অচেনা ভিয়েতনাম – চতুর্থ অধ্যায়
অষ্টম পর্ব
@Asim Deb
হা লং বে (Ha Long Bay – Cat Ba দ্বীপপুঞ্জ)। Vietnamese: Vịnh Hạ Long. Quảng Ninh প্রদেশের এই পর্যটক কেন্দ্রটি এখন ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। হা লং কথার অর্থ অবরোহী ড্রাগন (descending dragon).
Gulf of Tonkin এর প্রায় ১৬০০ পাহাড়ি দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে এই হা লং বে, সমুদ্রের মাঝে চারিদিকে চুনাপাথরের স্তুপ। এই স্তুপগুলোই ছোটবড় সব পাহাড়ি দ্বীপ, সংখ্যায় ১৬০০। অনেক দ্বীপ আছে যেগুলি ভৌগলিক অর্থে গুহা। জনমানবশুন্য এই দ্বীপগুলিতে মানুষজন থাকে না। কিছু বিশেষ অঞ্চলে ফ্লোটিং ফিশিং ভিলেজ আছে, তাঁরা সকলেই মৎস্যজীবী। আর এখানের ইকোসিস্টেম সহজ ইংরেজিতে বলাই ভালো, home to threatened endemic species such as the Cat Ba Langur (Trachypithecus poliocephalus), the Cat Ba Tiger Gecko (Goniurosaurus Catbaensis), and the Asian Small-clawed Otter (Aonyx cinerea).
প্রায় ১,৫৩৩ বর্গ কিলোমিটার (৬০০ স্কোয়ার মাইল) অঞ্চল জুড়ে চূনাপাথরের এই স্তুপগুলির গঠন হয়েছে আনুমানিক প্রায় দুই লাখ বছর ধরে। বায়োসিস্টেমের ভাষায় এখানে আছে ১৪টি বিশেষ প্রজাতির ফুল আর প্রায় ৬০টি বিশেষ প্রজাতির প্রাণী। গবেষণা করে তথ্য পাওয়া যায় যে আনুমানিক খৃষ্টপূর্ব ১৮,০০০ – ৭,০০০ বছর সময়কালে এখানে প্রাণীর অস্তিত্ব ছিলো।
হা লং বের জনসংখ্যা খুবই কম, আনুমানিক দেড় হাজারের কিছু বেশি, প্রধানত Cửa Vạn, Ba Hang and Cặp Dè fishing villages (Hùng Thắng Ward, Hạ Long City) অঞ্চলে। আর সমুদ্রের অনেকটাই ভেতরে মৎস্যজীবীরা একটি জায়গায় আছে, Làng Chài Floating Fishing Village. এখানের মাছদের তিন বছর ধরে প্রতি একদিন বাদ দিয়ে দিয়ে খাওয়া দিতে হয় যাতে সেগুলি পূর্ন ওজনে বেড়ে উঠতে পারে। বড় এবং স্থানীয় চাহিদায় সুস্বাদু মাছগুলি এখানের বড় বড় হোটেল ও রেস্তোরাঁয় কিলো প্রতি তিন লাখ ভিয়েতনামী দং (ডলার) দরে বিক্রী হয়। ফলে এখানের মৎস্যজীবী বাসিন্দাদের জীবনযাত্রার মান বেশ ভালো, এবং নিজেদের কটেজ বানিয়ে ট্যুরিস্টদের জন্য তাঁরা সস্তায় হোম স্টে’র ব্যাবসাও করে।
