অচেনা ভিয়েতনাম – প্রথম অধ্যায়
@Asim Deb
This book is dedicated to those brave Heroes of Vietnam who fought not for many years, but for decades after decades to save their motherland against invasions and interferences by the Japanese, by the French, by the Americans.
The country was devastated till mid ‘70s by the Americans. So, the series of 4 articles are dedicated to those who are the architects to todays’ Vietnam, building it again from the ashes. And not the least, I dedicate my book to those guerrilla heroes who taught the world how to fight a war of independence, against the world’s richest and most powerful nation.
About the book
The people of Germany and Japan had to rebuild their nation, as they surrendered after the shameful devastating end of the second World War in 1945. In Vietnam too, people had to rebuild their nation, though devastated but not as a consequence of loss, rather that of a glorious victory in their struggle for independence against the United States of America in 1975.
In the last century, Vietnam has primarily been in the news for their guerrilla wars, fighting against the world’s richest and most powerful nation. Amidst this, much has been left unknown about the country, most remarkably about their success in establishing their identity as one of the most progressive countries of the world in the last 50 years.
The people of Vietnam exhibit great pride in preserving their ancient heritages: for example:
** The Temple of Literature dated 1070 AD, dedicated to the great philosopher Confucious,
** Chua Tran Quoc Pagoda dated 548 AD,
** Ha Long Bay, with 1600+ limestone hills in the mid sea, and many of theose having caves as old as 10,000 years,
** Bát Tràng Ceramic Village dated 1010 AD,
** One Pillar Pagoda dated 1049 AD,
** Hanoi Silver Market, 500 years old,
** Cu Chi Tunnel trench, that spans over 75 miles and was used as a shelter and hiding spot for the guerrillas during the war.
The list would be too long for this small sized country. Despite being hit by the tragedies of war, all the landmarks of Vietnamese heritage have been restored, along with institutions like old Pagodas, Churches, Indo-French and Indo-Gothic architectural buildings like offices, opera houses, museums, and also heritage hotels. What attracts is the co existence of both heritage and modern buildings, in adjacent areas.
During our father’s recent visit to Vietnam, he had the opportunity to learn more about their ancient history and heritage, struggle for independence, and evolving international relations, that have created a unique position for the country on the global map. Speaking to the local people, he also got a glimpse of their social and cultural habits, and religious faith. In his article, he tried to curate his experiences to share more about Vietnam, and with this I hope to enlighten his wonderful readers about this beautiful country.
Thanks,
Chandrika and Priyanka (Daughter)
********
লেখকের নিবেদন
প্রথমেই স্বীকার করি, আমি সম্প্রতি ভিয়েতনাম গিয়েছিলাম, কিন্তু যাওয়ার খুব একটা উৎসাহ ছিলো না। ভিয়েতনাম নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় খুব একটা গুণগান দেখি না যতটা সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া এরকম এশিয়ান দেশ নিয়ে দেখি। কিন্তু ভিয়েতনাম গিয়ে আমার ধারণাটাই বদলে গেলো। যে দেশ ১৯৭৫ সালে স্বাধীনতা পেয়ে ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে এসেছে, সেই দেশই অর্থনৈতিক উন্নতিতে এখন সারা দুনিয়ায় আলোড়ন তুলেছে। এগুলো সাধারণ লোকে জানে না।
ভিয়েতনাম সমরাস্ত্রে অত্যন্ত দুর্বল একটি দেশ যাঁদের দীর্ঘিদিন ধরে বহিঃশত্রুর আগ্রাসন থেকে নিজেদের মাতৃভূমিকে রক্ষা করতে হয়েছিল। আমরা শুধু জানি যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক জয় (১৯৭৫), কিন্তু জানি না যে এর আগেও জাপান (১৯৪০), তারপর ফ্রান্স (১৯৪৬), এর আগেও ফ্রান্স (১৮৫৮-১৮৮৫), ও চীনের আধিপত্য রুখতেও তাঁরা যুদ্ধ করেছিল। বাইরের প্ররোচনায় ১৯৭৫ সালের স্বাধীনতার পরেও আরও ১৪ বছর কম্বোডিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ (১৯৭৮- ১৯৯১)। পৃথিবীর ইতিহাসে এরকম দ্বিতীয় উদাহরণ নেই। সায়গন শহরে War Remnants Museum দেখলে এর কিছুটা ধারণা পাওয়া যাবে।
আমি ভিয়েতনাম গিয়ে তার ইতিহাস, স্বাধীনতা যুদ্ধ, রাজনৈতিক পরিবর্তন, এবং ঐতিহ্যময় স্থাপত্য দেখে এই বইতে আমার অভিজ্ঞতার কিছু লিখেছি। বর্ননা করেছি, যেমন ১৪০০ বছরের পুরনো বিশ্ববিদ্যালয় (১০৭০ সালে নির্মিত), স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় গেরিলাদের তৈরি ২৫০ কিলোমিটার বিস্তৃত দোতলা সুরঙ্গ, One Pillar Pagoda (১০৪৯ সালে নির্মিত), Lake of the Restored Sword (১৪২৪ সালে নির্মিত), হ্যানয় সিলভার মার্কেট (৫০০ বছরের পুরনো), আর আছে বহু ইউরোপিয়ন স্থাপত্যের দৃষ্টিনন্দন নিদর্শন যেমন সেন্ট্রাল পোস্ট অফিস, নোতর দাম চার্চ, অপেরা হাউস, অনেকগুলি মিউজিয়াম যেখানে ১০০ থেকে ১০০০ বছরের নিদর্শন সংরক্ষিত আছে। আছে ইন্দো-চিন স্থাপত্যের দর্শনীয় সব প্যাগোডা। হ্যানয় ট্রেন স্ট্রীট, Tết Festival, ফ্লাওয়ার মার্কেট, সেরামিক ভিলেজ, মেকং ডেল্টা, ইত্যাদিরও যথাসম্ভব উল্লেখ করেছি। আর আছে সমুদ্রের মাঝে ১৬০০ পাহাড়ি দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে Ha Long Bay, কিছু দ্বীপে আছে ১০,০০০ বছরের পুরনো গুহা।
আমি আমার “অচেনা ভিয়েতনাম” বইয়ের মাধ্যমে পাঠকদের জানাতে চাই যে, এই দেশটি সত্যিই আমাদের অজানা, ভিয়েতনাম নিয়ে অনেক কিছুই আমাদের জানার আছে। আশা রাখি, পাঠকদের এই বইটি ভালো লাগবে একটা কথা, এখন বাংলা বানানে অনেক নতুন চিন্তাভাবনা এসেছে। এই বইতে আকাদেমি বানান অভিধান অনুসরণ করা হয়েছে।
Acknowledgement:
Internet sites of History.com;
Vietnam Tourism,
History of Vietnam,
Britannica,
Wikipedia,
and few photographs available in internet.
