Asim Deb Writings

তিনকন্যা

তিনকন্যা
@অসীম দেব

প্রথম পর্ব: – নন্দনকন্যা
ভুমিকা: রবীন্দ্রনাথের পোস্টমাস্টার দিনকয়েক আগে আরেকবার পড়ার পর একটা গল্পের আইডিয়া এলো। সেটাই লিখলাম।

*********

বর্ষনসিক্ত শ্রাবণের এক অপরাহ্ণে বাক্স বিছানা সহ ফুটকি গ্রামের বাসায় আসিয়া উপস্থিত হইলাম। আগামীকাল আমার প্রথম চাকুরীর প্রথম দিন। ধানবাদ শহর হইতে সতেরো ক্রোশ দূরে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মনোহরণকারী এই ফুটকি জায়গাটিই এখন আপাতত আমার কর্মক্ষেত্র। অদূরেই একটি সরকারী কয়লাখনি, আমার ঠিকাদার কোম্পানি এখানের কাজে আমাকে নিযুক্ত করিয়াছে। আমার বাসারও বন্দোবস্ত করিয়া দিয়াছে। বাড়িওয়ালা নাই, বাড়িউলি আছেন, দ্বিতল একটি অট্টালিকার দ্বিতলে একেলাই থাকেন। এই চতুর্দিকের অবকাঠামোর পরিসরে আমিই দ্বিতীয় প্রাণী, আমার স্থান গৃহের একতলায়।

ফুটকি আমাদের সাহিত্যের ভাষায় একটি গঞ্জ। লোকালয় বলিতে ষাট সত্তরটি পরিবার এখানে থাকেন। নিকটবর্তী কয়লাখনিতে কেহ বা কর্মরত, আবার কেহ বা অবসরপ্রাপ্ত। আর কিছু আছেন আমার মতন, ঠিকাদার কোম্পানির লোক। সরকারি কোয়ার্টারের সুবিধা এখানে নাই, সুতরাং বাসা ভাড়া নিয়া থাকেন। অদূরেই কতিপয় গাছপালা এবং ঝোপঝাড়ে আবৃত অঞ্চলটিকে লোকজন বলে জঙ্গল। এখানে সোহম নদীটি শ্রাবণের পরিপূর্ণতায় বিকশিত ও প্রকৃতিমাতার নির্জন শৈলপদমূলের সকল উপলরাশি অবজ্ঞা করিয়া সর্পিল পথে সগর্বে নিজের নৃত্যের চঞ্চল পথটুকু নিজেই আবিস্কার করিয়াছে।

আমার মা আমার সঙ্গে আসিয়াছেন, বাড়িউলির সহিত পরিচয় সমাপনান্তে উপসংহারে বিনীত অনুরোধ করিলেন, “দিদি, আমার নুনুবাবু’কে এই অচেনা জায়গায় তোমার হাতে ছেড়ে গেলাম। একটু খেয়াল রেখো দিদি।“
কথাটি বলিয়াই আমার মা’র চেতনা হইলো, এ আমি কি বলিলাম? কিন্তু আমার মায়ের চেতনা ও বাড়িউলির বিস্ময় একই মুহুর্তে উদয় হওয়ায় কারণে আগে বাড়িউলিই প্রশ্ন করিলেন, “নুনুবাবু? এ আবার কিরকম নাম?’
তীরন্দাজের তীর একবার নিক্ষিপ্ত হইলে নিশানায় আঘাত অনিবার্য, ইহার অন্যথা হয় না।
– দিদি, মানে আমি একদম ছোট থেকেই ওকে আদর করে এই নামে ডাকি, তবে একদম আড়ালে। লোকজনের সামনে কখনই নয়। এখন কি যে হলো। তুমি দিদি, এই নামে ডাকবে না, আর কাউকে বলবেও না।
কিন্তু যে বিধাতা চিত্রনাট্য রচনা করিয়াছেন, তাঁহার বাসনা অন্যরূপ। ইতিমধ্যেই রঙ্গমঞ্চে একটি বালিকা প্রবেশ করিয়া সকল সংলাপ শুনিয়াছে।
বালিকাটির নাম দুর্গা। গৌরবর্ণা, সুন্দর মুখশ্রী, কৌতুহলী দুই নয়নে অজানার প্রতি তীব্র অন্বেষণের ইচ্ছা, সুমিষ্ট হাস্যময় ওষ্ঠাধরে সুকোমল সৌন্দর্য, এবং অনাবশ্যক বাহুল্যবর্জিত এক কুসুমকুমারীকে কোনো শিল্পী যেন বহু যত্নে ত্রুটিবিহীন নিখুঁত করিয়া গড়িয়াছেন।

বাড়িউলি পরম স্নেহভরে ডাহিলেন, “দুগগা, আয় এনারা নতুন লোক, এখানেই থাকবেন।“
দুর্গা অত সহজে মানিতে রাজি নয়। এনাদের পরিচয় কী, কোন রাজকার্যে এখানে আসিয়াছেন, ইত্যাদি তথ্যের আগ্রহে সে বিনা ভূমিকায় প্রশ্ন করিল, “কেন? এখানে কেন থাকবে? কী কাজ?”
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনের প্রাচীর অতিক্রম করিবার পুর্বেই আমার বাড়িউলি সংক্ষেপে আমার এখানে থাকার কারণ ব্যাক্ত করিলেন। আমার ধারণা, আপাতত মফস্বলের এই দুর্গা আমার ব্যাক্তিগত বিষয়ে অকারণে আর কৌতুহলী হইবে না।

আমার মা আমাকে বাড়িউলির নিকট গচ্ছিত রাখিয়া ব্যাকুল অস্থির উদ্বিগ্ন মনে ফিরিয়া গিয়াছেন। সন্ধ্যা আগতপ্রায়। আমার চার দেওয়ালের বাহিরে দিবসের রৌদ্র ও মেঘ এখন অবসন্ন। সূর্য যখন বলাকার অন্তরালে অন্তর্ধান করিলেন, আমার একটি দিবসের নাট্যশালার যবনিকা পড়িয়া গেল, আমি কি করিব বুঝিয়া উঠিতে পারি না। একবার ভাবি, রাস্তায় দুই পাক দেখিয়া আসিলে ক্ষতি কি? এমন সময়ে দুয়ারে পায়ের শব্দ শুনিতে পাইলাম। বালিকার আবার আবির্ভাব। এবারে বালিকা কী বিশেষ আবশ্যকে আমার ঘরে আসিয়াছে, আমি অনুমান করিতে পারি না। তাঁহার প্রতাপদীপ্ত ভ্রুকুঞ্চিত চাহনিতে আমার সহিত সখ্যতা করিবার অভিলাষ যে আছে ইহা বালিকাকে দেখিয়া মনে হয় না। মনে হয় সে চাক্ষুষ দেখিতে চায়, আমি এই অচেনা পরিবেশে একাকী কতটা স্বচ্ছন্দ।
“আমার নাম দুর্গা বাড়ুই, তোমার নাম কি?”
অত্যন্ত সহজ প্রশ্ন, উত্তর না দেওয়া খারাপ দেখায়।
– নন্দন।
– শুধু নন্দন? পদবী নেই?
– আছে, গুহ।
– পুরো জবাব একবারে দিতে পারো না?
আরে, বালিকা বলে কি? আমি শ্রীল শ্রীযুক্ত নন্দন গুহ, শহরের সভ্যতায় বিগত পাঁচ পাঁচটি বছর ১২ নং এ কত কাল্পনিক রাজা উজির বধ করিলাম, আমি ইঞ্জিনিয়ার, ইংরেজি পড়িতে পারি, ইংরাজি লিখিতে জানি, এক মাস পরেই হাতে মাহিনার মোটা টাকা আসিবে। আর এই ক্ষুদ্রাকৃতি গ্রাম্য বালিকা আমাকে শাসন করে?
কিন্তু বালিকা ভ্রুক্ষেপহীন।
– রাতে কি খাবে?
বিরক্ত হইয়া উত্তর দিলাম, “টিফিন ক্যারিয়ারে আছে।“
– আর খাবার জল? সেও টিফিন ক্যারিয়ারে ভরা আছে?
সত্যি তো! এত রাজা উজির বধ করিলাম, কিন্তু জীবনধারণে যে পানীয় জলেরও প্রয়োজন, সেকথা তো আমার মনে হয় নাই।
– সকালে কি খেয়ে অফিস যাবে?
– সে অফিসে গিয়ে খেয়ে নেবো।
– মানে? সকালে মুখে কিছু না দিয়েই অফিস যাবে? আর সকালের চা?
– সেও অফিসে।
বালিকা সোরগোল করিয়া বাড়ি মাথায় করিল।
– ও কাকীমা, কাকে ধরে নিয়ে এসেছ? একবার নীচে এসো।

গোলমালের আশংকায় বাড়িউলি আসিলেন।
– কাকীমা, আমি তোমার নতুন লোককে নিয়ে বাজারে যাচ্ছি।
অতঃপর বালিকা সংক্ষেপে তাঁহার কাকীমার নিকট আমার দায়িত্বজ্ঞানহীনতার নিদর্শন পেশ করিল। আমি কলিকাতার শহুরে আদবকায়দার জড়তায় সকলের সাথে মিশিতে পারি না। জলের মাছকে ডাঙায় তুলিলে যেরকম হয়, এইস্থানে এইক্ষণে আমারও দশা সেইরূপ। বাড়িউলির সস্নেহ নির্দেশে আমি বালিকার সহিত বাজারে চলিলাম। আমার চিন্তা, কলেজ বা ১২ নং হস্টেলের পরিচিত সিনিয়র শোভন বা উত্তম বা বিনিময় যদি আমাকে বালিকার সহিত দেখিতে পায়, আমি কী জবাব দিব?

বালিকার সহিত মনিহারি দোকানে আসিলাম। পথমধ্যে সে আরেকটি কঠিন প্রশ্ন করিয়াছে, “মশারী এনেছো?” আমি অত্যন্ত খুশী হইয়া কহিলাম, “হ্যাঁ হ্যাঁ মশারী নিয়ে এসেছি।“ কিন্তু পরবর্তী প্রশ্নে আবার আমি দিশাহারা মূক, “মশারীর দড়ি এনেছো?”

মনিহারী দোকানে আসিয়া বালিকা অর্ডার দিলো, “কাকু, ইনি এখানে নতুন এসেছেন। এনার জন্য কিছু বিস্কুট, কিছু মুড়ি, আর গুড় দাও। মশারী টাঙ্গানোর অনেকটা লম্বা দড়িও দাও।“
দ্রব্যের ক্রয়মূল্য মিটিলে বালিকা দোকানে আবার অর্ডার দিলো, “কাকু, এবার হাটে গিয়ে এনার জন্য জলের কুঁজো, জলের বোতল, আর গেলাস নিয়ে আসবে।“
“আর হ্যাঁ, বিস্কুট এসব রাখার জন্য তিন চারটে প্লাস্টিকের ডাব্বাও নিয়ে আসবে।“

সত্য বলিতে, ইতিপুর্বে বালিকার উপর যতটা ক্রোধ জন্মিয়াছিল বা তাহাকে যতটাই অনাবশ্যক অপাংক্তেয় তুচ্ছ ভাবিয়াছিলাম, এই ক্ষণে তাহাকেই আমার কল্যাণকামী পরম সুহৃদ পরম সহায় মনে হইলো। আমার প্রতি দায়িত্ব পালন করিয়া বালিকা চলিয়া গেলো। আর আমি ঘরে ফিরিয়া বাড়িউলিকে আমার শপিং এর রিপোর্ট দিলাম। এবার উনার কথায় আমি আরও হতবাক। এই বালিকা স্কুলে তাঁর ক্লাসের সেরা ছাত্রী এবং সরকারি মেধাবৃত্তি পায়।

রাতের আহারান্তে বিশ্রামনিরতা এই নীরস ফুটকি গ্রামটি বিপুল তমসার অবগুণ্ঠনে শব্দহীন নিস্তব্ধ হইয়া গেল। অজান্তেই ভাবিলাম, না জানি অপরিচিতা এই বালিকার কোমল হৃদয়খানি আমার প্রতি স্নেহে ও গভীর মমতায় কতটাই উদ্বেলিত।

পূর্বরাতে সামান্য বৃষ্টি হইয়াছে। ক্ষান্তবর্ষণ প্রাতঃকালে এখন কে আমাকে চা দিবে, কেই বা আমাকে স্নানের গরম জল দিবে? অভ্যাসবশত কানু’দার কথা মনে হইলো। ১২ নং এর দিনগুলিতে প্রতি প্রভাতে কানু’দা সহাস্যে চা পরিবেশন করিত। কোনরকমে নিজেকে প্রস্তুত করিয়া গতকালের কয়েকটি বিস্কিট গলাধঃকরণ করিলাম, বালিকা গতকালই দিব্যি দিয়াছে, আমি যেন স্নানান্তে অভুক্ত অবস্থায় দফতরে না যাই। তাঁহার কঠোর আবদার মিশ্রিত প্রত্যাশা ও নির্দেশ উপেক্ষা করিতে পারিলাম না।

ঘরের বাহিরে আসিতেই এক রিক্সাচালক আমাকে ডাকিল, “বাবু আসেন, দুগগা আপনার কথা আমাকে বলে গেছে। আপনি তো এখানের কিছুই চিনেন না, আমিই আপনাকে আপিসে নিয়ে যাবো।“
– দুর্গা কোথায়?
– দুগগা? সে তো ইস্কুল গেছে। বাসে করে অনেক দূর যায়।

এই রিক্সাটি না থাকিলে আমি সেদিন গোলকধাঁধার আবর্তে চক্রাকারে নগর পরিদর্শন করিতাম। দফতরের দরোজায় আসিয়া নিজেকে কেমন যেন সংকুচিত অনুভব করিলাম। রাজা উজির বধ করিবার সেই তেজ যেন আর নাই। একজন উর্দিধারী দ্বিধাগ্রস্তভাবে আমাকে অভ্যর্থনা করিল।
– কাকে চাই? এখনও তো কেউ আসেন নি।
“কাকে চাই?”, এর সদুত্তর আমি নিজেও জানি না। কোম্পানির কাগজ শুধু বলিয়াছে আজ সকালে এখানে আমাকে হাজিরা দিতে হইবে। সেই উর্দিধারীকে আমি যথাবিহিত সন্মানপুর্বক, আমার নিয়োগপত্র দেখাইলাম। উনি কাগজটি দেখিয়া প্রশ্ন করিলেন, “এটা কি?”
আমার আগমনের হেতু সংক্ষেপে ব্যাক্ত করিলে, উনি সামান্য তাচ্ছিল্যপূর্বক বিশ্রামের হেতু আমাকে একটি চেয়ার দিলেন।