হা লং বে নিয়ে কিছু পৌরাণিক কাহিনীও চালু আছে। কথিত আছে, বহিরাগত শত্রুর আক্রমণ রুখতে ভগবান ড্রাগনের রূপে অবতীর্ন হয়ে মণিমুক্তা বর্ষন করেন যা পরে সমুদ্রের মাঝে দ্বীপের আকার নেয়, এবং বহিরাগতদের বিরুদ্ধে প্রাচীরের আকার ধারণ করে। বিশ্বাস যে, এই দ্বীপগুলো হঠাৎই সমুদ্র থেকে উঠে এসে শত্রুর জাহাজের সামনে এসে দাঁড়ান। শত্রুদের পরাস্ত করে যুদ্ধশেষে ড্রাগনেরা এখানেই থেকে যান। যেখানে মা ড্রাগন অবস্থান করেন, সেই জায়গার নাম হা লং, আর তাঁর সন্তানেরা অবস্থান করেন Bái Tử Long দ্বীপে।
আজকের সফরে আমরা যাবো হা লং বে, হ্যানয় শহর থেকে গাড়িতে ১২০ কিলোমিটার। সকাল আটটার সময় গাড়ি আসবে, তাই আজ সাত তাড়াতাড়ি উঠেই ব্রেকফাস্ট খেয়ে আমরা তৈরি। আমার এই নিয়ে লাগাতার প্রায় দশদিন ধরে চলছে রোজ সকালে ব্রেড, তাতে পুরু মাখনের প্রলেপ, সময়বিশেষে তার উপর জ্যাম, সাথে ডাবল ডিমের অমলেট, লোভে পড়ে গেলে ছোট একটা কেক, আর কফি। এমনই ঠেসে খাওয়া যে দুপুরে বাইরে খাওয়ার দরকারই পড়ে না। গলা ভেজাতে হলে চা, কফি বা ডাব, সঙ্গে হয়তো কিছু কুকিস।
ঠিক আটটার সময় রওয়ানা দিলাম। দু’দিকে সুন্দর মসৃণ ফোর লেন; ৫৭২ মিলিয়ন ডলার খরচ করে হ্যানয় থেকে হা লং বে এই ১২০ কিলোমিটার এক্সপ্রেসওয়ে তৈরি হয়েছে। সারা রাস্তায় মাঝখানে ডিভাইডার, মানুষ বা সাইকেল দূরের কথা, একটা কুকুরও লাফিয়ে ডিঙিয়ে অন্যদিকে যেতে পারবে না। মাইলের পর মাইল লম্বা এই ডিভাইডার। অন্যদিকে যেতে হলে দশ বারো মাইল গিয়ে ফ্লাইব্রিজে চড়ে অন্যদিকে যেতে হবে। আরও একটা সুন্দর ব্যাবস্থা দেখলাম। রাস্তায় যেখানে যেখানে ফুডকোর্ট, বা পেট্রল স্টেশন বা রেস্ট সেন্টার আছে, রাস্তার ঠিক উল্টোদিকেও সেই একই ব্যাবস্থা করা আছে। মানে খিদে পেয়েছে, রাস্তার অন্যদিকে ফুডকোর্ট, অথচ আমাদের দিকে নেই, এই হতাশা বা অভিযোগ করা যাবে না।
রাস্তায় দেখলাম খানিক পরে পরেই উপরে হোর্ডিং, কোন লেনে গাড়ি কত স্পীডে যাবে। দেখলাম যখন আমাদের গাড়ি ১২০ কিলোমিটার স্পীডে যাচ্ছে, তখন এক লেনে, আবার ৮০-১০০ কিলোমিটারে চালালে তখন অন্য লেনে চলে আসতে হবে। তাই ওভারটেক করার সময় প্যাঁ পোঁ হর্ন বাজাতে হয় না। মোটামুটি ১২০ স্পীডেই গাড়ি দৌড়ালো, আমি ছিলাম ফ্রন্ট সীটে, ভয় যে মাঝে মাঝে করছিলো না, তেমন নয়। তবে খুবই ভালো ড্রাইভার। আমাদের যেতে সময় লাগলো ঘণ্টা দেড়েকের মতন, মাঝে একবার মিনিট দশেকের টয়লেট ব্রেক নিয়েছিলাম। পাবলিক টয়লেট, কিন্তু এক্কেবারে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। মানে খুব নাক সিটকানো লোকও মানবে যে হ্যাঁ, পরিচ্ছন্ন বটে। এই সবই ট্যুরিস্টদের চাহিদা চিন্তাভাবনা করে।