Also, thanks for our good friend Dipayan Lodh, who has made this wonderful cover design.
অচেনা ভিয়েতনাম প্রথম পর্ব
স্কুলে সেভেন এইটে নাইনের সময়ের কথা, ৬৮-৬৯-৭০ ঐসময়ে কলকাতার দেয়ালে দেয়ালে লাল কালিতে দুই পার্টির দেয়াল লিখন দেখতাম। একদল লেখেন তোমার নাম আমার নাম, ভিয়েতনাম, ভিয়েতনাম। আবার লেখেন ভুলতে পারি বাপের নাম, ভুলবো নাকো ভিয়েতনাম। তখন অন্যরা লেখেন চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান। দ্বিতীয় দলের কথা সহজেই বুঝি, যে একদল আদি চীন দেশের লোক। স্বদেশ, মাতৃভূমি, আত্মীয় পরিজন, সবকিছু ত্যাগ করে আমাদের ভারতবর্ষে এসে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করেন। স্বভাবতই তাঁরা চীনের চেয়ারম্যনকে নিজেদের চেয়ারম্যান ভাবেন।
কিন্তু প্রথম দলের ব্যাপারটা কোনদিনই বুঝিনি। কি এমন ব্যাপার যে হঠাৎ করে আমার নাম হয়ে যাবে ভিয়েতনাম? কেন? আমার বাপ-মায়ের দেওয়া নামটা তোমাদের পছন্দ নয়? তার সাথে আমার বাপের নামটাও ভুলে যাবো? তখনই কৌতুহলবশত জানলাম যে ভিয়েতনাম নাকি একটা দেশ। স্কুলের ইতিহাসে আমি যে ভিয়েতনাম পড়িনি সে দস্তুর মনে আছে, কিন্তু সুধীর মাষ্টারমশাই ভূগোলের ক্লাসে এই দেশ পড়িয়েছিলেন কিনা, আজ আর মনে পড়ে না। (অর্ধশতাব্দী আগের সিলেবাস, এখন আর মনে নেই)। আরও একটা ধাঁধা। ভিয়েতনামে মার্কিন কালো হাত ভাঙ্গার জন্য কলকাতার ধর্মতলার রাজপথ জ্যাম করে বাস-ট্রাম ট্যাক্সি কেন বন্ধ হবে? কোন এক মার্কিনী ম্যাকনামারা সাহেব কলকাতায় এলেন, আর এনারা কলকাতার সরকারী ট্রাম বাস পুড়িয়ে দিলেন? এসব তো কিছুতেই মাথায় ঢোকে না। তখন যেসব লোকেরা বড় গলায় বলতেন যে “আমার নাম ভিয়েতনাম”, বা কালো হাত ভেঙে দেওয়ার জন্য রাস্তা জ্যাম করে ট্রামবাসের যাতায়াত বন্ধ করে দিলেন, বা সরকারী বাসে আগুন ধরিয়ে দিলেন, আজও সেই লোকগুলি আমার সেই দিনের সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে পারেন না। এরপরে কলেজে গিয়ে এর ওর থেকে ভিয়েতনাম নিয়ে খানিকটা শুনি। তখন গুগল নেই। সত্য মিথ্যা যাচাই করারও উপায় নেই। বিশ্বাসে মিলায়ে বস্তু।
এবার মাসখানেক আগে আমাদের বাড়িতে আলোচনা হয়, এবার কোথায় বেড়াতে যাই? শোনা গেল যে আজকাল অনেকেই নাকি ভিয়েতনাম ভ্রমণে যায়, তাহলে চলো আমরাও যাই। শুনেই আমার প্রশ্ন। পয়সা খরচ করে পরিবারসহ লালদুর্গের দেশে গিয়ে সর্বহারাদের দেখতে যাবো? রাস্তা জ্যাম করা মিছিল, আর “জোট বাঁধো তৈরি হও” গণসঙ্গীত? তখন সকলেই বলে, আরে না বাবা, একদমই নয়। আমি প্রস্তরযুগের ব্যাকডেটেড, কিছুই খবর রাখি না। ভিয়েতনাম এখন শুধু নামেই কমিউনিস্ট, শুধুই কাগজে কলমে। কমিউনিজম নাকি ওঁরা গঙ্গার জলে, না না, মেকং আর সায়গন নদীর জলে বিসর্জন দিয়ে এখন পুরো ক্যাপিটালিস্ট দেশ। ভিয়েতনামের লোকজন নাকি এখন কালো হাতওয়ালা মার্কিনীদের সাথে প্রচুর বানিজ্য করে। আর কালো হাতগুলো যে ওনারা এখনও ভাঙ্গছেন, এমন খবরও তো টিভি বা খবরের কাগজে পড়ি না!!