খানিক বাদেই একে একে লোকজন আসিতেছেন। আমি কে? কেন আসিয়াছি, বা কাহার প্রতীক্ষায় এখানে প্রহর গুনিতেছি, সে বিষয় জানিতে কেহই আগ্রহী নয়। তখন আমি নিজেই আমার সন্মুখে একজনের নিকট গিয়া আমার আগমনের হেতু বলিলাম। উনি তৎক্ষণাৎ “ওহ, আই সী”, আমাকে ম্যানেজারের নিকট পেশ করিলেন। সেদিনের সেই মুহুর্তটি আমার জীবনে অন্যতম স্মরণীয়; করমর্দন সহ ম্যানেজার কহিলেন, “ওয়েলকাম ট্যু আওয়ার কোম্পানি”। আমি কোম্পানির কয়েকটি ফর্মে নিজের নামধাম লিখিয়া মেটিরিয়াল প্ল্যানিং বিভাগে জয়েন করিলাম। আমি যে কুর্সিতে বসিলাম আত্মসন্মানে আঘাত পাইবার জন্য যথেষ্ট। আর টেবিলের গুণগত মান ১২ নং এর তুলনায় সামান্য কিছুটা উৎকৃষ্ট। আমাকে আমার ম্যানেজার কিছু কাগজ দিলেন, সেটি বর্তমান প্রজেক্টের আংশিক রিপোর্ট। আমি বিজ্ঞের ন্যায় কিছুটা পড়িলাম, কিছুই বুঝিলাম না।

বেলা দ্বিপ্রহরে কখনও কড়িকাঠের পানে, কখনও ঘূর্ণায়মান পাখার দিকে হতাশনয়নে চাহিয়া আছি। বাতায়নপথে চাহিয়া আমার প্রেয়সীর কথা মনে হইলো। ভাবিলাম, একটি পত্র লিখি, আবার ভাবিলাম দফতরে প্রথম দিনেই কাজের সময় প্রেমপত্র লিখিয়া ধরা পড়িলে এক কেলেংকারি হইবে। অথচ হাতে কাজ নাই। কলেজে কাব্যদেবীর ইচ্ছায় দুই-একটা কবিতা লিখিয়া অবুঝ কাব্যরসিক মহলে কিছুটা সম্ভ্রম অর্জন করিয়াছিলাম। দফতরের উর্দিধারী লোকটি বা ম্যানেজার দুইজনেই মনে হয় ভালো লোক, কিন্তু এনারা কেহই আমার কবিতার নায়ক হইবার উপযুক্ত নহে। গতকালের বালিকার কথাও মনে পড়িল। এখন হয়তো সে স্কুল হইতে ফিরিয়া আসিবে, বা হয়তো ইতিমধ্যেই গৃহে আসিয়া মায়ের নিকটি কিছু ন্যায় অন্যায় আবদার করিতেছে। ভাবিলাম প্রথম পরিচয়ের কবিতা লিখি। নিজের ঘড়ি দেখিলাম, দফতরের ছুটির এখনও দুই ঘন্টা বাকি। ভাবিলাম, ১২ নং এর মত এই দফতরে কাজের অবসরে কি অকশন ব্রিজ খেলা হয় না? চিন্তাদেবী এখন আমাকে ভর করিয়াছেন। একের পর এক উদ্ভাবনী আইডিয়া মাথায় আসিতেছে।

অফিস ফেরতা একটি চকোলেটের প্যাকেট কিনিলাম, বালিকার জন্য। মনে ক্ষীণ আশা ছিল, হয়তো সে দুয়ারে আমার প্রতীক্ষায় পল গুনিবে, কিন্তু ত্রিসীমানায় তাঁহাকে পাইলাম না। বিনিময়ে দেখি যে আমার ঘরের দুয়ারে একটি পর্দা, একটি জলপূর্ন মাটির কলস, একটি জলের বোতল, কতিপয় প্লাস্টিকের ডাব্বা, আর পদধূলি মোছার একটি পাপোশ।

সন্ধ্যার কিছু আগে বালিকা যখন আসিল, যদিও দেখিলাম যথেষ্টই গম্ভীর বদন, তবু আজ একবারও মনে হইলো না যে সে বিনা কারণে আমাকে বিরক্ত করিতে আসিয়াছে। সে কিছু বলিবার বা কিছু প্রশ্ন করিবার আগেই আমি চকোলেট বাহির করিয়া দিলাম।
– একটাই এনেছো?
এই অপ্রত্যাশিত প্রশ্নের একটিই উত্তর হয়, কিন্তু আমি চুপ করিয়া তাঁর মুখপানে চাহিয়া রহিলাম। সে প্যাকেট হইতে চকোলেটগুলি দুই ভাগ করিয়া একভাগ আমাকে দিলো, “এই নাও, এর আধা তোমার।“
– আরে না, এটা আমি পুরোটাই তোমার জন্য এনেছি।
সে কিছুই শুনিল না, আমাকে অর্ধভাগ স্বীকার করিতেই হইলো।
– চা খাবে?
কি জবাব দি? মিথ্যা কহিলাম, “না, বিকেলে আমি চা খুব একটা খাই না।“
– কাল রাতের জন্য তো টিফিন ক্যারিয়ার ছিল। আজকে রাতে কি হবে?
এবার হুঁশ হইলো। সারাদিন দফতরে কড়িকাঠ, প্রেমপত্র আর কবিতার চিন্তায় অন্যান্য অতি আবশ্যক ও জাগতিক সমস্যাগুলি আমার তালিকায় স্থানলাভ করিতে পারে নাই।
– প্রশ্ন করবে না, চলো আমার সাথে।
আমিও যেন মন্ত্রমুগ্ধে প্রভাবিত একটি আজ্ঞাবহ যন্ত্রের ন্যায় তাঁহার সাথে চলিলাম।

আমার ঘর হইতে সামান্য দূরেই মাতৃমন্দির। নামেই মন্দির, ছোট একটি কালীমুর্তি আছে। একজন পূজারীও আছেন। মাতৃমন্দিরের সংলগ্ন চালাঘরে সাধারণ একটি ডাল ভাতের হোটেল, অগ্রিম বায়না দিলে মাছ মাংসও পাওয়া যায়।
– ও অনুকূল’দা, এই দ্যাখো, নতুন লোক, এ কিন্তু আমার নিজের লোক। ভালো করে খাওয়াবে। যেন পেট খারাপ না হয়।
অনুকূল’দা নতুন আগন্তুককে এক ঝলক দেখিলেন।
– শোনো, রোজ রাতে ভাত মাছ, আর রবিবার দুপুরে মাংস। আর কাল সকালে ইনি তোমাকে নিজের টিফিন ক্যারিয়ার দিয়ে যাবেন, এখন থেকে তুমি রোজ এনার অফিসে দুপুরের ভাত ডাল তরকারী পৌঁছে দেবে। মাসের বন্দোবস্ত।
কি অদ্ভুত। আমার মনের কথা বালিকা কেমনে জানিলো? এইবার আমার প্রতি বালিকার নির্দেশ, “আর তুমি রোজ সকালে অফিস যাওয়ার পথে এখানে জলখাবার খেয়ে যাবে।“
এতক্ষণে অনুকূল’দা কহিলেন, “বেশ কিছু ব্যাচেলর ছেলে সকালের খাওয়া এখানে খেয়েই অফিস যায়, আপনিও করতে পারেন। আর রাতে এখানেই খেতে চলে আসবেন।“
তৃতীয় পক্ষের এক অপরিপক্ক বালিকার হস্তক্ষেপে দুই পক্ষের দুইটি বিজ্ঞ লোকের মধ্যে যে একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি এত অল্প সময়ে এত সহজেই সম্পূর্ন হইতে পারে, ভাবিতে পারি না। আমার ১২ নং হস্টেলে এইরূপ একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে হইলে তুমুল হট্টগোলের সম্ভাবনা।

ইতিমধ্যে অফিসের কাজের অবসরে আমি আমার প্রেয়সীকে দীর্ঘ একটি পত্র দিয়াছি। তাঁহার বিরহে আমি যে কাঁদিয়া কূল কিনারা পাই না, সেটিও সবিস্তারে বর্ননা করিয়াছি।

অফিসের নিয়ম, কাজে যোগদানের সময় হেলথ সার্টিফিকেট আবশ্যক। সেদিন রবিবার সকাল, আমার ব্লাড রিপোর্ট সহ স্থানীয় চিকিৎসকের নিকট গিয়াছি। এমনসময় বালিকা আসিয়া উপস্থিত, “রাস্তায় যেতে যেতে দেখলাম তুমি এখানে। কি করছো এখানে? অসুখ হয়েছে?”
একবার মনে হইল আবার উপদ্রব করিয়াছে। আবার পরক্ষনেই ভবিলাম, একজন অভিভাবক থাকিলে মন্দ কি?
– কাকু, এই লোকটার কি অসুখ করেছে?
– আরে না দুর্গা, অসুখ কিছু নেই। অফিসের নিয়মে একটা হেলথ সার্টিফিকেট চাই, সেজন্যই এসেছে।
এক মুহুর্ত ভাবিয়া বালিকা আদেশ দিলো, “কাকু, ভালো করে দেখে আমাকে বলো।“
ডাক্তারকাকু সার্টিফিকেট লিখিয়া দিলেন। কোনো রোগ নাই। আমি প্রশ্ন করিলাম, “আপনার ফিস?”
উনি হাসিয়া জবাব দিলেন, “এমনিতে পঁচিশ টাকা, কিন্তু দুর্গার সাথে এলে ফ্রি।“
এবার দুর্গার পালা, আমাকে আদেশ করিলো, “এই পঁচিশ টাকা আমাকে দাও। তোমার এই টাকায় আজ রবিবারে আমার কালু আর মিলিকে মাছ খাওয়াবো। কতদিন যে এঁরা মাছ মাংস খায় না।“
শুনিয়া ডাক্তারবাবু নিজেই পঁচিশ টাকা দিলেন, “তাহলে এই নে, তোর কালু আর মিলির জন্য আমিও দিলাম।“
বাহিরে আসিয়া বালিকাকে প্রশ্ন করিলাম, “কে এই কালু, আর মিলি?”
– এঁরা, এঁরা আমার ছেলে আর মেয়ে।
– মানে?
– মানে দুটি পোষ্য প্রাণী, আমার বাড়ির বাইরে পড়ে থাকে, আমিই ওঁদের মা।
কিছুই বলার নাই। এই বালিকা একসূত্রে গাঁথা একটি বিস্ময়বালিকা। কখনও সে প্রিয় বান্ধবী, কখনও অভিভাবক রূপে তিরস্কার করে, আবার কখনও সে মাতৃরূপিণী।

সেদিন বৈকালে নিজের মনে শরদিন্দুর ঝিন্দের বন্দী পড়িতেছি। শংকর সিংহ রাতের অন্ধকারে একাকী গোপন সুড়ঙ্গপথে রানী কস্তুরীবাই এর দুর্গপ্রাসাদে চলিয়াছেন। রানীর বিশ্বস্ত সহচরী চম্পা তাঁর পথনির্দেশক। মধ্যরজনীর কাহিনীর উত্তেজনা তুঙ্গে। এমন সময় বাস্তব জগতের এক বালিকা আমার অপ্রশস্ত ক্ষুদ্র কক্ষে অবতরণ করিয়া সকৌতুক দৃষ্টি নিক্ষেপ করিল, আর আপন দেহবল্লরীটি লঘু নৃত্যের তরঙ্গে আলোড়িত করিয়া আমারে কহিল, “বলো তো, তোমার জন্য কি এনেছি?”

এক মুহুর্তে শরদিন্দুর শংকর সিংহের দুর্গপ্রাসাদ অভিযান ভুলিয়া নিজের পার্থিব জগতের ফুটকি মফস্বল শহরে নিজের কামরায় ফিরিয়া আসিলাম। মনে হইলো, শরদিন্দুর কস্তুরীবাই এই ক্ষণে কল্যাণীয়া দুর্গার রূপে ধরায় অবতীর্ন হইয়া আমার জন্য চকোলেট উপঢৌকন আনিয়াছেন। কহিলাম, “চকোলেট।“
– আরে? তুমি কি করে জানলে আমি চকোলেট এনেছি?
কৌতুক করিয়া জবাব দিলাম, “ম্যাজিক”।
মুহূর্তমধ্যে হাস্য কটাক্ষ করিয়া “এই নাও” বলিতেই আমি নির্দেশ দিলাম, “আগে দুই ভাগ করো।“

পরদিন সোমবার দ্বিপ্রহরে দফতরের ঠিকানায় প্রেয়সীর পত্র আসিল। প্রেমের অতটা উল্লেখ নাই, প্রবাসে নিঃসঙ্গ জীবনে কি করিতে হইবে এবং কি করিতে হইবে না, তাঁর এক দীর্ঘ তালিকা। সেদিন সন্ধ্যায় ঘরে ফিরিয়া মনে পড়িল, আজ আমার সাপ্তাহিক রিপোর্ট জমা দেওয়ার কথা ছিল।

বালিকা প্রতি সন্ধ্যায় আসে। আজ কোনো কারণে স্কুল হইতে সোজা আমার কাছে আসিয়া উপস্থিত। এবং অন্যদিনের তুলনায় কিছুটা অতিরিক্তই সহাস্যবদনা। কোনরকম ভূমিকা না করিয়াই ঘোষণা করিল, “ক্লাসের রেজাল্ট বেরিয়েছে, আমি ফার্স্ট হয়েছি।“ এই সংবাদে আমার চমৎকৃত হইবার কিছুই নাই। সে প্রতিবারই প্রথম স্থান অধিকার করে, এবারেও করিয়াছে।
– তুমি তো প্রতিবারই ফার্স্ট হও। এ তো নতুন কিছু নয়।
বালিকা হয়তো আশা করে নাই, যে আমি এই সংবাদ জানি। হঠাৎই সহাস্যবদনে গম্ভীরতার কৃষ্ণঘন মেঘের উদয় হইলো। আমি কিছুই বুঝিলাম না।
অতিরিক্ত সময় ব্যয় না করিয়া আমাকে উপদেশ দিল, “একটা সাইকেল কেনো, রোজ রোজ রিক্সার পিছনে এত টাকা খরচ করবে না”।
বালিকা আমার হিতার্থে একটি নায্য উপদেশ দিয়া চলিয়া গেলো।

