সব মাল একদম সাফ। আমরা সব কিনে নিলাম। সব আনাজ ফুলকপি, বাঁধাকপি, গাজর, মুলো, আলু, পেঁয়াজ, আদা, রসুন যা পেয়েছি সবই বস্তায় ভরে এক রিক্সায় হয় না; তিন চারটে রিক্সায় মাল চাপিয়ে পূর্ণ আর ওর হেল্পার হোস্টেলে ফিরে গেলো। পরে বুঝলাম, শীতকালে বাজারে সবজি সস্তা, আর ভ্যারাইটি বেশি। একবস্তা ফুলকপি বা বাঁধাকপি মাত্র দু’দিনের ব্যাপার। সুতরাং পাঁচ বস্তা তরিতরকারি মানে সপ্তাহ খানেকের রসদ।
হোস্টেলে কোয়ালিটি কন্ট্রোল বলে কোনো কিছু ছিলো না। আমাদের ঠিকাদার কাটিয়াবাবু বাজারের বাছা বাছা পচা মাল প্রতিদিন দিয়ে যান। উনার রোজকারের সাপ্লাই দেওয়া পচা মাছ, জনশ্রুতি যে বেড়ালেও নাকি খায় না। কিন্তু আমরা সানন্দে খেয়ে নিতাম। সুতরাং আমরা বাজারে যাওয়ায় কিছুটা টাটকা সবজি বাজার হস্টেলে এলো। অবশ্য, টাটকা বা বাসি, আমাদের কোনো ফারাকই পড়তো না। পূর্ণঠাকুরের হাতের গুণে বুঝতেই পারতাম না, টাটকা না বাসি। আমাদের ক্যামেল (প্রদীপ ঘোষ), ব্যান্ডো’দাকে, যাই দাও, দিনের বেলায় দেড় থালা ভাত আর রাতে গোটা কুড়ি রুটি অনায়াসে নামিয়ে দিতো।
যেই ম্যানেজার হোক, ছকে বাঁধা মেনু। শীতের সময় তাও একটু ভ্যারাইটি পেতাম। গরমকালে শুধু পটল, ঢ্যাঁড়স। অথবা পালংশাক লাউ মিশিয়ে লাবড়া, বা আলু-পোস্ত। আলুসেদ্ধ পেঁয়াজ লঙ্কা মেখে ডালের সাথে খারাপ লাগতো না। স্বাদ বদলানোর জন্য বেগুনী, কিন্তু তেলের খরচ বেড়ে যায়। সস্তায় একটু অন্যরকম চাইলে রাত্রে আটার লুচি, তাঁর সাথে ছোলার ডাল। ময়দার লুচি হোস্টেলে খেয়েছি বলে মনে পড়ে না। শীতকালে ফুলকপির তরকারি হলে বুঝতেই পারতাম না। পাশ থেকে কেউ বলে দিলে জানতে পারতাম যে সেদিন ফুলকপির তরকারি ছিলো।
প্রতিটা হোস্টেলের ফিস্টে একজন সম্মানিত অতিথি আসতেন, তিনি অজাতশত্রু। সকলের বন্ধু, আমাদের টেলিফোন দাদু। উনি আমাদের সকলের থেকে যথাযোগ্য সম্মানও পেতেন, কেউ কোনোদিন ওনার সাথে দুর্ব্যাবহার করে নি।
সেই রাতে যদি সব হোস্টেল মিলিয়ে পাঁচ-সাতটা ফিস্ট হয়, তাহলে তিনি ওই হোস্টেলের প্রতিটায় যাবেন। খুবই অমায়িক ছিলেন। এসে বলবেন “ডাউনিং থেকে এলাম, ওখানে মাংসটা ভালো করেছিলো। এখানে বেশী কিছু খাবো না, শুধু একপিস মাছ আর একটু দই মিষ্টি দিয়ে দাও।”
– দাদু, ফিস ফ্রাই হয়েছে, খাবেন না?
– ফিস ফ্রাইও করেছো? তাহলে দু’পিস দাও।
– ঠিক আছে, একটু বসুন।
– না, না। শোনো, দেরী করো না। আমাকে আবার সাত নম্বর আর দশ নম্বরে যেতে হবে। ওদিকে সেনগুপ্ত, আর ষোলো নম্বরেও যেতে হবে। তাড়াতাড়ি দাও।
এই ছিলেন আমাদের টেলিফোন দাদু, বিই কলেজের অজাতশত্রু প্রপিতামহ।
Add comment