অল্পবিদ্যায় গুগল ঘাঁটাঘাঁটি করে যেটুকু বুঝলাম, আপাতত ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট পার্টি CPV দেশটিকে শাসন করে। জনগনের এইখানে নাক গলানোর কোন অধিকার নেই, যদিও জনগনই শক্তির উৎস। এই কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা নিজেরাই নিজেদের রাজা উজির বানায়, আর অন্যান্য রাজনৈতিক ধ্যানধারণার লোকেরা ঘরে বসে আঙ্গুল চোষে, কারণ তোমাদের কার্যকলাপ এখানে নিষিদ্ধ। এই নিষিদ্ধের তালিকায় আছে কোনো ভাষণ সভা সমাবেশ ইত্যাদি চলবে না, ধর্ম ও সংবাদ যা হবে সব সরকারের পছন্দমতন (freedom of association, freedom of speech, freedom of religion, and freedom of the press)। তুমি বিক্ষুব্ধ হতে পারবে না, হলেই সরকারের থাবা। ২০০৯ সালে এখানের আইনজীবী Lê Công Định কে capital crime of subversion এর দায়ে গ্রেপ্তার করলে Amnesty International এনাকে এবং সহকর্মীদের prisoners of conscience আখ্যা দেয়।
একদিকে সাধারণ লোকজন আর অন্যদিকে সরকারি পার্টির লোকজন, কেউ একে অন্যকে ঘাঁটায় না। ঘাঁটালেই সমস্যা। তাই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। সুতরাং কমিউনিজম এখন কোথায় গিয়ে পৌছালো সেটা দেখারও একটা আগ্রহ নিয়ে ভিয়েতনাম যাওয়া যেতেই পারে। অনেক চিন্তা করে রাজিই হলাম।
সিঙ্গাপুর চাঙ্গি এয়ারপোর্ট থেকে ভিয়েতজেট বিমানের দু ঘন্টার সফর শেষে যখন সায়গন এয়ারপোর্টে (IATA: SGN) নামি, তখন হো চি মিন শহরের সময় বেলা আড়াইটা। আগে এই শহরের নাম ছিলো সায়গন, এখন হো চি মিন। সব ফ্লাইটই জমি থেকে আকাশে উঠার সময় বিমানসেবিকারা তাঁদের শারীরিক মুদ্রার নানান কায়দায় স্বাগতম দেখায়। তুমি সিগারেট খাবে না, অক্সিজেন কমে গেলে কি করবে, এমার্জেন্সিতে কি করবো ইত্যাদি, ইত্যাদি অনেক কিছুই বোঝায়। আরে কন্যা, বিপদের সময় অত কি লোকের মনে থাকে? তবু এই কন্যারা রোজ একই কথা বলে, একই মুদ্রা দেখায়। কিন্তু যা উল্লেখযোগ্য, এই কন্যারা শেষে আমাদের একটা স্যালুট দিলেন। এয়ার ইন্ডিয়ার নমস্কার আমার দেখা, অন্যান্য বিদেশী বিমানে শুধু হ্যালো ছাড়া অন্যকিছুর বালাই নেই, কিন্তু এই স্যালুটের ব্যাপারটা আমার কাছে নতুন লাগলো। তারপর সায়গনে বিমান অবতরন করলে মাইক্রোফোনে আরেকদফা ধন্যবাদসহ “আবার হবে তো দেখা, এ দেখাই শেষ দেখা নয়” বলার পরে আবার সেই স্যালুট। বাঃ, বেশ নতুন তো!! কন্যারাও বেশ স্মার্ট, পড়নে টাইট লাল টিশার্ট,আর হাঁটুর একহাত উপরে হাফপ্যান্ট। মাথায় মিলিটারি কায়দার এক টুপি। সর্বদা মুখে হাসি। ভাবি কখন আরেকটা স্যালুট দেবে?
বিমানের পাইলটরা সব বিদেশী, অন্যান্য কর্মীরা স্থানীয় ভিয়েতনামের। বছর কয়েক আগে এই ভিয়েতজেট বিমানের নাম ছিলো বিকিনি এয়ারলাইন্স। এই বিমানসেবিকারা বিকিনিবসনে সজ্জিতা হয়ে মাঝআকাশে আমাদের মতন সাধারণ লোকজনদের পরিষেবা দিতেন। গুগল নেট ছাড়া আমার সেসব ছবি দেখার সুযোগই হয় নি। পরে খোঁজ নিয়ে জানলাম সেই বিশেষ খাতির বহুদিন আগেই ইতিহাসের পাতায় বিদায় নিয়েছেন। এখন শুধুই ঐ টাইট লাল টিশার্ট,আর হাঁটুর একহাত উপরে হাফপ্যান্ট।
কন্যাগুলি বেশ চটপটে। ফ্লাইটে ওঠামাত্র বিনা দরকারেই জানতে চায়, মে আই হেল্প ইউ? ইউর সীট নাম্বার প্লিজ? হাতের ব্যাগ নিজেই মাথার উপরের চেম্বারে রেখে দেয়। প্লেন চালু হলে ট্রেতে ডজনখানেক চায়ের কাপ নিয়ে আসে, “স্যার, উড ইউ লাইক টি ওর কফি?” এঁদের দেখে, সহযাত্রীদের দেখে তো একেবারেই সর্বহারা মনে হয় না।
ভিয়েতনামের অর্থনীতিতে ট্যুরিজম এখন অন্যতম প্রধান আন্তর্জাতিক বানিজ্য। সেইদিক দিয়ে চিন্তা করলে এখানের এয়ারপোর্ট সেরকম আহামরি কিছু নয়, আধুনিক সুযোগসুবিধার অনেক খামতি আছে। ২০০৭ সালে জাপানি অর্থসাহায্যে (Official Development Assistance) চারটি কন্ট্রাক্টরের কনসরটিয়াম KTOM (Kajima, Taisei, Odayashi, আর Maeda) এই এয়ারপোর্ট তৈরির কাজ শুরু করে। ২০১৪ সালে যাত্রীসংখ্যা বেড়ে হয় প্রায় ৯০ লাখ, তখন আরও দুটি নতুন জেট ব্রিজ ছাড়াও টার্মিনালের সম্প্রসারণ এবং আরও কিছু নতুন সুবিধা যোগ হয়, ফলে এই টার্মিনাল এখন বছরে প্রায় সোয়া কোটি যাত্রীর পরিষেবা দেয়, তবে যেটুকু দেখলাম, আমার মতে আন্তর্জাতিক ট্যুরিজমের জন্য এখানে আরও উন্নত মানের সুযোগসুবিধা হওয়া উচিৎ। এবং শুনলাম ভিয়েতনাম সরকার আরও বিদেশী বিনিয়োগ ও বিদেশী ট্যুরিস্টদের জন্য কিছু সম্প্রসারণ পরিকল্পনা করে রেখেছে।