আমার মনের কথা অন্তর্যামীই জানেন, কিছু অনুধাবন করিতে পারি, অধিকাংশই পারি না। তবু সে আমার কিশোর মনের গভীরে নীরবে নানা অপরূপ অনবদ্য সৌন্দর্যের কল্পনাচিত্র রচনা করিত। বিরাট ধরণীর এক প্রান্তে বিধাতার পরিচালনায় দুটি অপরিনত প্রাণীর খেলাগুলি সামান্য ও কৌলীন্যহীন। সেগুলি আকস্মিক ও ক্ষণিকের, কিন্তু আমার চিত্তে তার প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী। মফস্বল শহরে আমাদের দুই অখ্যাত মনুষ্যের তুচ্ছ তুচ্ছ ক্ষুদ্র ঘটনাগুলি উপসংহারে আমাকে নিরন্তর আন্দোলিত করে। অথচ একটি বালিকার সহিত সেই প্রাত্যাহিক ঘটনাবলীর মধ্যেই আমার সুখের মুকুলে অঙ্কুরিত হইতেছে। কেনই বা সে অকারণ অর্থহীন অভিমান করে, আবার কেনই বা এক একদিন অপরিমিত অজস্র স্নেহধারায় আমাকে আবদ্ধ করিয়া রাখে, আমি কিনারা পাই না। এক-একদিন সে তাহার সমস্ত কল্পনা ভাবনা একত্র করিয়া আমার হিতসাধনে প্রবৃত্ত হয়, আবার কোনোদিন নিজের সকল তেজ একত্র করিয়া আমাকে তিরস্কার করিলে সে নিজেও অনুতাপে দগ্ধ হয়। বিচিত্র এই বালিকা, আমি কিছুতেই চিনিতে পারিলাম না।

কয়দিন পরে মা’র পত্র আসিল, আগামী হেমন্তে আমার বিবাহের প্রস্তুতি করিতেছেন। আমি চিন্তায় পড়িয়া গেলাম। আমার প্রেয়সীর সাথে আমার মনের আদানপ্রদান বিগত প্রায় এক দশকের। আমি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এবার কিভাবে আমি এই সহজ অথচ গুরুতর বিষয়টি সরলপ্রকৃতি বালিকাটিকে বোঝাই? সারারাত ঘুম আসিল না, অথচ বালিকাকে এই সংবাদ দেওয়া একান্তই আবশ্যক।

দেরী করিলাম না। ঘটনাপ্রবাহ প্লাবিত হইবার পূর্বেই আমাকে মুক্ত হইতে হইবে।
পরদিন সন্ধায় বালিকা আসিতেই আমি অত্যন্ত সংকোচে নিবেদন করিলাম, “দুর্গা, তোমাকে কিছু বলার আছে।“
দুর্গা সহজ, স্বাভাবিক। “হ্যাঁ, বলো।“
– না, জানি না, আমি কিভাবে তোমাকে বলি, আর তুমিই বা কিভাবে আমার কথা নেবে, সেটাই আমার ভাবনা।
দুর্গা নাটকীয়ভাবে কহিল, “এমন করছো, যেন তুমি বিয়ে করতে যাচ্ছো?“
আমি কোন উত্তর না দিয়া নতমস্তকে বসিয়া রহিলাম।
বালিকা যেন অসহিষ্ণু, “কি? উত্তর দিচ্ছ না কেন?”
আমি অত্যন্ত সংকোচে কহিলাম, “কিভাবে জানাবো সেটাই জানি না দুর্গা। তুমি হয়তো দুঃখ পাবে, তাই…”
বালিকা ভ্রুকুঞ্চিত করিয়া সবিস্ময়ে কহিল, “আমি দুঃখ পাবো? কেন? কেন? আমি দুঃখ পাবো কেন?”
“আমায় ভুল বুঝো না দুর্গা, আমার মনে হলো তুমি দুঃখ পাবে, তাই … জানি না কিভাবে তোমাকে বোঝাবো।“

বালিকা কয়েকপদ পিছনে গেলো।
“এবার বুঝলাম। তুমি বিয়ে করবে, আর তুমি ভাবলে তোমার বিয়ের খবরে আমি দুঃখ পাবো? এতদিনে এই তুমি আমায় চিনলে?”
আমার মুখে কথা নাই।
“তুমি এখানে নিজের লোকজনদের ছেড়ে একলা থাকো। আমি জানি তুমি সবসময় নিজের মায়ের কথা ভাবো। আর আমি তোমার ভালোর জন্য এত কিছু করি। চেষ্টা করি তোমার মায়ের অভাব কিছুটা মিটিয়ে দিতে। আর সেই তুমি আমাকে চিনতে পারলে না?”
অশ্রসজল নয়নে বালিকা আরও পিছনে চলিয়া গেলো। “তাহলে আমি যাই?”
বালিকা পিছন ফিরিয়া ঘরের দ্বারপ্রান্তে পৌছাইতেই আমি ডাকিলাম, “মা, মা, যেওনা আমার কথা শোনো।“
বালিকা আবার পিছনে ফিরিল, এবার আমার দিকে।
– মা, আমি তোমায় চিনতে পারিনি মা। তুমি থাকো, যেওনা।
বালিকা দুয়ারে স্থির দণ্ডায়মান। আমি আবার ডাকিলাম, “মা।“
বালিকা নিজ হাতের তালুতে অশ্রু মুছিয়া আমার নিকটে আসিল।
– মা, সত্যি তোমায় আমি চিনতে পারিনি। আমার উপর রাগ অভিমান করে চলে যেওনা মা।
বালিকা সামান্য হাসিয়া দুই হাতের আঙ্গুলে আমার দুই গাল টিপিয়া আদর করিল, “মা কি কখনো ছেলের উপর রাগ করে থাকতে পারে?”

এবার সামান্য হাসিয়া বালিকা কৌতুকের স্বরে প্রশ্ন করিল, “তাহলে আমি আমার ছেলেকে কি নামে ডাকাডাকি করবো?”
– কেন আমার যা নাম, সেই নামে।
আবার বালিকার হাসি। “উহু, একদম না।“
– না? তাহলে? কি নামে তুমি আমাকে ডাকবে?
ধীরস্বরে বালিকা কহিল, “নুনুবাবু।“

********

দ্বিতীয় পর্ব: অমৃতকন্যা

কুন্ডু স্পেশাল ট্যুরের অমৃতসর প্যাকেজের জালিয়ানওয়ালানবাগ এক্সপ্রেস ট্রেনে আমার সীট পড়েছে সাইডে যে দুটি বার্থ থাকে তারই একটায়। আর আমার সামনে একটি মেয়ে। আমার ৬৭ বছরের অভিজ্ঞতায় তাঁর বয়সটা আন্দাজ করলাম, বছর কুড়ি একুশ হয়তো হবে।

জালিয়ানওয়ালাবাগ এক্সপ্রেস শিয়ালদহ থেকে ছাড়ে দুপুর একটায়। পরদিন বেলা চারটে নাগাদ আমরা অমৃতসর পৌছাবো। আমাদের দলটা ছোট, আমাকে নিয়ে তেইশ জন। আশেপাশের লোকজন, মানে অল্পবয়সী, মাঝবয়সী, প্রৌড়, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা নানান লোকের ভীড়। কিছু পরিবার একত্রে যাচ্ছেন। চেনা মুখ একটিও চোখে পড়ে না।

ট্রেন ছাড়তেই ট্যুর এজেন্সির এক বাচ্চা ছেলে চা নিয়ে এসে চায়ের সাথে দু’মিনিটের একটা লেকচার দিয়ে সকলের সাথে দাদা, বৌদি, কাকা, কাকিমা, এরকম সম্পর্ক পাতিয়ে নিলো। ছেলেটি চা দিয়ে চলে যাচ্ছিলো, সামনে বসা মেয়েটি আরেকবার চা চাইলো। আমাকে দেখিয়ে ছেলেটিকে বললো, “এই জেঠুকেও দাও“। সুযোগ বুঝে আমিও আরেকবার নিয়ে নিলাম।
– জেঠু, জানো তো, আমার না, ঘন ঘন চা খাওয়ার নেশা হয়ে গেছে। কলেজে বিশ্বাস করবে না জেঠু, আমি দিনে সাত আট বার চা খাই।
এইটুকু সামান্য সময়ের মধ্যেই মেয়েটি আমাকে তাঁর নতুন জেঠু সম্পর্ক বানিয়ে “তুমি” সম্বোধনে চলে এসেছে। সে এমন কিছু নয়, জানতে চাইলাম, তুমি কি করো?
– আমি? জেঠু, আমার নাম কাবেরী। গত বছর বেথুন থেকে সায়েন্স অনার্স নিয়ে পাশ করেছি। এখন রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের জুনিওর লাইব্রেরিয়ান। অনেকদিনের অমৃতসর দেখার ইচ্ছে, তাই চারদিনের অফিস ছুটি নিয়ে যাচ্ছি।
এবার আমার প্রতি তাঁর প্রশ্ন, “তুমি কি করো জেঠু?”
– আমি? আমি ছিলাম সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, এখন রিটায়ার করে ভ্যারান্ডা ভেজে দিন কাটাই।
প্রশ্ন করলাম, “আমি তোমার কাকু না হয়ে জেঠু কেন?”
– কারণ সত্তর হলে দাদু, আর ষাট-সত্তরের মাঝখানে সবাই জেঠু।
– অঅঅ, তা তুমি আমার বয়স জানলে কি করে?
– কেন? ট্রেনে ওঠার আগে আমার কো-প্যাসেঞ্জারের নাম আর বয়স দেখে নিয়েছি।
এরপর আমার আর কিছুই বলার নেই।

দুপুর তিনটে নাগাদ আমরা হাল্কা স্ন্যাক্স পেলাম। সঙ্গে চা। কাবেরী এবারও দুবার চা নিলো। আমি হাসছি দেখে কপট রাগে বলে উঠলো, “ওরকম হাসবে না কিন্তু জেঠু, ভালো হবে না”।
বাব্বা, এই মেয়ে যে অচেনা অজানা বয়স্ক লোককেও ধমক দেয়!!

পাঁচটা নাগাদ ধানবাদ স্টেশনে ট্রেন দাঁড়াতেই “জেঠু, একবার এসো, এসো” বলে প্রায় টানতে টানতে আমাকে প্ল্যাটফর্মে নামিয়ে আনলো। কি ব্যাপার? বললাম, “আরে এখানে তো মাত্র পাঁচ মিনিট থামে।“ কিন্তু সে আমার কথা শুনলে তো!
– আরে জেঠু, ধানবাদের চা ভারত বিখ্যাত। দু’এক ভাঁড় খেতেই হবে। রাস্তায় যদি চা না খাই, তবে কিসের ট্রেন জার্নি জেঠু?
সামনের স্টল থেকে নিজের জন্য চা কিনলো, আমাকেও দিলো। আমি পয়সা দিতে গেলে হাঁ হাঁ করে উঠলো।
– জেঠু, তুমি এখন রিটায়ার্ড। আর আমি যখন চাকরী করি, চায়ের পয়সা আমাকেই দিতে দাও। ঠিক আছে? এগ্রিড?
আরে? আমায় তো কিছু বলার সুযোগই দিলো না। বললাম, “খুব মজা পেয়েছিস, না?”
নিজের অজান্তেই আমার “তুই” সম্বোধনটা বেরিয়ে এলো।
ট্রেনে উঠেই প্রশ্ন করলো, “জেঠু, তিন’শ সেকেন্ড মানে কত বলো তো?”
বললাম, “পাঁচ মিনিট।“
– হ্যাঁ, পাঁচ মিনিট, এই সময়ে দু’বার চা খাওয়া হয়ে যায়।
আমি আর কথা বাড়ালাম না।
এরপর গয়ায় একবার, আরেকবার গোমো স্টেশনে নেমে সে চা খেলো। যদিও দু’চার মিনিটের স্টপ, তবুও দু’বারই আমাকেও নামতে হলো।

মেয়েটি সুন্দর কথা বলে, নানান বিষয়ে উৎসাহ আছে। নিজেই জানালো, “আমার লাইব্রেরিতে সায়েন্স ছাড়াও অনেক রকমের ম্যাগাজিন আসে, আমি সবগুলো পড়ি। ছোটবেলার থেকেই আমার জেনারেল নলেজের উৎসাহ, সেটাই ধরে রেখেছি।“

বলতে বলতে শোন নদী এসে গেলো। ব্রীজ পেরোবার সময় আমাকে প্রশ্ন করে বসলো, “জেঠু, তুমি তো নিশ্চয়ই জানো, এই শোন নদীর ব্রীজ ভারতের সবথেকে লম্বা রেলব্রীজ?’
আমি যেন সব জানি, সেরকমই জবাব দিলাম, “সেটা একটা বাচ্চা ছেলেও জানে। “
আমার উত্তর শুনে সে খানিক নাটকীয় ভাবে জবাব দিলো, “তাহলে জেঠু, তুমি যেমন কিস্যুই জানো না, তোমার বাচ্চা ছেলেও কিসসু জানে না।“
– মানে?
কাবেরী এবার কিছুই বলে না, চুপ করে মুচকি মুচকি হেসে মজা নিতে থাকলো।
– আচ্ছা জেঠু, ধরে নিলাম এটা বাচ্চা ছেলেরাও জানে। তুমি তো বললে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। বলো তো এই রেলব্রীজটা, যার উপর দিয়ে আমরা এখন যাচ্ছি, সেটা কত লম্বা? না জানলে আন্দাজেই বলো, চান্স দিচ্ছি।
আমি চুপ করে আছি, কারণ আন্দাজেও এর উত্তর আমি দিতে পারবো না।
– সুতরাং, এক, তুমি ভুল জানো, আর দুই, যেটুকুই বা জানো, সেটাও আদ্ধেক জানো।
– মানে?
– মানে, এক, এই ব্রীজ তিন কিলোমিটার লম্বা। সেটা তুমি জানো না, শুধু জানো বিশাল লম্বা একটা ব্রীজ। তাই বলছি আদ্ধেক জানো। আর দুই, যেটা ভুল জানো, সেটা এই যে ভারতের সবথেকে লম্বা ব্রীজ এখন ভেম্বানাদ রেল ব্রীজ।