হা লং বে পৌঁছানোর আগে সমুদ্রের খাঁড়ির উপর দিয়ে একটা লম্বা ব্রিজ পেরোতে হয়। দেখলাম দূরে অনেকগুলো জাহাজ নোঙর করা, আর জমিতে warehouse এর মতন অনেকগুলো বিল্ডিং, আর ভারী ভারী ক্রেন। ড্রাইভার জানালো উত্তর ভিয়েতনামের এটা একটা মাঝারি সাইজের বন্দর। প্রধানত Cargo জাহাজের।
এবার আমরা শহরের ভেতরে চলে এসেছি। একদিকে সমুদ্র, অন্যদিকে মডার্ন বাড়িঘর, একটু দূরে আছে ২০-২৫ তলা অনেক মাল্টিস্টরিড ফ্ল্যাট। উচ্চবিত্ত যে সকল লোকেরা এখানে হোটেল, ট্রান্সপোর্ট, ট্রেডিং এর ব্যাবসা করেন, তাঁরাই থাকেন। কিছু লোকজন বিনিয়োগ করে রেখেছেন, মাঝেমধ্যে এসে থাকেন।
আরেকটু এগিয়ে রাস্তার ডানদিকে লাইন দিয়ে সব হোটেল, আর ফুডকোর্ট। লাইন দিয়ে মানে প্রায় গোটা ত্রিশ চল্লিশেক হোটেল ফুডকোর্ট। প্রচুর কার পারকিং স্পেস। বুঝলাম, সিটি প্ল্যানিং এর সময় এই নিয়েও সুন্দর ভাবনাচিন্তা করা হয়েছিলো। খানিক এগিয়ে এম্যুজমেন্ট পার্ক। ফ্লাই হুইল, ওয়াটার স্পোর্টস, রোপওয়ে এসব আছে। বিনোদনের প্রচুর উপকরণ। হা লং বে সমুদ্রতীরের একটি পর্যটন কেন্দ্র, পর্যটনই এখানের অর্থনীতির একমাত্র অবলম্বন। হা লং বে দেখার পরে আমরা যদি দীঘার সাথে তুলনা করি,তাহলে দীঘাকে আদৌ একটি ভালো পর্যটন কেন্দ্র করে তোলার সদিচ্ছা সরকারের কোনোদিন ছিলো কিনা, সেই প্রশ্নটাই উঠে আসে। অথচ দুটিরই দন্ডমুন্ডের কর্তারা ছিলেন একই রাজনৈতিক চিন্তাধারার লোকজন।
এখানে একটি কথা বলে রাখি। এখানে যেমন অতি ধনী সম্প্রদায় বিনিয়োগ করছেন, সরকারের তরফ থেকে ট্যুরিজমের জন্য প্রচুর খরচ হচ্ছে, ছোট্ট এই পর্যটককেন্দ্রটিকে সুন্দর করে সাজানো হচ্ছে, একটু দূরেই কিন্তু পুরনো শহরটি একইরকম আছে। লোকজনের আশা, শীঘ্রই এখানেরও উন্নতি হবে।
ধীরে ধীরে গন্তব্যস্থলে পৌঁছে গেলাম। আমরা যাবো এম্বাসাডর ক্রূজে। ট্যুরিস্টরা যাতে হাটাহাটি করে ক্লান্ত না হয়ে যায়, সেইজন্য গাড়ি, বা বাস ব্রিজ দিয়ে সমুদ্রের অনেকটাই ভেতরে চলে আসে। এমনকি গাড়ি বা বাস পার্কিং এর ব্যাবস্থাও ব্রিজের উপরে, ফটোটা দেখলেই বোঝা যাবে। আমরা দশটার মধ্যেই ক্রূজে পৌঁছে গিয়েছিলাম। আমার বা আমার পরিবারের এই প্রথম ক্রূজ সফর। লাক্সারি ক্রূজ, ভেতরে ঢুকে এক ঝলকেই বুঝলাম আরামদায়ক ভালোই সফর হবে।