ইমিগ্রেশনে আন্তর্জাতিক যাত্রীদের জন্য এঁরা যথেষ্ট যত্নবান। ডেস্কে বসা প্রত্যেকের গায়ে মিলিটারিদের মতন ইউনিফর্ম। সঙ্গে বন্দুক নেই তো? ভাষার সমস্যা আছে জানি। গন্ডগোল হলে, বা আমাকে অপছন্দ হলে এঁদের ইংরেজি ভাষাও তো বুঝবো না। লাইনে দাঁড়ানো প্রচুর বিদেশী, কিন্তু ইমিগ্রেশন ডেস্কে বসা সামান্য কয়েকজনই ইংরেজি ভাষা জানেন, সকলে নয়, তাহলে? দেখি, এনারা হাতের ইশারায় বুঝিয়ে দেন কি করণীয়। আমাদের ছিলো ই-ভিসা (e-Visa), পাসপোর্টে ভিসা স্ট্যাম্প ছিলো না। ভদ্রলোকের মুখে মাস্ক, আমাদের পাসপোর্টে স্ট্যাম্প দিয়ে হাতের ইশারায় বুঝিয়ে দিলেন, আমাদের সব ঠিক আছে, এবার আগে বড়ো। ভয় ছিলো কোভিডের সার্টিফিকেট নিয়ে ইমিগ্রেশনের দ্বাররক্ষী কর্তারা যদি প্রশ্ন করেন? (২০২১ সালে কোভিডের প্রকোপ অনেকটাই কমে যাওয়ার পরে এনারাও নিয়মকানুন শিথিল করে দিয়েছেন)।
ইমিগ্রেশন পেরিয়ে লাউঞ্জে এসে প্রথমেই যা নজরে আসে, এক, চারিদিকে সব মঙ্গোলিয়ান মুখশ্রী, আর দুই, সবাই ফর্সা ধবধবে। সকলেই বেশ চটপটে, চতুর্দিকে মানুষের কিচির মিচির আওয়াজ। ভালো করে কান পেতে শুনলে এক একটা কথায় মনে হয় দশ দশটা চন্দ্রবিন্দু। যেমন আমাদের হোটেলের ঠিকানা 3C Đ. Tôn Đức Thắng, এবার উচ্চারন করুন।
আসার আগে গুগলে একটা সাবধানবানী দেখেছিলাম
(Airport Arrival Tips), Be aware of pickpockets, elbowing, and shoving when you leave airport terminal
(https://www.itourvn.com/blog/airport-arrival-tips-at-tan-son-nhat-international-airport-ho-chi-minh-city).
কলকাতার মেট্রোর বা বাসের ভীড়ে পকেটমারি হয়, রেল ষ্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ধাক্কাধাক্কি ছিনতাই হয়, তাই বলে ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে Elbowing, and Shoving? কি জানি, অচেনা মহল্লা। দেশের সরকার নিজেই যদি আমাকে সাবধান করে তখন আমাদের সাবধান হওয়াই উচিৎ। চলো, আগে বড়ো।
মালপত্র ছাড়িয়ে এয়ারপোর্টের বাইরে ট্যাক্সির স্ট্যান্ডে এসে দেখি বেশ গরম, আন্দাজ প্রায় ৩৫-৩৬ ডিগ্রীর মতন। হলকা না হলেও ঘামে অস্থির। মেয়ে GRAB ট্যাক্সি ডাকলো। গ্র্যাব মানে আমাদের ওলা উবেরের মতন। জিপিএস দেখালো যে ট্যাক্সি মাত্র ৫০ মিটার দূরে। কিন্তু তখন সেখানে এত প্যাসেঞ্জার আর কেউ ট্রাফিক নিয়ম মানে না, তাই সেই ৫০ মিটার আসতেই ট্যাক্সি সময় নিলো প্রায় মিনিট পনের। ট্যাক্সি ড্রাইভারের নাম বনং। সঠিক উচ্চারণ করতে পারবো না। দেখলাম ছোট ছোট কথায় মোটামুটি কাজ চালানোর ইংরেজি বলে। আমি যেচে ভাব জমানোর চেস্টা করলাম। সে নিজে থেকেই প্রশ্ন করে, “ইনদিয়া?” বলি হ্যাঁ। “ও, বিউতিফুল কানত্রি।“
এয়ারপোর্টের বাইরে কিছু লাল পতাকা, কিছু জায়গায় হো চি মিন সাহেবের ছবি। গতকাল ছিলো পয়লা মে, মানে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। তাঁর আগের দিন ৩০শে এপ্রিল রিইউনিফিকেশন ডে। অনেক ভিয়েতনামী বলেন বিজয় দিবস Victory Day (Ngày Chiến thắng), কেউ বলেন মুক্তিদিবস Liberation Day (Ngày Giải phóng or Ngày Giải phóng miền Nam), অথবা সরকারিভাবে Day of the Liberation of the South and National Reunification (Ngày Giải phóng miền Nam, thống nhất đất nước)।
আমরা এখানে এলাম ১লা মে। ঐতিহাসিক দিক দিয়ে এই দিনটি এখানে গুরুত্বপূর্ণ। এর আগে ১৯৭৫ সালের ২৯শে এপ্রিল আমেরিকানরা এই দেশ থেকে সপরিবারে পালিয়ে যায়, মানে ঐতিহাসিক ১লা মে’র ঠিক দু’দিন আগে। এরপরই ভিয়েতনাম নিজেদের স্বাধীনতা ঘোষণা করে। বিজয় উৎসব হয় পরদিন ৩০শে এপ্রিল, এবং উত্তর-দক্ষিণ ভিয়েতনামের পুনরায় মিলন। সরকারীভাবে ভিয়েতনাম কমিউনিস্ট শাসিত দেশ, সুতরাং ধারণা ছিলো যে বিগত তিনদিনের রাজনৈতিক অনুষ্ঠান ও উদযাপনের কারণে চারদিক হবে লালে লাল। কিন্তু সেরকম কিছুই দেখলাম না। হোটেলে যাওয়ার পথে, ৮ কিলোমিটার রাস্তায় দু’চার জায়গায় আর পথের দু’পাশের কিছু বিল্ডিং এর গায়ে উড়ন্ত লাল পতাকা। ট্যাক্সি ড্রাইভার জানালো যে এগুলি সরকারী দপ্তর। আমার মনে হলো, গত দশ বছরে ভিয়েতনামে কয়েক লক্ষ কোটি ডলারের বিদেশী মুদ্রার আমদানী হয়েছে। তাই, প্রথমেই প্রশ্ন জাগে, ভিয়েতনাম বা সাধারণ লোকেরা এখন ভক্তিভরে কতটা কমিউনিস্ট?