মেয়ে তো ঠিকই বলছে, কোথায় যেন পড়েছিলাম, সাউথ ইন্ডিয়ায় একটা নতুন ব্রীজ হয়েছে, এখন সবথেকে লম্বা।
ভাইঝির কাছে জেনারেল নলেজে হেরে গিয়ে চুপ করে গেলাম।
– আচ্ছে জেঠু, এবার বলো, এই ভেম্বানন্দ রেল ব্রীজটা কোথায়?
আমি হাত তুলে দিলাম। “তুইই বল।“
– এটা ভাল্লাপাড়ম থেকে এড়াপ্পল্লী। ভাল্লাপাড়ম একটা দ্বীপ। সেটা ২০১১ সালে কানেক্ট হয়েছে। ব্রীজটা সাড়ে চার কিলোমিটার লম্বা। সুতরাং শোন ব্রীজ এখন ভারতে দুই নম্বরে।

মাথা নেড়ে সায় দিলাম, সেরকমই কিছু একটা শুনেছিলাম। কিন্তু কোথায় ভাল্লাপাড়া, আর কোথায় এড়াপল্লী? কিছুই তো জানি না।
আবার কাবেরী হাসতে শুরু করে দিলো।
– জেঠু, তুমি কি নিউজ পড় না?
– কেন? আবার কি হলো?
– কারণ, এটাও ভুল। ২০১৮ সালের ডিব্রুগরের রেলব্রীজ এখন সবথেকে লম্বা, পাঁচ কিলোমিটারের সামান্য কম।
আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এই হাঁটুর বয়সী মেয়ে আমাকে নিয়ে তো রীতিমতো ছেলেখেলা করছে!!
– শোনো জেঠু, ব্রম্মপুত্রের উপর দিয়ে অরুনাচল পর্যন্ত ব্রীজটা হয়ে গেলে সেটাই হবে আমাদের দেশের সবথেকে লম্বা ব্রীজ। এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত প্রায় ন’ কিলোমিটার মতন হবে। কিন্তু সেটা রেল ব্রীজ নয়, রোড ব্রীজ হবে।

আবার সে মুচকি মুচকি হাসছে। নতুন কিছু ফান্ডা দেবে নাকি?
“শোনো জেঠু, বিহারের কাচ্চি দরগা ব্রীজটা, প্রায় দশ কিলোমিটার, যখন হবে, কবে হবে ভগবানই জানেন, তখন সেটাই হবে আমাদের ……”

অসমাপ্ত কথা বলে কাবেরী থেমে গেলো। বাকীটুকু আমাকে বুঝে নিতে হবে। আর আমার অবস্থা তথৈবচ। আমি সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, আর আমার হাঁটুর সমান সদ্য গ্রাজুয়েট একটা মেয়ে আমাকে ব্রীজ নিয়ে সব জেনারেল ফান্ডা দিয়ে যাচ্ছে। আমি তাঁর কথায় চ্যালেঞ্জও করতে পারছি না, কারণ আমার ফান্ডা শুন্য।
– আচ্ছা জেঠু, তুমি সবথেকে লম্বা কোন ব্রীজটা বানিয়েছো?
– না রে, আমি চাকরি করেছি ইন্ডিয়ান অয়েলে। তাই ব্রীজ বানাই নি।
– তুমি সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, অথচ ব্রীজ বানাও নি? শুধু তেল বানিয়েছ? সেকি?
কাবেরীর খুব মজা লাগলো।
– এই শোন, যা বুঝিস না, বলবি না।
– ভালোই হয়েছে, তুমি ব্রীজ বানালে সেই ব্রীজ দু’দিনেই ধ্বসে যেতো। আমরা বেঁচে গেলাম।
কথা বাড়ালাম না, কি জানি আবার কঠিন কঠিন সব প্রশ্ন করে বসবে। চেপে গেলাম। না জানি কোথাকার এক ডেঁপো মেয়ে আমার সাথে ফাজলামি শুরু করেছে। ভদ্রতার খাতিরে চুপ করে গেলাম।

রাতের খাবার এলো ন’টা নাগাদ। বেশিরভাগ লোকেরই চিকেন রাইস। আর কাবেরীর জন্য না বলতেই দু’কাপ চা এসে গেলো। আমার হাসি পেলো। “জেঠু, খুব খারাপ হচ্ছে কিন্তু…” আমাকে একদফা শাসিয়ে দিলো।

পরের দিন সকালে দিল্লী। ব্রেকফাস্ট এলো ডাবল ওমলেট, ব্রেড স্লাইস, মাখন, আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাইজ, সহজ কথায় সাহেবী কায়দায় লম্বা লম্বা করে কাটা কুড়কুড়ে আলুভাজা। এরপর ট্রেন চলছে, আর শ্রীমতী আম্বালা, লুধিয়ানা, জলন্ধর সবকটি স্টেশনে নেমে হাঁটাহাঁটি করছে। আমাকে বুঝিয়েছে ট্রেন স্টেশনে থামলে প্ল্যাটফর্মে নেমে নাকি খানিক হাঁটাহাঁটি করতে হয়। এতে ট্রেন জার্নির জড়তা কেটে যায়। কয়েকটি স্টেশনে আমাকেও টেনে নামালো। কেন জানি না, কন্যাসমা এক মেয়ের স্নেহের অত্যাচার আমার কিন্তু খারাপ লাগছে না। বুঝলাম, আমাকে নিরীহ ছাত্র পেয়ে মাষ্টারনীর ভূমিকা নিয়েছে।

বিকেল চারটের সময় অমৃতসর পৌছালাম। ট্যুর কোম্পানির ছেলে সবার মালপত্তর তদারকি করে আমাদেরকে বাসে তুলে দিলো। সোজা হোটেলে এসে উঠলাম। এতক্ষনের ট্রেন সফরে ক্লান্তিও এসেছিলো। হোটেলে আমি একটা আলাদা, মানে ডাবল বেড সিঙ্গল অকুপেন্সি রুম পেয়েছি। এসেই স্নান করে নিলাম। নিজেকে অনেকটাই চাঙ্গা মনে হলো।

ভাবছি, রুমে চায়ের অর্ডার দেবো, বেল বাজলো টুং টাং। দরজা খুলে দেখি কাবেরী।
– কিরে, কি ব্যাপার? আয়, ভেতরে আয়।
– সে পরে হবে, তুমি এখন কি করছো? মানে তোমার কি প্ল্যান?
– প্ল্যান আবার কি? কাল সকালের আগে তো কিছুই নেই। ভাবছি একটু শুয়ে থাকি।
– মানে? শুয়ে থাকবে? আঠাশ ঘন্টায় সতেরো’শ কিলোমিটার ট্রেন জার্নি করে তুমি এখানে শুয়ে থাকবে বলে এসেছো?

কি যে বলি? কিছুই বুঝতে পারছি না।
– চলো, চলো, গেট আপ, কুইক। দুর্গিয়ানা মন্দির হয়ে স্বর্ণমন্দির যাবো। স্বর্ণমন্দিরে রাত দশটায় পালকি বলে একটা ব্যাপার হয়, আর হয় ভোর সাতটায়। কালকের ন’টার সময়ে কুন্ডুর টিমের প্রোগ্রামের সাথে গেলে সেটা আর দেখা হবে না। এখনই দেখে নিতে হবে।
মনে পড়লো, কামদেব বলেছিলো, অমৃতসরে এলে পালকি নাকি দেখতেই হবে।
আমি আর কাবেরী অটোতে করে রওয়ানা দিলাম।

কাবেরী পড়াশোনা করে বেশ তৈরি হয়েই এসেছে। চলার পথে আমায় খানিকটা জ্ঞানও দিয়ে দিলো, এটি ষোড়শ শতাব্দীর হিন্দু মন্দির যার স্থাপত্য অনেকটাই স্বর্ণমন্দির ঘরানায় তৈরি, চূড়ার সোনার পাতও সেই একই ঘরানার। এর চারিপাশে পুষ্করিণীও খনন করা হয়েছে। দেবী দূর্গার নামেই এই মন্দিরটি, তবে এখানে বিষ্ণু ও লক্ষীরও পূজা হয়। পৌরাণিক বিশ্বাস অনুযায়ী এখানে মহর্ষি বাল্মীকির আশ্রম ছিলো। এবং লোকের বিশ্বাস, রামায়ণের লব ও কুশের জন্ম হয় এই আশ্রমেই। জনশ্রুতি এই যে রামের অশ্বমেধ যজ্ঞের ঘোড়াকে ও হনুমানকে লব-কুশ এখানের দুর্গিয়ানা মন্দিরের একটি গাছের সাথে বেঁধে রেখেছিলো।

দুর্গিয়ানা মন্দিরে গিয়ে মনে হলো, এখানে না আসলে আর কাবেরীর ঐতিহাসিক আর পৌরাণিক তথ্যগুলো না জানলে অমৃতসর ট্রিপটাই অসম্পূর্ণ থেকে যেতো। কাবেরীকে ডেকে বললাম, থ্যাংক ইউ। সে বুঝলো না,
– হঠাৎ থ্যাংক ইউ? কেন?
– তুই আগে থেকে আমাকে ব্রিফ না করে দিলে এই মন্দিরের ব্যাপারে কোন ইন্টারেস্টই হতো না।
– ওহ, ইন্টারেস্ট হয়েছে? সত্যি বলছো তোমার ভালো লেগেছে? ঠিক আছে, তাহলে চলো আইসক্রীম খাওয়াও।

আরে? এঁকে তো ভালো লাগলে ভালো বলাও মুস্কিল।
– তুই এখন আইসক্রীম খাবি?
– বাহ রে! এপ্রিল মাসে অমৃতসরে এসে আইসক্রীম খাবো না?
– এখন?
– তুমি কি বলতে চাও জেঠু? এই এপ্রিলের গরমে আইসক্রিম খাবো না, তো ডিসেম্বরে আলাস্কায় গিয়ে রাত তিনটের সময় আইসক্রিম খাবো? জেঠু ……, তুমি না, একটা ……, আর কি বলবো?
– হ্যাঁ, বল বল, থামলি কেন?
– না, এখন বললে তুমি আর আইসিক্রিম খাওয়াবে না। আগে খাওয়াও, তারপর।

ঠিক হলো স্বর্ণমন্দির গিয়ে আইসক্রিম খাবো। যাওয়ার পথে বললো, “জেঠু, তুমি ভাবছো, কেন এই রাতে তোমাকে স্বর্ণমন্দির টেনে নিয়ে যাচ্ছি,তাই তো? তাহলে আগে রাতের স্বর্ণমন্দির দেখে নাও, তারপর আমাকে জানিও, কেমন লাগলো?”

স্বর্ণমন্দিরে এসে অটোটা ছেড়ে দিলাম। আর সামনেই আইসক্রিমের দোকান। “জেঠু, জেঠু, আইসক্রিম, আইসক্রিম।“
আমি ধমক দিলাম, “চুপ কর। পাগলের মতন চ্যাঁচাস কেনো?”
মেয়ে থামবে না। আইসক্রিম কিনে দিলাম, খেয়ে যেন সে শান্ত হলো।
“জেঠু, পঞ্জাবের দুধের আইসক্রিম না…, এক্কেবারে পাগলা। তবে জেঠু, আমাদের ধানবাদের রেল ষ্টেশনের চাও কিন্তু কম যায় না।“
না, এই মেয়ের সাথে তক্কাতক্কি একদম নয়।

আমরা এগিয়ে গেলাম। সামনেই স্বর্ণমন্দির। এর ইতিহাসটা জানলে হয়তো ইন্টারেস্ট আরেকটু বাড়বে। কাবেরীকে বললাম। মোটামুটি সে যা বললো, ষোড়শ শতাব্দীতে, ১৫৭০ খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ মুঘল সম্রাট আকবর এই জায়গাটি দান করেন। শিখ গুরু রামদাসের নির্দেশে অমৃত সারস পুষ্করিণী খনন করা হয়। সুতরাং এই পুষ্করিণী প্রকৃতির সৃষ্টি নয়, এটিকে খনন করা হয়েছিলো। আর এই অমৃত সারস নাম থেকেই অমৃতসর নামকরন। এরপর ১৫৯০ সাল নাগাদ পুস্করিণীর কেন্দ্রে হরমন্দির সাহিব প্রতিষ্ঠিত হয়। এই হরমন্দির সাহিবকেই আমরা সাধারণ লোকেরা স্বর্ণমন্দির নামে জানি। এরপর সপ্তদশ শতাব্দীর একদম শুরুতে ১৬০০-১৬০৫ সাল নাগাদ শিখ গুরু অর্জুন গ্রন্থসাহিব রচনা করে এই হরমন্দির সাহিবে স্থাপন করেন। বাবা বুদ্ধ সাহিব ছিলেন এর প্রথম গ্রন্থী।
– আর পালকি?
– জেঠু, এটি একটি অনুষ্ঠান, দিনে দু’বার হয়। রাত দশটা নাগাদ হরমন্দির সাহিবে দিনের শেষ হুকুমনামা পাঠ হয়ে গেলে, গুরু গ্রন্থসাহিবকে হরমন্দির সাহিব থেকে সোনার পালকি সিংহাসনে সাজিয়ে শোভাযাত্রা করে সামনের অকাল তখত সাহিবে নিয়ে যাওয়া হয়। এই পালকিকেই বলে পালকি সাহিব। সকলের আগে একজন ট্রাম্পেট বাজিয়ে আসেন। পিছনে ভক্তরা কাঁধে সেই পালকি বহন করেন। সকলের বিশ্বাস, অকাল তখতে গুরু গ্রন্থসাহিব ঐসময় রাত্রির বিশ্রাম নেন। অকাল তখতে সেইসময় গ্রন্থসাহিব বন্ধ রাখা হয়, উনার নির্বিঘ্নে বিশ্রামের জন্য কীর্তন বন্ধ থাকে, শুধু কিছু বিশেষ স্লোক উচ্চারিত হয়। অন্যদিকে এইসময় হরমন্দির সাহিবের দৈনন্দিন পরিস্কারের কাজ চলে। ভক্তরাই এটি করেন।

আমি ওঁর সব কথা বুঝতে পারলাম না, কোথায় যেন ডিসকানেক্ট হচ্ছে। আমার মুখ দেখেই কাবেরী সেটা বুঝতে পেরেছে।
– শোনো জেঠু, আমরা হিন্দুরা যেমন দেবদেবীর মূর্তিপুজা করি, শিখধর্মে ওরা গুরু গ্রন্থসাহিবকে সামনে রেখে প্রার্থনা করে। এই গ্রন্থসাহিব ওঁদের ধর্মগ্রন্থ।

অবাক হয়ে সব শুনলাম। “তুই হিস্টোরিয়ান না হয়ে লাইব্রেরিয়ান কেন হলি?”
মনে হলো প্রশ্নটা কাবেরীর পছন্দ হলো না। বেকায়দা প্রশ্ন করলাম না তো?
– জেঠু, তোমরা জানোই না একজন ভালো লাইব্রেরিয়ান হতে গেলে কত কিছু জানতে হয়। ধরে নাও তুমি লাইব্রেরি গিয়ে সেই ভেম্বানন্দ রেল ব্রিজের উপরই একটা রেফারেন্স বই চাইলে। এবার লাইব্রেরিয়ান যদি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, তাহলে কি হবে? সুতরাং… একজন লাইব্রেরিয়ানকে অনেক পড়াশোনা করতে হয়। আমি মাসে সাত আটখানা বিভিন্ন রকমের ম্যাগাজিন পড়ি।
কন্যাসমার কথা শুনে আমারও কিছু জ্ঞান হলো। আমি জানতাম লাইব্রেরিয়ান মানেই বইপত্তরের কেয়ার টেকার। আলমারিতে গুছিয়ে রাখাই তার কাজ। আমার ধারণাটাই সে পাল্টে দিলো।

পালকি অনুষ্ঠান হলো রাত দশটায়। কামদেবের কথাই ঠিক, আর কাবেরী আমাকে এই পালকির ইতিবৃত্ত আগেই বলে রেখেছিলো। যদি এই রাতে না আসতাম, তাহলে ভাবতেও পারতাম না কি সুন্দর এই অনুষ্ঠান, আর কি ডিসিপ্লিন! চারিদিকে আলোর ফোয়ারা। আর রাতের আলোয় পুকুরের জলে স্বর্ণমন্দিরের অসাধারণ সব প্রতিবিম্ব। রাত সাড়ে দশটা নাগাদ মন্দিরে প্রবেশ করলাম। কিন্তু তখন ভিতরে পর্দা টাঙিয়ে দিয়ছে। শুনলাম স্বর্ণমন্দিরের ভিতর রোজ শিবের মূর্ত্তির পূজো হয়। কিন্তু দেখা হলো না। শুধু রাতের পালকি শোভাযাত্রা দেখে মন্দির চত্ত্বরের বাইরে এলাম।

রাস্তার উপরে বেশ কিছু খাবারের দোকান। পরিস্কার চেয়ার টেবিল পাতা। সেরকমই একটা দোকানের বাইরের চেয়ারে কাবেরী বসে পড়লো। আমি কিছু বুঝে উঠে বলার আগেই কাবেরী বলে দিলো, আগে বসো, পরে কথা বলবে। দোকানীকে ডেকে অর্ডার দিলো, মালাই লসস্যি, পিতল কি গেলাস মে। এক বড়া, এক ছোটা।
আমার দিকে তাকিয়ে বললো, হ্যাঁ জেঠু কি যেন বলতে চাইছিলে?
– এখন রাত এগারোটা বাজে, এখন লসসি?
– তাহলে তোমার অর্ডারটা বাতিল করে দি? তুমি ধর্মতলার অনাদি কেবিনে, বা আমহার্স্ট স্ট্রীটের পুটিরামের দোকানে কাঁচের গ্লাসে বাগবাজারের স্পেশাল মালাই লসসি খেয়ে নিও।
না, তক্কো নয়, মেয়েটা ঠিকই বলছে। পঞ্জাবে এসে লসসি খাবো না? সেই কাঁসার গেলাসের লসসি খেয়ে শরীরটা যেন জুড়িয়ে গেলো। সারাদিনের ক্লান্তিও উধাও।

খাওয়া হয়ে গেলে কাবেরী একটু কাছে এসে গলা নামিয়ে বললো, “এই লসস্যিটা কিন্তু তুমি খাওয়াচ্ছ।“
বললাম, “কেন? কালকেই যে লম্বা লম্বা ডায়লগ দিলি, তুই চাকরী করিস, আমি রিটায়ার্ড, এবার উল্টো কেন?”
– উল্টো নয় জেঠু, উল্টো নয়। তোমার কাছে সব পাঁচশ টাকার নোট, সেটারই একটা ভাঙিয়ে নাও। কাজে লাগবে।

পয়সা মিটিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম। কাল সকালে কুন্ডু টিমের সাথে এখানেই আবার আসতে হবে। কাবেরী বলে দিলো, আমরা যেন হোটেলে ব্রেকফাস্ট না করি। “আরে, আমরা তো ব্রেকফাস্টের জন্য পয়সা দিয়ে রেখেছি।“
– ঠিক আছে, তুমি পাউরুটি মাখন ডিমভাজা খেয়ে নিও। আমি কিন্তু হোটেলের ব্রেকফাস্ট খাচ্ছি না।
বুঝলাম আমার মেয়ে কিছু সারপ্রাইজ প্ল্যান করে রেখেছে, এখন এর বেশি কিছুই বলবে না।

ন’টা নাগাদ দলের তেইশ জন এসি ট্রাভেলরস বাসে করে স্বর্ণমন্দির চত্তরে পৌছালাম। কাবেরী বলে দিয়েছে, স্বর্ণমন্দির মানে হরমন্দির সাহিব। শুরুতে সাহেব সাহেব বলছিলাম, সে ভুল সংশোধন করে দিলো, সাহিব হবে, সাহেব নয়। সাহিব কথাটির অর্থ হৃদয়ের গভীর সম্মান উৎসর্গ করা। এখানে সাহেব মেমসাহেবের ব্যাপার নেই। সবাই যখন হরমন্দিরের দিকে যাচ্ছে, কাবেরী আমাকে সেদিকে যেতেই দিলো না, কারণ গতকাল রাতেই আমাদের দেখা হয়ে গেছে। এরপর দলের সকলে দূর্গিয়ানা মন্দির যাবে। আমরা জানালাম যে গতকালই দেখে এসেছি, তাই আজ আর যাবো না। আমরা থেকে গেলাম, বাকীরা চলে গেলো।

স্বর্ণমন্দির চত্ত্বরের লাগোয়া জালিয়ানওয়ালাবাগ থেকে বাইরে আসার জন্য একটা গলিপথ দিয়ে সামনের দিকে আসতে হয়। কাবেরী আমাদের সেই গলিতে ডেকে নিয়ে গেলো। “জেঠু, তোমার তো ব্রেকফাস্ট হয় নি। চলো, আজ সাদা মাখনে ভাজা আসল পঞ্জাবী পরোটা তোমাকে খাওয়াই, সঙ্গে পঞ্জাবী দাল মাখানি।“
মেয়েটা মন্দ বলে নি। আর এখন বুঝলাম যে এইজন্যই হোটেলে আমাকে সে ব্রেকফাস্ট করতে দেয় নি।
স্টীলের থালায় পরোটা দাল মাখানি, সঙ্গে পেঁয়াজ, লঙ্কা, আচার। অপূর্ব। এই পরোটা, দাল মাখানি কলকাতার পঞ্জাবী রেস্তোরাঁতেও পাবো না। এরপর বাইরে এসে ছোট কাঁসার গ্লাসে মালাই লস্যি।
তখন বাজে প্রায় বারোটা। সুতরাং আজ লাঞ্চে আর কিছুই নয়।

যা ভাবি অতই সহজ, ততটা নয়। আইসক্রিমের দোকানের সামনে কাবেরী আবার দাঁড়িয়ে পড়লো। আইসক্রিম খেয়ে আমরা হোটেলে ফিরে এলাম। এখন ঘন্টা দুয়েকের বিশ্রাম, তারপর ওয়াগা বর্ডারের প্যারেডের দেখতে যাবো।

ওয়াগা সীমান্ত অমৃতসর শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার। পৌঁছলাম বিকেল চারটে নাগাদ। রাস্তায় কাবেরি ছোট করে বুঝিয়ে দিলো, যে এটা শুধু ভারতের অনুষ্ঠান নয়। ১৯৫৯ সাল থেকেই ভারত পাকিস্তান দুই দেশের এই ড্রিল চলছে। আমাদের থাকে বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের (বিএসএফ) জওয়ান, আর পাকিস্তানের দিকে থাকে পাকিস্তান রেঞ্জারস। ফৌজি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলা যায় শত্রুর সাথে কিভাবে মোকাবিলা করা উচিৎ, সেটাই এই প্যারেডে বড় করে চোখে পড়ে।

চারটা নাগাদ হাতে মাইক্রোফোন নিয়ে আমাদের একজন কম্যান্ডিং ফৌজি অফিসার এসে জয় হিন্দ, ভারতমাতা কি জয়, বন্দে মাতরম ইত্যাদি বলে আসরটাকে একটু নয়, অনেকটাই চাঙ্গা করে দিলেন। সারা স্টেডিয়াম জুড়ে সাউন্ড সিস্টেম, তার সাথে আমাদের স্লোগানের আওয়াজে চারিদিক গমগম করছে। আর উনি লম্বা স্টেডিয়ামের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত দৌড়ে বারবার বোঝাচ্ছেন যে আওয়াজ আরও জোরে চাই। খানিক পরে মাইক্রোফোনে ঘোষনা করলেন, মেয়েদের মধ্যে যারা নাচতে চায়, তাঁরা নীচে নেমে আসতে পারে। ঘোষনা শোনামাত্রই কাবেরী দৌড়ে নেমে চলে গেলো, “জেঠু, তুমি বসে থাকো, আমাকে ফেলে কোথাও যাবে না কিন্তু।“ সারা স্টেডিয়ামের কোনা কোনা থেকে মেয়েরা সব দৌড়ে দৌড়ে নেমে এলো। শুরু হলো নাচ। দূরে ভিড়ের মাঝে হলেও আমি ওকে দেখতে পাচ্ছি। সে তাঁর উদ্দাম নৃত্য।

শো দেখে স্টেডিয়ামের বাইরে এসেছি, বাসের দিকে যাচ্ছি।
– জেঠু…… আইসক্রিম।
– আবার আইসক্রিম? দাঁড়া, এবার তোর মাথায় আইসক্রিম ঢেলে তোর মাথা ঠান্ডা করছি।
– সামান্য তো একটা আইসক্রিম চেয়েছি জেঠু, তার জন্য এত বড় একটা কথা বলে দিলে?
আইসক্রিম খাইয়ে ভাইঝির মানভঞ্জন করতে হলো। শুধু তাই নয়, কাবেরী সেখানে দাঁড়িয়ে একটা খেলো, আর বাসে করে ফেরার এক ঘন্টার রাস্তায় খাবে, তাই আরেকটা কিনতে হলো।
– জেঠু, ইউ আর রিয়েলই আ সুইট সুইট বয়।

ফেরার সময় বাসে উঠেই আমার কাঁধে মাথা রেখে সে নিজেকে যেন এলিয়ে দিলো।
– কি রে? টায়ার্ড হয়ে গেলি? অবশ্য সকাল থেকেই রোদে রোদে ঘুরে তারপর এতক্ষণের নাচ, ক্লান্তি তো আসবেই।
– না জেঠু, এই যে পাকিস্তান বর্ডারে ওদের নাকের ডগায় গানের সাথে নাচলাম, হামসে যো টকরায়েগা, এই সুযোগ তো রোজ পাবো না।
কাবেরী কথাটা ঠিকই বলেছে, আমার মনেও সেইসময় দেশাত্মবোধ ভাবনা এসে গিয়েছিল।
খারাপ লাগছে, এত প্রানবন্ত মেয়েটি এখন এতই ক্লান্ত। বললাম, “আইসক্রিম খাবি? আরেকটা নিয়ে আসবো?”
– না জেঠু, আমি এরকমই ঠিক আছে।
বাসে করে হোটেলে ফেরার পথে কাবেরী সারা রাস্তা আমার কাঁধে মাথা রেখে শুয়ে থাকলো।

পরদিন সকালেই আমাদের রিটার্ন জার্নি, সেই জালিয়ানওয়ালাবাগ এক্সপ্রেস, ছাড়বে দুপুর দেড়টায়। সকালে দু’জনে ব্রেকফাস্ট টেবিলে অনেক কথা হলো। যেটুকে বুঝেছি, মেয়েটি অনেক বিষয়েই পড়াশোনা করে। হয়তো শ্রোতা পায় না, আমাকে পেয়ে এখন বেশিরভাগ সময়ে আমিই শ্রোতা। একটানা এত শুনেও আমার কিন্তু বিরক্তি বোধ হলো না। বরং অনেক কিছুই জানতে পারলাম। সে থেমে গেলে মনে হলো, থামলো কেন? ভালোই তো বলছিলো।

ট্রেন ছাড়ার পরে আমাকে প্রশ্ন করলো, “জেঠু, লুধিয়ানা পৌঁছাবো সাড়ে তিনটের সময়, আর আম্বালা সাড়ে পাঁচটার সময়। তুমি চা কোথায় খাবে?”
এবার আমার মজা করার পালা, বললাম, “দুটোর একটাও নয়। “
– কেন? কেন? ঠিক আছে, তাহলে আমি একাই নেমে খাবো।
– না, তাও চলবে না।
– হঠাৎ কি হলো তোমার, জেঠু? এরকম বৈরাগ্য?
– কারণ আমরা আইসক্রিম খাবো। এবং আমি খাওয়াবো।
দেখলাম, আর দেখে খুব ভালো লাগলো, কাবেরীর মুখে অদ্ভুত এক আনন্দের হাসি, “মাইরি জেঠু? সত্যি বলছো?”
সীট ছেড়ে উঠে গিয়ে ট্যুরের ছেলেটিকে ধরে দুটো আইসক্রিম কাপ নিয়ে এলো।

পরদিন সকাল সাড়ে আটটায় গয়া। এবার আমি নিজেই স্টেশনে নেমে কাছের এক ভেন্ডরের থেকে দুটো আইসক্রিম কিনে নিয়ে এলাম। আর, এবার আমার অবাক হওয়ার পালা, আমাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য কাবেরীও দুটো আইসক্রিম কিনে এনেছে।