হোটেলে আসার পথে শহরের শুরুতে পুরনো মহল্লায় দুপাশে পুরনো দিনের বাড়িঘর, কিন্তু বড়বাজার, কাশীপুর, দমদমের মতন অযত্ন নেই। পুরনো সায়গন শহরের রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে এনারা খুবই যত্নবান।
সুন্দর সুন্দর রাস্তা, ছোটখাটো ল্যান্ডস্কেপিং। এয়ারপোর্ট ছেড়ে যতই আগে শহরের দিকে চলি, ততই ইটের পাঁজরে লোহার খাঁচায় আধুনিকীকরনের ছাপ সুস্পষ্ট। এক এক করে সামনে আসে উচ্চ উচ্চ আধুনিক সব অট্টালিকা।
আর দেখি চারিদিকে ঝাঁকে ঝাঁকে মোটরসাইকেল, সকলের মুখে মাস্ক। আর ঝকঝকে বিদেশী গাড়ি, ফোর্ড, কিও, টয়োটা, হুন্ডাই। যতই দেখি, লোকজনের পোষাকে সর্বহারার কোন ছাপই নেই। আর দেখি অদ্ভুত এক ধরণের রিক্সা। ছবিতে আগে দেখেছি, এখন চাক্ষুষ দেখলাম। সামনে একজন মাত্র যাত্রী আরাম করে বসতে পারে, আর চালক থাকে পিছনে। দেখে মনে হয় ট্যুরিস্ট, তবে এই গরমে?
যতই শহরের কেন্দ্র, মানে ডিস্ট্রিক্ট ওয়ানের দিকে যাই, আধুনিক জীবনযাত্রার ছাপ স্পষ্ট, সে রাস্তার লোক হোক, বা রাস্তার চেহারা, বা দু’ধারে বাড়িঘর দোকানপাটের চেহারায়। সামনেই দেখি রাস্তার মোড়ে গ্র্যান্ড হোটেল। বাঃ, কলকাতার কথা মনে পড়ে গেলো।
এয়ারপোর্ট মূল শহরের সামান্য বাইরে। শহরের কেন্দ্রে (স্থানীয় লোকেরা বলে ডিস্ট্রিক্ট ওয়ান) যেতে লাগে মোটামুটি ২৫ মিনিট। এয়ারপোর্ট থেকে আমাদের মেরিডিয়ান হোটেল খুব একটা দূরে নয়, মাত্র পৌনে আট কিলোমিটার, সময় নিলো ২৫ মিনিট। মিটারে স্থানীয় মুদ্রায় কত পয়সা শুনলে আমার মতন নাদান লোকজন ভয়ই পাবে, এক লক্ষ ষাট হাজার ভিয়েতনামী ডলার (VND), তখন হিসেব করে দেখি আমাদের ভারতীয় মুদ্রায় ৫৭৬ টাকা। মানে সংখ্যাটা দেড় লাখ থেকে পাঁচ’শ টাকায় নেমে এলো, খানিক শান্তি পেলাম।
সায়গন নদীর ধারেই আমাদের ঠিকানা, লা মেরিডিয়ান হোটেল। আমরা যাকে বলি panoramic views, বেশ সুন্দর, সাথে ছোট একটা ল্যান্ডস্কেপিং। হোটেলের ঠিকানার উচ্চারণ আমাদের আসাধ্য। একজন ভিয়েতনামীকে আমি যদি বলি, ভায়া শুদ্ধভাবে পুণ্ডরীকাক্ষ বলো তো, তাহলে সেও আমাকে হোটেলের ঠিকানা উচ্চারণ করতে বলবে
3C Đ. Tôn Đức Thắng,
Bến Nghé, Quận 1, Thành phố
Hồ Chí Minh, Vietnam
এইসব Tôn Đức Thắng, Bến Nghé, Quận 1, Thành phố ইত্যাদি উচ্চারণের কেরামতির দরকার নেই, হোটেল মেরিডিয়ান বলাই সহজ। সাথে যদি হোটেলের কার্ড থাকে, ফুর্তিতে ঘোরাঘুরি করো, কোন চিন্তা নেই।
মেরিডিয়ান হোটেলের রিসেপশনটি বেশ সুন্দর, আধুনিক। রিসেপশনে মহিলা বলা যাবে না, কমবয়সী কন্যারা আছেন। সকলেরই লাল ইউনিফর্ম। মোটামুটি ইংরেজি বলেন। অভিধানের শব্দগুলি জানেন তবে ব্যাকরণের সমস্যা আছে। ইংরেজি বলা শিখেছেন, নেসফিল্ড সাহেবের গ্রামার বই মনে হয় অধ্যায়ন করেন নি। আমার প্রশ্ন বা বক্তব্য লম্বা হলেই ওনাদের সমস্যা। তাই ছোট ছোট বাক্য দিয়েই বোঝাই। এরপর উত্তরগুলিও চেষ্টা করে বুঝতে হয়। আমাদের চাটগাঁ, তামিল্ বা ভোজপুরী লোকেদের ইংরেজি বলায় যেমন নিজস্ব কিছু টান থাকে, সে এখানেও আছে, ভিয়েতনামী পেটেন্ট করা।