দুপুরে খাওয়ার পর দেখলাম, সে কেমন যেন চুপ করে আছে। আমার ভালো লাগছে না। “কি রে, এরকম চুপ করে জানালা দিয়ে চেয়ে আছিস? চা খাবি? ট্যুরের ছেলেটাকে ডাকি?”
কিছুই উত্তর দিলো না। আমার মনে চিন্তা, হঠাৎ কি হয়ে গেলো? মিনিট খানিক বাদে, নিজেই জানালো, “আচ্ছা, তুমি কেন আমার নিজের আপন জেঠু হলে না?”
– কি যে বলিস? রক্তের সম্পর্ক না হলে কি জেঠু হওয়া যায় না?
কাবেরী এখন অনেক শান্ত, গত চারদিনের কাবেরী এখন কেমন যেন অবসাদ্গ্রস্ত। বললাম, “শোন, তুই আমার ছোটভাই, আর তোর মাকে নিয়ে একদিন আমাদের বাড়ি আয়।“
অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে সে বলে, “ছোট ভাই? তোমার ছোটভাইকে আমি কোথায় পাবো?”
– কি মুস্কিল, আমি তোর জেঠু হলে আমার ছোটভাই তোর কে হয়?
কাবেরী পিছনে হেলান দিয়ে বসলো। চোখের কোণে সামান্য জল।
– জেঠু, তোমার ছোটভাইকে আমি জন্মের সময়ই হারিয়েছি। বাবা কি হয়, আমি জানিই না। তাই অনেকের মাঝে আমি আমার বাবাকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করি।
শুনে আমি কি বলি, কিভাবে সান্ত্বনা দি, বুঝতে পারছি না।
– আমার না, তোমার মতন বয়সী লোকজন দেখলে খুব কথা বলার ইচ্ছে হয়। ট্রেনে তোমাকে দেখেই কেন জানিনা তোমাকে আমার অনেক আপন মনে হলো। সেইজন্যই এই ক’দিন তোমায় এত জ্বালিয়েছি।
এবার আমি ধমক দিলাম, “কে বলেছে, তুই আমাকে জ্বালিয়েছিস? এরকম বাজে কথা একদম বলবি না।“

ট্রেন থেকে নামার আগে ওর ফোন নম্বর নিয়ে নিলাম।
চারদিন পরেই রবিবার। শনিবার সকালে ফোন করলাম, “কি রে? আইসক্রিম খাবি?”
“শুধুই আইসক্রিম? আর কিছু নয়?” মনে হলো ফোন পেয়ে খুশীই হয়েছে।
– না, কাল রবিবার। চলে আয়, স্পেশাল মুরগী খাওয়াবো, আর লাস্টে আইসক্রিম

*******

তৃতীয় পর্ব: মমীর দেশের মোমের পুতুল

ছ’ঘন্টা লেট করে মামুর ফ্লাইট যখন কায়রো এয়ারপোর্টে নামলো ততক্ষণে সন্ধ্যার আঁধার নেমে আসছে। টেক অফ করার আগে যান্ত্রিক গোলযোগের কারণেই এই দেরি। মানে ট্যুর প্ল্যানের আজকের বিকেলটা নষ্ট। এয়ারপোর্টের বাইরে মামু যখন এলেন, অন্ধকার ততক্ষণে নেমে এসেছে।

মামু’র বয়স ৬৭। অকৃতদার। রিটায়ার করেছেন। একলাই থাকেন। শখের মধ্যে গান, পৃথিবীর একপ্রান্ত অন্যপ্রান্ত চষে বেড়ানো, সাথে ফটোগ্রাফি, আর টিভিতে ন্যাশনাল জিওগ্রাফি, ডিসকভারি চ্যানেল। পাহাড় জঙ্গল বরফে অনেকবার গেছেন। এবার মরুভূমির ধূলার দেশে এলেন। অনেক আগে, যখন বয়স পঞ্চাশেক, একবার মিশর এসেছিলেন। এটা দ্বিতীয়বার। বিখ্যাত দর্শনীয় বস্তুগুলি আগেরবারই দেখে গেছেন। এবার নিছকই ছুটি কাটাতে। নির্দিষ্ট ট্যুর প্ল্যান নেই, নিজের ইচ্ছেমতন ঘুরবেন। কোন ট্যুর এজেন্সির প্ল্যান ছাড়াই।

গাইড নিয়ে দোনামনা ছিলো, নিছক ঘুরে বেড়ানোর জন্য গাইডের কি দরকার? আবার ভাবলেন, এদেশে রাস্তাঘাটে ইংরেজি বলা লোকজন কম, তাই হোটেলের মাধ্যমেই গাইড বুক করে রেখেছিলেন। এয়ারপোর্টের বাইরে এসে দেখেন একজন প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে, Welcome Mr. De. আন্দাজ বয়স আঠারো উনিশের একটি মেয়ে। পোষাক ভারতীয় মেয়েদের শালোয়ার কামিজের মতন। নিজের পরিচয় দিয়ে মেয়েটি বললো Welcome Sir, welcome to Egypt. প্রথম দেখাতেই মেয়েটিকে মামুর খুব ভালো লেগে গেলো। মেয়েটির বিজনেস কার্ড দেখলেন, Punam Ali (Mithai).

প্রাথমিক নমস্কার ও শুভেচ্ছার পরে মেয়েটি বললো, “Sir, so far, I know that you don’t have any tour plan. But your flight is late, it’s already evening. So, what would you like to do now?”
মামুরও একই চিন্তা। বললেন, “If I go to hotel now, then it will be further late, so can you take me to some evening interesting area , or may be your famous desert show.” এরপর খানিক জুড়ে দিলেন, “But remember, I am too old for young crowd’s choice. So, please take me only, and only to any descent place, and only to any descent show.”
– Sure, Sir.
মেয়েটি হাসলো, মামু’র নজর এড়ায়নি। “What makes you smile, dear little girl?”
– Your words Sir, … too old for young crowd’s choice, I liked it. Anyway, I will take you to a good desert show.

প্রথম নজরেই মেয়েটিকে মামুর ভালো লেগেছে।
– You look like a little girl, I guess you should be a student now.
মেয়েটি মামুর দিকে ফিরে তাকালো, মুখে স্মিত হাসি। হাসিমুখেই জবাব দিলো, “Yes Sir, I am a student now, studying tourism”.
– Student? Then what is your first identity? A student? Or a Guide?
– Sir, it’s both. As part of my studies and university assignmets, I got the student’s license and I work as a tourist guide for the foreigners. So, I also earn a little.”
এখানেই সে থামলো না। আবার মিষ্টি হাসিমুখেই বললো, “Sir, you are only partillay correct, I am not that little a girl, but a teenager.”

কথায় কথায় মেয়েটি জানালো যে, তাঁরা কথা বলতে বলতে শহর থেকে সামান্য বাইরে, desert show-র কাছেই চলে এসেছে, এবার নামতে হবে। গাড়ি থেকে নামার আগে পুনম বললো, “Sir, you are from Calcutta, right Sir?”
মামু খানিক অবাকই হলেন, হঠাত এই প্রশ্ন? মামুর মনের কথা বুঝে নিয়ে মেয়েটির আবার সেই স্মিত হাসি, “Sir, tonight there may be a surprise waiting for you, but Sir, please, you can not ask me anything about it now.”

মামু গাড়ি থেকে নেমে দেখলেন, সামনে চারিদিকে শুধুই বালু আর বালু। খোলা আকাশের নীচে একটা জায়গা, মাখখানে খালি রেখে বৃত্তাকারে কার্পেট আর চেয়ার পাতা। একদিকে কিছু বাদ্যযন্ত্র, বোঝা গেলো ওদিকটায় যন্ত্রীরা বসবেন। ঘেরা জায়গা নয়, মানে যে কেউ আসতে পারে। পুনমকে বলতেই সে জানালো যে, টিকিটের দাম সে নিজের এলাউন্স থেকে দিয়ে দিয়েছে। পুনম একজন ট্যুরিস্ট গাইড, নিশ্চয়ই আগে অনেকবার এসেছে। একজনের সাথে খানিক দূরে গিয়ে কিছু আলোচনা করে নিলো। লোকজন খুব বেশি নয়, জনা বিশ বাইশ হবে। অধিকাংশই বালুর উপরে কার্পেটে বসেছেন। পোষাক, বয়স দেখে মনে হয়, সকলেই হয়তো মামু’র মতনই descent place, descent show দেখতে এসেছেন। পুনম জানতে চাইলো, ড্রিংক্স? মামু’র এসবে অত উৎসাহ নেই, সে সঙ্গীতের পাগল লোক, তাঁর নজর চলে গেছে সেই বাদ্যযন্ত্রগুলির দিকে। পুনমকে বলতেই সে মামুকে সেখানে নিয়ে গেলো। সবই আরবিক যন্ত্র। পুনম বুঝিয়ে দিলো কোনটা কি যন্ত্র, আর প্রতিটি যন্ত্রের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।

অনুষ্ঠানের শুরুতে হলো আরবীক ঘরানার ঐতিহ্যগত যন্ত্রসঙ্গীত, তিনটে আরবী ভাষার গান। পুনম বুঝিয়ে দিলো যে এগুলোর একটি মরুভূমির গান, একটি প্রাচীন গ্রীক লোকসঙ্গীত, আর একটি আরবী আধুনিক। তারপর হলো বেলি ডান্স, তবে লোকমুখে শোনা লাস্যময়ীর নাচ নয়, যেটা মামুর ভয় ছিলো। নাচের শেষে পুনম মামুকে বললো, Sir, please give me leave for a few minutes. সে চলে গেলো যন্ত্রীদের মাঝখানে। হাতে মাইক্রোফোন নিয়ে ভূমিকায় বললো, “Dear respected guests. We shall conclude tonight’s event with a desert song, based on the playing life of a dancing girl child. The language of this song is not Arabic, though the content of the song is Arabic. The song, its original is written in Bengali, and I am dedicating this song to one of our honourable guests of tonight, who is from Bengal and tonight he is present with us.”

মামুর বিস্ময়ের ঘোর কাটতেই পুনম গান ধরলো

মোমের পুতুল মমীর দেশের মেয়ে নেচে যায়।
বিহবল চঞ্চল পায়।
খর্জুর বীথির ধারে, সাহারা মরুর পারে
বাজায় ঘুমুর ঝুমুর ঝুমুর মধুর ঝঙ্কারে।
উড়িয়ে ওড়না লু হাওয়ায়, পরী নটিনী নেচে যায়
দুলে দুলে দূরে সুদূর।
সুর্মা পরা আঁখি হানে আস্‌মানে
জ্যোৎস্না আসে নীল আকাশে তার টানে।
ঢেউ তুলে নীল দরিয়ায়, দিল দরদী নেচে যায়
দুলে দুলে দূরে সুদূর।

অবিশ্বাস্য। স্পষ্ট বাংলা উচ্চারণ। কোন বিকৃতি নেই, কোন জড়তাই নেই। মামু ভাবতেই পারে না যে সুদূর মিশরের মরুভূমিতে একটি মিশরীয় মেয়ে এরকম স্বচ্ছন্দ বাঙলায় খালি গলায় এত সুন্দরভাবে একটা নজরুলের গান গাইতে পারে। মামু চোখ বন্ধ করে শুনছিলেন, তাই অতটা খেয়ালও করেন নি যে উপস্থিত কিছু লোকজন উঠে পুনমের গানের সাথে তালিও দিয়েছে। গান শেষ হতেই মামু উঠে গেলেন পুনমের কাছে, হাতে মাইক্রোফোন নিয়ে বললেন, Nothing can be more memorable and more surprising than this unique and beautiful gift for me. No word is enough to express my gratitude, and thanks to this little girl, the angel of this evening.”

এবার হোটেলে ফেরার পালা। মামু যেন এক স্বপ্নের ঘোরে। এয়ারপোর্টে প্রথম দর্শনেই মেয়েটিকে মামুর খুব ভালো লেগেছিলো। এই গানের পরে মামু এখন যেন অন্য এক জগতে। পুনম ট্যুরিস্ট গাইড, অনেক অচেনা লোকজনের সাথে মিশতে হয়, তাই মনস্তত্ত্ব ভালোই বোঝে। আবার সেই স্মিত হাসিতে পরিস্কার বাংলায় বললো, “মিস্টার দে, আমি বাঙালী।“
আবার চমক, “বাঙালী ?”
– হ্যাঁ স্যার, আমি বাঙালী।
– এই প্রবাসে, আই মীন বিদেশে …… তুমি বাঙালী …… আমি তো বুঝতেই পারি নি।
– প্রবাস কথাটির অর্থ আমি জানি, বিদেশ বলে বুঝিয়ে দিতে হবে না। আপনি আমার সাথে স্বচ্ছন্দে বাংলায় কথা বলুন।
মামু কি বলবে বুঝে পায় না। ইতিমধ্যে গাড়ি হোটেলে পৌঁছে গেছে।
– স্যার, আপনার হোটেল এসে গেছে। আপনার সব কৌতুহলের উত্তর কাল পেয়ে যাবেন। আমি আপনার হোটেলের চেক ইন করিয়ে দিচ্ছি। আপনার চার ঘন্টার ফ্লাইট ছ’ ঘন্টা দেরিতে এসেছে। আপনি ক্লান্ত। এখন রাতের খেয়ে বিশ্রাম নিন।

পুনম নিজেই মামুর চেক ইন করিয়ে দিলো। “স্যার,আপনার চেক ইন হয়ে গেছে। আমি এখন যাই, কাল সকালে ন’টায় আমি আসবো।“
– না পুনম, আমার তো সেরকম ট্রাভেল প্ল্যান কিছু নেই। তাড়াহুড়ো করতে হবে না, তুমি সাড়ে দশ’টার সময় এসো।
মামু এখনও ঘোরের মধ্যে। এই মেয়েটিকে কেন সে নিজেই জানে না, বড়ই তাঁর আপন মনে হলো। আরব মরুভূমির একটি মেয়ে বাংলা গান গেয়ে যে এমন চমক দেবে মামু সেটা ভাবতেই পারে না।

পরদিন সকালে পুনম আসতেই মামু লাউঞ্জে নেমে এলেন। বললেন, “পুনম, আজ এত দেরী পর্যন্ত ঘুমিয়ে সকালে ব্রেকফাস্টটাই আর করা হলো না।“
পুনম একজন গাইড, প্রখর তাঁর কর্তব্যবোধ। “স্যার, পেটে ক্ষিদে নিয়ে তো ঘুরে বেড়ানো যায় না। কিরকম চাই বলুন, ভারতীয়, কন্টিনেন্টাল, এমনকি বাঙালী রসনা চাইলে তাও চেষ্টা করতে পারি।“
– কায়রোতে বাঙালী মেনু?
– মেনু নয় স্যার, রসনা। আর কায়রোতে যদি কেউ বাংলা গান গাইতে পারে, তাহলে বাঙালী রসনা কেন নয়?
মামুর মুখে আর কোন কথাই নেই। “ইউরোপ আমেরিকায় প্রচুর আছে, দুবাই, মাস্কাটে আছে। তাই বলে কায়রোতে আছে এর আগে আমি কিন্তু শুনিনি।“

পুনম মামুকে একটি রেস্তোরাঁয় নিয়ে গেলো, বাইরে সাইনবোর্ড Monalisa Café, for all Indian foods. গাড়ি থেকে নেমে রেস্তোরাঁয় ঢুকে দেখে জনশুন্য। মানে সকালের ব্রেকফাস্টের পরে খদ্দেররা সব কেউ ঘুরতে, কেউ অফিসে চলে গেছে, এবার দুপুরে লাঞ্চের সময় আবার অনেকে আসবে। ওনাদের দেখে একজন বয়স্ক লোক এগিয়ে এলেন, বেশ উচ্ছসিত উঁচু গলায় বললেন, “আরে মোমের পুতুল যে? হঠাৎ কি মনে করে?” সঙ্গী ভদ্রলোকটিকে দেখে উনার ভারতীয়ই মনে হলো। ইংরেজিতেই বললেন, “স্যার ওয়েলকাম, প্লিজ হ্যাভ এ সীট।“
পুনম বলে দিলো, “চিঙড়িকাকু, বাংলাতেই বলো।“
– আরে কি আশ্চর্য,আপনি বাঙালী?
– হ্যাঁ কাকু, বাঙালী, আমি এখানে উনার গাইড। উনি হোটেলে ব্রেকফাস্ট করেন নি, মানে দেরী হয়ে গেছিলো। আমি বলেছি, তুমি বাঙালী রসনা খাওয়াবে, তাই ডেকে এনেছি। এবার আমার সন্মান তোমার হাতে।
মামু বলতে যাচ্ছিলো, ঝামেলার দরকার নেই, কিছু একটা হলেই চলবে। কিন্তু তার আগেই ভদ্রলোক বলে দিলেন, “আমার মোমের পুতুল বলেছে, বাঙালী রসনা করতে হবে, এর পরে আর অন্য কোনো কথাই হবে না। আপনি বসুন।“
জনৈকের উদ্দ্যেশ্যে ডাক দিলেন, “একবার দেখে যাও, কে এসেছে।“
দরজা ঠেলে একজন মহিলা এলেন। “আরে!! মিঠাই যে, আয় আয়। বোস।” সঙ্গী ভদ্রলোককেও নমস্কার জানালেন।
মামুর অস্ফুট আওয়াজ শোনা গেল, “মিঠাই?”
পুনম শুনেছে। জানিয়ে দিলো, “আমার ডাকনাম, বাড়িতে আমাকে সবাই এই মিঠাই নামেই ডাকে। আপনি আমার বিজনেস কার্ডে যা দেখলেন, সেটা মিথাই নয়, মিঠাই হবে।“
– স্যার, পরিচয় করিয়ে দি। কাকুর নাম খরাজ সরকার। আর ইনি আমার কাকীমা, ভালো নাম অপরাজিতা, আমি ছোট্ট করে কাকীমা নামেই ডাকি।
খরাজবাবু বললেন, “আর এই মেয়েটিকে আমার দেওয়া নাম মোমের পুতুল, আমার গিন্নী ডাকেন মিঠাই।“
মামুও নিজের পরিচয় দিলো, “আমার নাম দেবপ্রসাদ দে।“
কাকীমা বললেন, “আপনি একটু সময় দিন দেববাবু, আমি এক্ষুনি আপনার জন্য পরোটা, আর আলুভাজা বেগুনভাজা করে নিয়ে আসছি। এতে আপনার দুপুরের খাওয়াও কিছুটা হয়ে যাবে।“

ভদ্রমহিলা ভেতরে চলে গেলেন। মামুর কৌতুহল, “এত বাঙালী বা ভারতীয় নাম থাকতে মোনালিসা নাম কেন?”
প্রশ্নের সাথে সাথেই মিঠাইএর উত্তর,”কাকু, আমি বলি?”
– বল, বল, সবাই তো জানে, লুকাবি কেন?
– তবে শুনুন স্যার। চিঙড়িকাকুর অল্পবয়সের প্রেমিকার বাবা ছিলেন জাঁদরেল ব্যাবসায়ী, ওনার মেয়ে মোনালিসার সাথে বিয়ে হলো না, কাকু সেই জেদ নিয়ে কলকাতার গলফগ্রীণে মোনালিসার শ্বশুরবাড়ির সামনেই এক বড় রেস্তোরাঁ খুলে বসলো, নাম দিলো মোনালিসা কাফে। এখানেও সেই একই নাম দিয়েছে। কি কাকু? ঠিক বললাম?
মামু প্রসঙ্গ পাল্টে জানালো, “খরাজবাবু, কাল আপনার মোমের পুতুল কিন্তু নিজের নামের গান আমাকে গেয়ে শুনিয়েছে, আই মীন ইভনিং ডেজার্ট প্রোগ্রামে। অসাধারণ গেয়েছে, আমি এরকম গান এই সুদূর কায়রোতে বসে ভাবতেই পারি না।“
– ও কি পুরোটাই গেয়েছে? না আদ্ধেক?
মিঠাই শুধরে দিলো, “গান আমি পুরোটাই গেয়েছি। বাকীটুকু তো কবিতা, সে আমি এখনই শুনিয়ে দিচ্ছি।“
মিঠাই আবৃত্তি করে শোনালো

দোলে রে গলে দোলে তার, খেজুর-মেতীর সোনার হার,
ছন্দ-দোদুল।
মিশরের আনন্দ সে, চপল ‘রমল’ ছন্দ সে,
জিয়ানো মিছরি-রসে তার হাসি অতুল।
নারঙ্গী-আঙুরবাগে তার গান গাহে বুলবুল॥
মরীচিকা-মায়া সে দেয় না ধরা, ছায়া সে,
পালিয়ে সে যায় সুদূর।
যায় নেচে সে নটিনি নীল দরিয়ার সতিনি
দুলে দুলে দূরে সুদূর॥

রান্নাঘর থেকে ভদেমহিলা বেরিয়ে এলেন, “শুনি, এটা কি ভালো হচ্ছে? মিঠাই গান গাইবে, আর আমি কিচেনে বেগুন ভাজবো?”
মিঠাই হেসে ফেললো, “না কাকীমা, তুমিও বসো। তোমার জন্য, আর স্যারের জন্য আমি অন্য একটা গান শোনাই।“
এবার সে ধরলো

রুম্ ঝুম্ ঝুম্ ঝুম্ রুম্ ঝুম্ ঝুম্
খেজুর পাতার নূপুর বাজায়ে কে যায়।
ওড়না তাহার ঘূর্ণি হাওয়ায় দোলে
কুসুম ছড়ায় পথের বালুকায়।
তার ভুরুর ধনুক বেঁকে ওঠে তনুর তলোয়ার,
সে যেতে যেতে ছড়ায় পথে পাথর-কুচির হার।
তার ডালিম ফুলের ডালি গোলাপ গালের লালি
ঈদের চাঁদ ও চায়।
আরবি ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে, বাদ্‌শাজাদা বুঝি
সাহারাতে ফেরে সেই মরীচিকা খুঁজি
কত তরুণ মুসাফির পথ হারালো, হায়
কত বনের হরিণ মরে তারি রূপ তৃষায়।

কথায় কথায় সময় কেটে যায়। মামু খুবই তৃপ্তি করে পরোটা আর আলু বেগুন ভাজা খেলেন। পেমেন্ট দেবেন, কিভাবে দেবেন ভাবছেন। খরাজবাবু ধরে ফেলেছেন, “আপনি কি ভাবছেন? আমি মোমের পুতুল আর তাঁর অতিথির থেকে দাম নেবো?”
এবার মামু বিদায় নেবেন, খরাজবাবু বললেন, “কাল দুজনেই আসুন, ভাত আর মাছের ঝোল খাওয়াবো, তবে পয়সা নেবো না, এই শর্তে।“

মামু বাইরে এসে বললেন, “মিঠাই, আমি একটা আরবী মিউজিক ইন্সট্রুমেন্ট শপে যেতে চাই।“
মিঠাই একটা বড় দোকানে নিয়ে এলো। সারা দোকানের ক্যাবিনেট আর দেওয়াল জুড়ে বিভিন্ন রকমের আরবী বাদ্যযন্ত্র সাজানো। মামুর পছন্দ হার্প, অনেকদিনের শখ যে একটা হার্প কিনে বাড়িতে নিজেই শিখবেন। কিন্তু তিনি নিজে গুণাগুণ যাচাই করতে পারবেন না। দোকানী তখন নিজেই কয়েকটি বিভিন্ন দামের হার্প খানিক বাজিয়ে শোনানোর পর মিঠাই দোকানীর সাথে কথা বলে, একটা পছন্দ করে দিলো।

এবার বাইরে এসে মামু বললেন, “মিঠাই, আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে, তুমি এত ভালো বাংলা কিভাবে শিখলে?”
সে হাল্কা ছলে উত্তর দিলো, “স্যার, গতকাল যে বললাম, আমি বাঙালী।“
– না না, সে অন্য কথা। আমি অনেক দেশ ঘুরেছি, কিন্তু এত বড় চমক আমি কোথাও পাইনি। মিশরে তো আর বাংলা স্কুল নেই যে বাংলা শিখবে। এখানে বড় হয়ে বাংলা শেখা অত সহজ নয়, তোমার কথা আমাকে বলতেই হবে।
– তাহলে তো আজ আর ঘুরে বেড়ানো হবে না। যদি কফি খেতে রাজি থাকেন, তাহলে কফি খেতে খেতে বলতে পারি।

কাছেই এক কফি শপে গিয়ে দুজনে বসলেন। “স্যার তাহলে শুনুন, আমরা কয়েক পুরুষের বাঙালী, আমরা…… “
কি মনে করে মামু থামিয়ে দিলেন, “মিঠাই, তুমি যেমন খরাজবাবুর ফ্যামিলিকে কাকু কাকীমা বলে ডাকলে, আমাকে তেমনি মামু বলে ডাকতে পারো।“
– মামু? কিন্তু বাঙালীরা সবাই তো কাকু সম্বোধনটাই ব্যাবহার করে।
– আমার ব্যাপারটা অন্যরকম। আমাকে ছোটবেলা থেকেই সবাই মামু বলে ডাকে।
মিঠাইএর হঠাতই ভুরু দুটো কুঁচকে গেলো। সামনের দিকে খানিক ঝুঁকে বললো, “মামু? ……… সবাই আপনাকে মামু বলে ডাকে?”
মামুর মনে হলো প্রশ্নের মধ্যে কিরকম যেন মাত্রাতিরিক্ত কৌতুহল। “মামু, একবার আপনার পাসপোর্টটা দেখাবেন?”
মামু একটু সতর্ক হলেন, হঠাত সে পাসপোর্ট দেখতে চায় কেন?
– আচ্ছা, আপনাকে পাসপোর্ট দেখাতে হবে না। শুধু একটা কথা বলুন। গতকাল হোটেলে আপনার চেক ইনের সময়, আমি যদি সঠিক মনে রাখি, তাহলে পাসপোর্টে আপনার ঠিকানা আছে এন্টালি কনভেন্ট রোড। আর তাই যদি হয়, তাহলে আমার দাদুকে, আমার বাবাকে আপনি নিশ্চয়ই চিনবেন। মানে আমার মনে হয় যে আপনি হয়তো চিনবেন।

এবার মামুর ভুরু দুটো কুঁচকে গেলো। “কি নাম তোমার দাদুর?”
– সোহম আলি, আর আমার বাবার নাম চন্দন আলি।
মামুর আর কফি খাওয়া হলো না। কফির মগ হাতেই রয়ে গেলো। কি বলে মেয়েটি? মাত্র একদিনের চেনা এই মেয়েটি? সোহম আলি, ওনাকে মামু ছোটবেলায় কাকু বলে ডাকতো, আর চন্দন ছিলো তাঁর কলিন্স ইন্সটিটিউট স্কুলের ক্লাসমেট। ওঁর জন্মের সময় নাম দেওয়া হয়েছিলো মনু আলি, কিন্তু ভর্তির সময় স্কুল থেকে বলে এটা সাধারণত ডাকনাম, তাই যদি অন্য ভালো নাম দেওয়া যায়। তখন নাম দেওয়া হয় চন্দন। বাড়িতে পাড়ায় সবাই মনু নামেই ডাকতো, ছোটদের কাছে ছিলো প্রিয় মনু’দা। কিন্তু না, অতীতের এসব কথা এখনই এই মেয়েকে বলা যাবে না।

ঈশ্বরের কি ইচ্ছা? তাঁর আজীবন স্কুলের বন্ধু, পাড়ার বন্ধু মনু’র মেয়ে আজ পঞ্চাশ বছর বাদে সুদুর বিদেশে তাঁর সাথে গল্প করছে, যে কিনা চব্বিশ ঘন্টা আগেও ছিলো সম্পূর্ন অপরিচিতা। মামুর পঞ্চাশ ষাট বছর আগের অতীতের কথাগুলো মনে পড়ে গেলো। মনু’র এক ছোট বোন ছিলো, মমতা, খুব ভালো নাচতো, গানেও খুব উৎসাহ ছিলো। মামুর মনে দ্বিধা অথচ প্রবল কৌতুহল, কি করে জানা যায় মমতা এখন কোথায় আছে, কেমন আছে?