এবার বিশেষ করে আমার প্রধান চিন্তা যে এই ক’দিন খাবো কি? প্রতিবেশী ব্যাংকক, সিঙ্গাপুরে আমার খাওয়ার বেশ সমস্যা ছিলো। যদিও ছোটবেলা থেকেই শুনি যষ্মিন দেশে যদাচার, সেই যস্মিন দেশে আমার স্ত্রী-কন্যার কোন খাদ্যেই অরুচি নেই, কিন্তু আমার দ্বারা তো সেটি হবে না। আসার আগে স্কুলের বন্ধুবর সতীনাথ বলে, ভিয়েতনামের নুডুল স্যুপ খাবি, খুবই ভালো। আরে মিয়াঁ, আমি কলকাতার নুডল স্যুপই খাই না, তো রাখ তোর ভিয়েতনামী স্যুপ! রিসেপশনের কন্যা সুখবরটি দিলেন যে এই হোটেলে আছে latest recipe of global cuisines, আর চোখের সামনেই নাকি ওপেন কিচেন। আরে শিশুকন্যা, আমি তোর global cuisines আর ওপেন কিচেন নিয়ে করবো টা কি? তোর global cuisines এর কারখানায় কি ইন্ডিয়ান ফুড পাবো? আর যদি পাওয়াও যায়, সেটি যে কি পদের যে হবে, সে আমি আন্দাজ করতে পারি। বিপদের আশঙ্কায় আগেই ঠিক করা আছে, কিছু না পেলে আমি তিনবেলাই ব্রেড ওমলেট, বা কলা আপেল দিয়েই চালিয়ে দেবো। সতীনাথের ভিয়েতনামী নুডল স্যুপ কিছুতেই নয়।
কি মনে করে রিসেপশনের কন্যাটিকে প্রশ্ন করেই ফেললাম, এখানে ভারতীয় রেস্তোরাঁ আছে? তাজ্জব ব্যাপার, সে বলে দশ-বারো কিলোমিটারের মধ্যে প্রায় ডজন খানেক ভারতীয় রেস্তোরাঁ আছে। গুগল ঘেঁটে কয়েকটি নাম বলে দিলো যেমন নমস্তে ইন্ডিয়া, তন্দুর ইন্ডিয়া, বেনারস ইন্ডিয়া, গনেশ ইন্ডিয়া, তাজ ইন্ডিয়া, দালচিনি, নটরাজ, আরও আছে। নামগুলো শুনে মনে বড়ই শান্তি পেলাম, কিন্তু এইবার মুসকিল যে কোনটায় যাই? ভেবেছিলাম কিছুই পাবো না, এখন যে দেখি problem of plenty. রিসেপশনের কন্যাটি খবর দিলো, এই হোটেলের পাশেই নাকি ভালো ইন্ডিয়ান রেস্তোরাঁ আছে, দালচিনি। স্ত্রী-কন্যাকে সুখবরটি দিলে ওনারা দয়াপরবশ হয়ে রাজি হলেন যে আজ রাতে দালচিনি অভিযান হবে, কারণ ওনারা চাক্ষুষ করেছেন, গত তিনদিন সিঙ্গাপুরে আমার কি অসহায় অবস্থা হয়েছিলো।
এখন দুপুর শেষ হয়ে বিকেল হবে, বাইরে বেশ গরম, প্রায় ৩৫ ডিগ্রি।
আমার স্ত্রীকন্যা ইতিমধ্যেই খবর নিয়েছেন, এখানের নিউমার্কেট, গড়িয়াহাট, হাতিবাগান অঞ্চলগুলি কোথায়? আজ আর দর্শনীয় স্থানে যাওয়ার সময় নেই, তাই আজ বিকেলে আমাদের যাত্রা নিউমার্কেট, গড়িয়াহাট, হাতিবাগান দর্শনে। নিউমার্কেটের (Ben Thanh Market) দরজা নাকি সন্ধ্যা ছ’টায় বন্ধ হয়ে যায়। সুতরাং আজ সায়গন স্কোয়ার মার্কেট আভিযানে যাবো। মানে আমাদের গড়িয়াহাট, হাতিবাগান। হোটেলের রুমেই চা পর্ব সেরে নিয়ে বেলা প্রায় সাড়ে চারটের সময় ট্যাক্সি ডেকে স্ত্রীকন্যা গড়িয়াহাট, হাতিবাগানে রওয়ানা দিলেন। আমিও সঙ্গে।
রাস্তায় দেখলাম কিছু লাল পতাকা, কিছু কাস্তে হাতুড়ির পতাকা, আর কিছু আছে শুধুই তারা মার্কা পতাকা। মানে আলাদা আলাদা তিন রকমের। একই পতাকায় একসাথে কাস্তে হাতুড়ি তারা নেই। আমাদের বাংলায় তো লাল পতাকায় কাস্তে হাতুড়ি তারা এই তিনটেই থাকে। ভাবি প্রশ্ন করি, ভায়া তোমাদের নেই কেন? আবার মনে হয়, এই প্রশ্ন আমি ইংরাজিতে ট্যাক্সিওয়ালাকে কিভাবে বোঝাই? আর সেই বাঃ আমার প্রশ্ন কতটা বুঝবে? যাই হোক, যা দেখলাম, বিচ্ছিন্নভাবে রাস্তার দু’ধারে সব লাল পতাকা।
যা মনে হলো, গতকাল ছিলো মে দিবস, আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস, সেইজন্য পথের বিভিন্ন জায়গায় ব্যানার ঝুলিয়ে CPV, মানে ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট পার্টি, নিজেদের অস্তিত্ব সাধারণ জনগণকে মনে করিয়ে দিলেন। (পরে এব্যাপারে হোটেলের এক ইংরেজি জানা স্টাফ যা বললেন, তার সারমর্ম যে এনারা CPV-র লালা পতাকায় পাত্তাই দেয় না, এনারা নিজেদের মতন আছেন। আর ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট নেতারাও সাধারণ লোকদের ঘাঁটাতে চায় না)। শান্তিপূর্ণ বোঝাবুঝি ও সহাবস্থান।
যদিও শহরের বর্তমান নাম হো চি মিন, তবে অধিকাংশ বিদেশীই সায়গন বলেন। যেমন সাহেবদের আরও কিছু সময় লাগবে আমাদের ক্যালকাটাকে কলকাতা বলার জন্য। এই সায়গন শহরটি আয়তনে খুবই ছোট। সবকটি গন্তব্যস্থলই কাছাকাছি। হোটেল থেকে ট্যাক্সি নিয়ে ডিস্ট্রিক্ট ওয়ানের রাস্তার দুধারে তাকিয়ে মনে হয় আমাদের পার্ক স্ট্রীট, লিন্ডসে স্ট্রীট, ক্যামাক স্ট্রীট, সেকস্পীয়র সরণী, রাসেল স্ট্রীট, লাউডন স্ট্রীট কলকাতার এইরকম সবকটি সাহেবপাড়া অঞ্চল যোগ করে একটি ক্ষেত্রফল। তবে কলকাতার তুলনায় অনেক ভালো করে সাজানো। দুইপাশের দোকানের লাইনেরও যেন শেষ নেই। তবে এখানে যতগুলি সারি সারি উচ্চ উচ্চ অট্টালিকা রাস্তার দুপাশে সদম্ভে দণ্ডায়মান, কলকাতার সাহেবপাড়ায় বা কোন পাড়াতেই সেটি নেই। এবং কলকাতার সাহেবপাড়ার তুলনায় অনেক পরিস্কার পরিচ্ছন্ন।
সায়গন স্কোয়ার এসে দেখি ব্যাস্ত মার্কেট। এখানেই সায়গন সেন্টার নামের সুউচ্চ শপিং অট্টালিকা, মানে মল, অল্প দামী বেশি দামী শৌখিন সামগ্রীর জায়গা। আর ঠিক উল্টোদিকেই একতলা সায়গন স্কোয়ার মার্কেট, যেখানে দোকানী আপনার কাছে দশ টাকা চাইলে আপনি লজ্জা বিসর্জন দিয়ে পাঁচ টাকা বলবেন। দরাদরি হবে, শেষে বোঝাপড়া করে কেনাকাটাও হবে।
সায়গন স্কোয়ারের মার্কেট একতলা এক ছাদের তলে সব ছোট ছোট দোকান, বড় দোকান একটাও নেই। আর মুখোমুখি সব দোকান, মাঝে বড় জোর ফুট পাঁচেক চওড়া চলার রাস্তা (সরু গলিই বলা ভালো)। দোকানের ভেতরে তো ঢোকার উপায় নেই, সেই সরু গলিপথেই দাঁড়িয়ে সবকিছু, মানে কেনাকাটা, দরাদরি, লেনদেন, ইন্সপেকশন (মানে কাপড়ে ছেঁড়া ফাটা কিনা চেক করা)। সরু আসাযাওয়ার পথে দুইপাশের দোকানে কয়েকজন ক্রেতা একই সময় দাঁড়ালে নিজেদের পশ্চাৎদেশে ঘর্ষনের ভালোই সম্ভাবনা আছে।
আমার স্ত্রী-কন্যা কিছু একটা কিনবেন, কিন্তু কি কিনবেন সে বিষয়ে স্থির কিছু নেই। এক দোকানে জামাকাপড় দেখেন, পরের দোকানে দেখেন ভ্যানিটি ব্যাগ, তারপরের দোকানে গিফট আইটেম। দোকানীরা তো ওয়েলকাম ম্যাডাম, ওয়েলকাম ম্যাডাম সুরে ডাকাডাকি করে। দুই তরফেই ইংরেজি ভাষার আদানপ্রদান, যদিও একজনের কথা অন্যজন সঠিক বোঝে না। আমি ভয়ে সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে। আমার সামনে যদি ব্যাটাছেলেদের টিশার্টের দোকান, তো আমাকে সে টিশার্ট দেখায়। আমি মুখে হাসি এনে বলি, নো থ্যাঙ্কস। দোকানী মনে মনে নিশ্চয়ই বলে, তা বাপু কিনবে না যখন, তা আমার দোকানের সামনে ভীড় বাড়াও ক্যান? মনে মনে হয়তো নিশ্চয়ই গালি দেয়, লজ্জায় মুখে কিছু বলে না। স্ত্রী-কন্যা দোকানের সাজানো জিনিষগুলি দেখে, তারপরই “নো, থ্যাংক ইউ”। এই “নো, থ্যাংক ইউ” কথাটা এখানের ইংরেজি না জানা মূর্খ মানুষজনও বোঝে। প্রায় এক ঘন্টায় যত দোকানের যতরকমের সামগ্রী দেখা হলো, তাঁর ১০০ শতাংশই নো, থ্যাংক ইউ।
অবশেষে একটি দোকানের গিফট আইটেমগুলি আমার স্ত্রী-কন্যার পছন্দ হয়। নানান বৈচিত্র্যের মাঝে একটা ছোট্ট সুন্দর শো’পিস। পাঁচটা চাই। আমি বলি, পাঁচটা??? স্ত্রী হিসেব দেয় মণিমালা, নাগচম্পা, সুতৃপ্তিদি, বিষ্ণুপিয়া, সুরঞ্জনা। মিনিটখানেক পরেই না না, আরও একটা চাই নানী, নানী। সঙ্গে সঙ্গে না না, সাতটা চাই, সাতটা। তা এই সাত নম্বরটা কার জন্য? জানলাম, স্টকে থাকবে যদি ভবিষ্যাতে কোনদিন কোন একজনের নাম মনে পড়ে। আমার প্রশ্ন, আর যদি কোন নাম মনে না আসে? “স্টকে থাকবে।“ দোকানীর সাথে প্রথমে দরাদরি হয়েছিলো দু-তিনখানা নেবো, সেটা হলো পাঁচ, তারপর ছয়, তারপর সাত। সংখ্যা যতই বৃদ্ধি পায়, দরাদরিও ততই বাড়ে। অবশেষে সাতটি একই রকমের শো’পিস কিনে সগর্বে আমরা রওয়ানা দিলাম। একবার ভাবি বলি যে, সাত সাতটি উপহার তোমার সাতজন বান্ধবীর জন্য, আমার বন্ধুরা কি ফ্যালনা?
– “কেন? ওনাদের স্বামীরা কি তোমার বন্ধু নয়?”