মিঠাই নিজেই সমাধান করে দিলো। “আচ্ছা মামু, আমার দিদিমাকে তোমার মনে আছে?”
– হ্যাঁ, খুবই মনে আছে।
– আর মমতা, আমার পিসিকে?
মামুর উত্তর ক্ষণিকের জন্য হলেও দেরী হয়ে গেলো, কিন্তু মিঠাই সেটা খেয়াল করেছে। মামুর ধারণা মিঠাই হয়তো পিসির পুরনো দিনের কথা শুনেছে। এবং এখন ইচ্ছে করেই এই প্রশ্ন করেছে। মামু নিজের অজান্তেই “তুমি” থেকে “তুই” সম্বোধন শুরু করে দিলেন। “হ্যাঁ, তোর পিসিকে আমার মনে আছে। সে এখন কোথায়?”
– আছে, অন্য এক শহরে। একলাই থাকে, বিয়ে করেনি।
আবার মামুর ভুরুদুটো কুঁচকে গেলো। “বিয়ে করেনি? কেন?”
– যার সাথে ছোটবেলা থেকে ভালোবাসা ছিলো, সে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চলে গেলো, আর তারপর কেমন যেন ছেলেটা হারিয়ে গেলো। কোন যোগাযোগই সে রাখলো না। ততদিনে আমার দাদু কলকাতা থেকে কায়রো চলে এলেন। থাক এসব কথা, তোমার কথা বলো। মামী কি করে? আর তোমার ছেলেমেয়েরা?
এবার মামু হেসে উঠলেন, “নারে, আমার মামী বলে কিছু নেই। আমিও বিয়ে করিনি।“
– তুমি বিয়েই করো নি? কেন?
মামু আবার হেসেই প্রশ্নটা উড়িয়ে দিলেন, কোন উত্তর দিলেন না।

বিকেল হয়ে আসছে, মিঠাই বললো, “মামু, চলো তোমাকে এক জায়গায় নিয়ে যাই। ওখানে খুব ভালো ভালো ইজিপশিয়ান সেলাইয়ের কাজ দেখতে পাবে। সব হাতের কাজ, এমব্রয়ডারি। এখান থেকে একটু দূরে, তাই এখনই রওয়ানা দিতে হবে।“

দুজনে গাড়িতে রওয়ানা দিলেন। মিঠাই জানালো, দাদুই তাকে ছোটবেলা থেকে বাংলা শিখিয়েছেন। স্কুলে আরবী আর ইংলিশ, আর বাড়িতে দাদুর কাছে, বাবার কাছে বাংলা শিখেছে। বাংলা গান কবিতা শিখেছে পিসির কাছে।

আধঘন্টা মতন হবে, গাড়িটা একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো। বাড়ির দরজা খোলা, ঘরে ঢুকেই মামুর মনে হলো এটা বোধহয় কারোর বাড়ি হবে। একজন বয়স্ক মানুষ বেরিয়ে এলেন।
মিঠাই বললো, “এটা আমাদের বাড়ি। মামু, তোমাকে আমি কিন্তু সত্য বলিনি, তাহলে হয়তো তুমি আমাদের বাড়িতে আসতেই রাজি হতে না।“
আর বয়স্কজনকে বললো, “বাবা, ভালো করে দেখো তো, চিনতে পারো কি না?”
না, মনু, মানে চন্দন চিনতেই পারছে না।
– বাবা, তোমার কনভেন্ট রোডের বন্ধু, তোমার স্কুলের বন্ধু, পঞ্চাশ বছর আগের, মনে করার চেষ্টা করো।
মামু চুপ করে দাঁড়িয়ে আছেন। মনু অনেকক্ষণ ধরে দেখে চিন্তা করে বললেন, “মামু? দেবপ্রসাদ?”
মামু হেসে মাথা নেড়ে জানিয়ে দিলো, সঠিক।
– আরে মিঠাই, এঁকে তুই কোথায় পেলি?
– ট্যুরিস্ট, বেড়াতে এসেছেন। আর আল্লা বলো বা ভগবান বলো, উনার কি খেলা দেখো বাবা, আমিই এনার গাইড। কথায় কথায় উনার পরিচয় পেয়ে গেলাম।

এরপর দুই বন্ধুর কথাই আর শেষ হয় না। সেই ছোটবেলার কথা, আর গত পঞ্চাশ বছরের দুজনের জমে থাকা কথা কে-কি-কেমন-কবে-কোথায়-কেন-কিভাবে ইত্যাদি একের পর এক প্রশ্নের যেন আর শেষই হতে চায় না।

দুজনের খেয়ালই নেই, প্রায় একঘন্টা হয়ে গেছে। এমন সময় চায়ের ট্রে নিয়ে একজন মহিলা এলেন। শুধু চা নয়, বেশ কিছু খাবারও আছে। মনুই পরিচয় করে দিলো, “মামু, মমতাকে তোর নিশ্চয়ই মনে আছে?”
মামু হতবাক। কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। শুধু জানালেন, “হ্যাঁ, মিঠাই আমাকে বলেছে।
মমতা বললেন, “এও বলেছে যে তোমাকে সত্য কথা, মানে আমি যে এখানে আছি সে কথা বলে দিলে তুমি হয়তো আসতে রাজিই হতে না।“

মামু চুপ করে মমতার মুখপানে তাকিয়ে রইলেন। আর মমতা খুব সুন্দরভাবে পরিবেশটাকে অত্যন্ত সহজ করে দিলেন। “তোমার তো চায়ে দুধ চিনি বেশি পরিমানেই খাওয়ার অভ্যেস। তাই দু’ চামচ করে দিয়েছি। আর হ্যাঁ, মিঠাই দুটো সত্যি কথা বলেছে। আমি এখন হাতের সেলাইএর কাজ করি। স্কুল খুলেছি। আর বাংলা গানও আমিই ওঁকে শিখিয়েছি।“

মামু আবার মমতার মুখপানে তাকিয়ে দেখলো। সামান্য হেসেই জবাব দিলো, “এই পঞ্চাশ বছরে কত কিছুই বদলে গেছে, কিন্তু তুমি আমার চায়ে কিকি চাই, তার তো কিছুই তুমি ভোলোনি।“
পরিবেশ আরও সহজ করে দিতে মমতা ওখানেই বসে গল্প জুড়ে দিলো। মমতা যতটা স্বাভাবিক, মামু ততটাই যেন অপ্রস্তুত। “তোমার কথা বলো মামু’দা, কেমন সংসার করছো?”
মামু প্রশ্নের উত্তর দিলেন না। মাথা নীচু করে মাথা নাড়িয়ে নীরবেই বুঝিয়ে দিলেন যে উনি বিয়ে করেন নি। প্রশ্ন করলেন, “তুমি তো ভালো গান গাইতে। এখন কি গাও? না ছেড়ে দিয়েছো?”
মিঠাই এর জবাব দিলো, “হারমোনিয়ামে নয়, তবে মাঝেসাঝে ইচ্ছে হলে খালি গলায় গায়।“
মামুও সেই অতীতে ফিরতে চাইছেন, “তাহলে একটা শোনাও।“
মমতা রাজি নয়, আর মিঠাই চেপে ধরেছে, একটা গাইতেই হবে। অগত্যা মমতা কয়েক লাইন খালি গলায় গাইতে রাজি হলেন,

পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কিরে হায়
ও সেই চোখের দেখা প্রাণের কথা সে কি ভোলা যায়
আয় আর একটি বার আয়রে সখা প্রাণের মাঝে আয়
মোরা সুখের দুখের কথা কব প্রাণ জুড়াবে তায়
মোরা ভোরের বেলা ফুল তুলেছি দুলেছি দোলায়.
বাজিয়ে বাঁশি গান গেয়েছি বকুলের তলায়
হায় মাঝে হল ছাড়াছাড়ি গেলেম কে কোথায়
আবার দেখা যদি হল সখা প্রাণের মাঝে আয়

চা জলখাবার শেষে রওয়ানা দেবার সময় মিঠাইও এসে গাড়িতে উঠলো, মামু মানা করলেন। মিঠাই মানলো না। “মামু, আমাদের নিয়মে তোমাকে নিরাপদে হোটেলে পৌঁছে দিয়ে তবেই আমার দিনের ছুটি, তার আগে নয়।“

গাড়িতে মামু পিছনের সীটে হেলান দিয়ে চুপ করে বসে আছেন। দুটি চোখ বন্ধ, একটাও কথা বলছেন না। “মামু, কথা বলছো না কেন?”
মামু যেন সম্বিত ফিরে পেলেন। কিন্তু কিছু বললেন না।
“মামু, তোমার ছোটবেলার কথা নিশ্চয়ই মনে পড়ছে। তাহলে একটা রবীন্দ্রসংগীত গাইছি, কথাগুলো খুব মন দিয়ে শোনো।“

আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে
দেখতে আমি পাই নি।
তোমায় দেখতে আমি পাই নি।
বাহির-পানে চোখ মেলেছি,
আমার হৃদয়-পানে চাই নি।
আমার সকল ভালো বাসায়
সকল আঘাত সকল আশায়
তুমি ছিলে আমার কাছে,
আমি তোমার কাছে যাই নি।
তুমি মোর আনন্দ হয়ে ছিলে আমার খেলায়-
আনন্দে তাই ভুলেছিলেম, কেটেছে দিন হেলায়।
গোপন রহি গভীর প্রাণে আমার দুঃখ সুখের গানে
সুর দিয়েছ তুমি
আমি তোমার গান তো গাই নি।
আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাই নি।
তোমায় দেখতে আমি পাই

মামু চোখ বন্ধ করে গান শুনছিলেন। গান শেষ হয়ে গেলো, মামু তখনও কিছু বলছেন না। চুপ করে সীটে হেলান দিয়ে বসে আছেন। মিঠাই এগিয়ে এসে দেখলো, “মামু, তুমি কাঁদছো?”
মামু হেলান ছেড়ে উঠে একটু এগিয়ে এসে বসলেন। হাতের তালুতে চোখের জল মুছে নিলেন।

পরদিন সকালে মিঠাই হোটেলে গিয়ে লবি থেকে খবর দিতেই মামু নিজের রুমে ডেকে নিলেন। পুনম গিয়ে দেখে,মামু জানালার পাশে বসে আছেন। মিঠাইকে দেখে হাসলেন, কিছু বললেন না।
– মামু, সকালে কিছু খেয়েছো?
– হ্যাঁ রে খেয়েছি, এখন একটু কফি খেতে ইচ্ছে হচ্ছে রে। বানিয়ে দিবি?

রুমে কফি বানানোর সরঞ্জাম ছিলোই। মিঠাইই বানিয়ে দিলো। “এই নাও, একটু বেশি করেই দুধ আর চিনি দিয়েছি।“
মামু মিঠাইএর দিকে তাকিয়ে হাসলেন। কিছু বললেন না। মিঠাইএর বয়স কম হলেও মনস্তত্ব খুব ভালো বোঝে।
– মামু, তুমি যা হারিয়েছিলে, সে তো খুঁজে পেয়েছো। তাহলে মন খারাপ করছো কেন?
মামু কিছুই বলছেন না, কফিতে চুমুক দিলেন।
– মামু,তুমি কেমন যেন? আমি তাহলে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের একটা গান দিচ্ছি, ইউটিউব থেকে। কফি খেতে খেতে এই গানটা শোনো।

তুই ফেলে এসেছিস কারে, মন, মন রে আমার।
তাই জনম গেল, শান্তি পেলি না রে, মন, মন রে আমার।।
যে পথ দিয়ে চলে এলি
সে পথ এখন ভুলে গেলি–
কেমন করে ফিরবি তাহার দ্বারে মন, মন রে আমার।।
নদীর জলে থাকি রে কান পেতে,
কাঁপে রে প্রাণ পাতার মর্মরেতে
মনে হয় যে পাবি খুঁজি
ফুলের ভাষা যদি বুঝে
যে পথ গেছে সন্ধ্যা তারার পারে মন, মন রে আমার।।
তুই ফেলে এসেছিস কারে, মন, মন রে আমার।
তাই জনম গেল, শান্তি পেলি না রে, মন, মন রে আমার।।

এবার মামুর মুখে যেন একটু হাসি দেখা দিলো।
– চলো, মামু, এখন কোথায় ঘুরতে যাবে বলো?
মামু নির্লিপ্ত। “নারে, এখন কোথাও যাবো না। আজ রাতেই ইন্ডিয়া ফিরে যাবো।“
পুনম অবাক। “আজকেই ফিরে যাবে? তোমার তো আরও তিনদিন থাকার কথা। আর আজ দুপুরে কাকুর ওখানে মাছভাত খাবে না?“
– মাছভাত খেতে নিশ্চয়ই যাবো, কিন্তু ফিরে যাচ্ছি অন্য কারণে।
– কি কারণে, আমার কি কিছু ভুল হয়েছে?
পুনম ভয় পেলো, সে কি কিছু অন্যায় করেছে? মামু হাসতে শুরু করলেন। আর পুনম অধৈর্য হয়ে উঠছে।
– না রে, আজই ফিরে যাবো, বাড়িতে গিয়ে অনেক কাজ আছে।
– মানে? কি এমন কাজ যে এখনই গিয়ে করতে হবে?
– কারণ বাড়িতে আমি একা থাকি, অনাদরে একেবারে অগোছালো হয়ে আছে। গিয়ে সবকিছু ঠিকঠাক করতে হবে। তারপর আবার আসবো। একলাই আসবো, কিন্তু ইচ্ছে আছে,যদি ভগবানের আশীর্বাদ থাকে, তাহলে ইন্ডিয়া ফিরবো, কিন্তু আর একলা নয়। এখন দেখতে হবে, সেই সুযোগ কি হবে?

পুনম লাফিয়ে উঠলো। “ইয়াআআআআআ, মাম্মম্মুউউ, ইউ আর মাই গ্রেট মাম্মুউউ”। বলেই মামুর দুই গালে দুই চুমু।
– আমি বুঝতে পেরেছিলাম মামু, তুমি তোমার হারিয়ে যাওয়া সোনার মেডেল ঠিক নিয়ে যাবে।
এই বলে মামুর সামনে নেচে নেচে গাইতে শুরু করলো

গোপন কথাটি রবে না গোপনে,
উঠিল ফুটিয়া নীরব নয়নে।
না না না, রবে না গোপনে॥
বিভল হাসিতে বাজিল বাঁশিতে,
স্ফুরিল অধরে নিভৃত স্বপনে–
না না না, রবে না গোপনে॥
মধুপ গুঞ্জরিল,
মধুর বেদনায় আলোক-পিয়াসি
অশোক মুঞ্জরিল।
হৃদয়শতদল
করিছে টলমল
অরুণ প্রভাতে করুণ তপনে।
না না না, রবে না গোপনে॥

মামুও হাসছেন, খুবই ভালো লাগছে।
মুখে কপট রাগে বললেন, চ্যাঙরামো হচ্ছে?
– না স্যার, অহো সরি সরি, এখন তো পিসেমশাই বলতে হবে। খুব আনন্দ হচ্ছে পিসেমশাই।

********

https://www.youtube.com/watch?v=qq1E1zNBhwA
মোমের পুতুল মমীর দেশের মেয়ে নেচে যায়

https://www.youtube.com/watch?v=gLFGgjLTADE
রুম্ ঝুম্ ঝুম্ ঝুম্ রুম্ ঝুম্ ঝুম্ খেজুর পাতার নূপুর বাজায়

https://www.youtube.com/watch?v=REaFW9ZXRIk
আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে তোমায় পাইনি

https://www.youtube.com/watch?v=HlnYB0F-gvw
তুই ফেলে এসেছিস কারে মন রে আমার

পাঠকদের কাছে আবেদন জানাই, আমরা সকলেই যেন মামু ও মোমের পুতুলের পিসির দীর্ঘ সুখের দাম্পত্য জীবন কামনা করি।

***********

Asim Deb

Add comment