কেনা হয়ে গেলো। কয়েকটি দোকানের পরে অন্য দোকানে দেখি হুবহু সেই একই জিনিষ। স্ত্রী-কন্যা ভাবেন, ইসসসসস, হয়তো এই দোকানের দাম আরও সস্তা হতো !!! পরের এক ঘন্টা শুধু মার্কেটের এই গলি আর ঐ গলি। প্রথম রাতে আর বেশি সওদা হলো না, মার্কেট স্টাডি করতেই ঘড়ির কাঁটা রাত আটটার ঘরে।
বাইরে এসে দেখি উল্টাদিকে সায়গন স্কোয়ার সেন্টারে লাইন দিয়ে গাড়ি ঢুকছে। অফিস ফেরতা পয়সাওয়ালা বাবুরা বা বিজনেস ট্যুরিস্টরা ব্রান্ডের জিনিষ কিনবেন। কেউ বা রাতের মোহময়ী রেস্তোরাঁয় যাবেন।
দেখলাম দু’চাকার ভেস্পা ট্যাক্সি আছে। ফোন করলেই চলে আসে। আবার অনেকেই নিজের স্কুটারে অন্যকে লিফট দেয়, পয়সা নিয়েই এই সার্ভিস যদিও অনেক চালকের সেই লাইসেন্স নেই। সেই স্কুটারের চালক ব্যাটাছেলে হতে পারেন, আবার সুন্দরী তরুণীও হতে পারেন। তিনি স্বচ্ছন্দে অপরচিত একজন পুরুষ সওয়ারি তুলে নেবেন, ভয়ের কিছু নেই। আমাদের দেখেই কেউ কেউ ডাকাডাকি করে, লিফত? লিফত? বলি, নো থ্যাঙ্ক ইউ।
এবার আমাদের গন্তব্যস্থল ভিয়েতনামের ভারতীয় রেস্তোরাঁ, নাম দালচিনি। মেয়ে GRAB ট্যাক্সি বুক করে দিলো। মানে আমাদের দেশের ওলা উবেরের মতনই এখানের স্থানীয় টেলিফোন ট্যাক্সি। আসার আগেই কয়েকজন বলে দিয়েছেন, মিটার ট্যাক্সি না নিয়ে যেন GRAB ট্যাক্সি নি, কারণ মিটার ট্যাক্সি এক টাকার রাস্তা শহর ঘুরিয়ে পাঁচ টাকা করে দেয়। GRAB ট্যাক্সি গোলমাল করে না, কারণ কম্পিউটারাইজড। GRAB ট্যাক্সিতে মিনিট দশেকের রাস্তা। দালচিনি রেস্তরাঁয় গিয়ে দেখি আরও কয়েকটি ভারতীয় পরিবার নিজেদের ভাষায় উচ্চনিনাদে গল্পে মশগুল। দূরের টেবিল থেকেও ওনাদের কথাবার্তা শোনা যায়। আর কিছু বিদেশীও আছেন, তাঁরা স্বভাবসিদ্ধ নিচু গলায় বার্তালাপ করছেন। রেস্তোরাঁর এক ভারতীয় কর্মচারী মেনু কার্ড দিলেন। আমাদের দেশীয় কাবাব, তন্দুরি, ভর্তা, কোপ্তা, মসালা চিকেন, বাসমতী চাল, নান, রুটি সবকিছুই আছে। আমার প্রিয় মেনু চিকেন তন্দুরি, চিকেন মসালা আর নান। স্ত্রী-কন্যারও তাই পছন্দ কিন্তু ভ্যারাইটির জন্য অন্যকিছুও নিলাম। স্বাদ? সব আদি ভারতীয় পাচকের হাতের ভারতীয় তেল ঘি মশলার ভারতীয় স্বাদ।
সেখানে একটা নতুন অভিজ্ঞতা। খাওয়ার পরে হাত মোছার জন্য টিস্যু পেপার চাইতেই সার্ভিস বয় একটা ট্রেতে হাতের আঙ্গুলের আংটির সাইজের এক সেন্টিমিটার মতন চওড়া, আর এক সেন্টিমিটার মতন ডায়ামিটার সাইজের কয়েকটা সাদা রোল দিয়ে গেলো। এটি কাগজ না কাপড় কিছুই বুঝলাম না। বহু টানা হেঁচড়া করেও আমরা কিছুতেই রোলগুলোকে খুলতে পারলাম না। রেস্তোরাঁর ছেলেটিকে ডাকতেই সে রোলগুলোকে আমাদেরই পাশে রাখা একটা ছোট্ট বাটিতে জলের মধ্যে ফেলে দিলো। আর আমরা সপরিবারে অবাক হয়ে দেখলাম যে রোলগুলো আস্তে আস্তে খুলে গিয়ে চওড়া হয়ে গেলো। আরে! এ তো নতুন এক প্রোডাক্ট নলেজ! আর তার ব্যাবহারের কায়দাও জানলাম।
এবার হোটেলে ফেরা। ট্যাক্সি নিতে হয়। রেস্তোরাঁর ভারতীয় ছেলেটিকে প্রশ্ন করলাম, ভায়া হোটেল মেরিডিয়ান কত দূরে? সে তো হেসেই ফেলে। মেরিডিয়ান? রেস্তোরাঁর দরজায় এসে দেখিয়ে দিলো, এই যে সামনের বিল্ডিং, এটাই হোটেল মেরিডিয়ান। অচেনা জায়গায় ঈশ্বর সহায়। ট্যাক্সি না করে আমাদের প্রায় পঁচিশ হাজার VND সাশ্রয় হলো। হাঁটাপথে মনে হলো হোটেল আন্দাজ পঞ্চাশ মিটার। রাস্তায় তখন সারি সারি মোটর সাইকেল আর বেশ কিছু গাড়ি। হোটেলের সামনেই সায়গন নদী। রুমে গিয়ে দেখি নদীর পাড় সুন্দরভাবে বাঁধানো, আর প্রচুর আলোয় সাজানো। দূর থেকেই বোঝা যায় যে নদীর পাড়ে প্রচুর লোকজন।
পরে একদিন রাতে সায়গন নদীর পাড়ে গিয়ে দেখেছি ভ্রমণের খুব ভালো ব্যাবস্থা আছে। একটু এগিয়ে গেলেই ছোট একটা জেটিতে বেশ কিছু ছোট বড় ক্রূজ বাঁধা। এনারা বলেন নাইট রিভার বাস। বড় ক্রূজে বিলাসের আয়োজন বেশি। আধুনিক চাহিদার সব ব্যাবস্থাই আছে। নিজের বাজেট বুঝেই লোকেরা ক্রূজ চড়ে। যদি নদীতে সফর করতে ইচ্ছা না হয়, তবে জেটিতে বা সায়গন নদীর পাড়ে উদ্দেশ্যবিহীন হয়ে বসে থাকার জন্যও প্রচুর বসার জায়গা। ওপেন রেস্তোরাঁ, বার, ফাস্ট ফুড, আইসক্রীম পার্লার, মনোরঞ্জনের মোটামুটি চাহিদার বস্তুগুলি সবই আছে। আপনার সঙ্গী বা সঙ্গিনী থাকলে নদীর কিনারায় মায়াবী আলোয় সুন্দর কিছুটা সময় কেটে যাবে।
রাতের সায়গন শহরের মোহময়ী রূপ।
*******
XYZ
Add comment