আমাদের সীট ছিলো দোতলায়, জানালার পাশেই। দোতলাই সবথেকে বড়। ওয়াইন বার, ডাইনিং স্পেস, মিউজিক হল, ড্যান্সিং ফ্লোর, সবই আছে। তিনতলায় আছে ওপেন লাউঞ্জ, ছোট একটা জিমনাসিয়াম, সুইমিং পুল, আর সাইড বার। অনলাইন বুকিং করার সময় দেখেছিলাম ব্রেকফাস্ট দেবে, কিন্তু উঠে জানলাম যে ওয়েবসাইট আপডেট করা হয় নি, দুঃখিত। ব্রেকফাস্ট হবে না। তবে চা, কফি আর সাথে কুকিস প্রচুর আছে। এই ক’দিনে আমার ভিয়েতনামের কফির উপর মোহ এসে গেছে। দু’তিন কাপ মেরে দিলাম। আর সকালে হোটেল থেকেই ঠেসে খেয়ে বেড়িয়েছি। এখন আর দরকার নেই। কিন্তু পয়সা যখন দিয়েছি, পছন্দের জিনিষ পেলে একটু চেখে দেখতে ক্ষতি কি? যাই হোক, ব্রেকফাস্ট হলো না।
কফি খেয়ে তিনতলায় সানডেকে এসে দেখি সারি সারি সোফা আর বেতের চেয়ার। নিজের সুখে সানবাথ নাও, অবশ্যই বস্ত্রসহ, বিনা বস্ত্রে নয়। আর অন্যদিকে এত প্রচন্ড হাওয়া যে স্কার্ট-গাউন পরিহিতা মহিলারা নিজেদের কাপড় আর সামলে রাখতে পারছেন না। মেরিলিন মনরোর সেই স্কার্ট উড়ে যাওয়ার দৃশ্য। স্কার্ট গাউন পড়া মহিলারা সোজা নীচে চলে যাচ্ছেন, বা সোফা/চেয়ারে গিয়ে বসে পড়ছেন।
খানিক পরেই প্রচন্ড রোদের জন্য অনেকেই সানডেক ছেড়ে নীচে চলে গেলেন, আবার কেউ বা হাতে বীয়ার নিয়ে আরাম করছেন। কিছু পরে পরেই ঝপাং ঝপাং আওয়াজ, সুইমিং পুলে কেউ ঝাঁপ দিলেন। সাইডে বীয়ার ক্যান। দু’বার জলে হাত পা ছুঁড়েই বীয়ার ক্যানের মোহে ফিরে এলেন। আবার জলে ফিরে গেলেন। আমরা নিজেদের আর চারিপাশের ফটো তুলছি, মাঝে আরেক কাপ ভিয়েতনামী কফি খেয়ে এলাম। মেয়ে এবার একটা কোক চাইলো, দাম দেখলাম জলের থেকে সস্তা। মানে তেষ্টা পেলে বেশি পয়সা দিয়ে জল খেয়ো না, বরং কোক খাও।
ঘন্টা দুয়েক পরে আমরা এলাম একটা গুহায়, Sung Sot (Surprise) গুহা। এখানে পৌঁছানোর আগে মাইকে বারবার বলে দিচ্ছিলো যে এই গুহায় ঢুকবার আর বাইরে বেরিয়ে আসবার রাস্তা আলাদা, আর অনেক দূরত্বে। গুহায় একবার ঢুকে গেলে, প্রায় পৌনে কিলোমিটার হেঁটে অন্য দরজায় আসতে হবে, বাইরে আসার অন্য কোন রাস্তাই নেই। আর গুহার ভেতরে চার’শ পাথরের সিঁড়ি চড়তে হবে, এক’শ সিঁড়ি নেমে আসতে হবে। মাইকে বারবার বলছে, যাঁদের হার্টের রোগ আছে, বা শারীরিকভাবে দুর্বল, তাঁরা যেন গুহার ভেতরে যাওয়ার আগে নিজেদের স্বাস্থের কথা চিন্তা করে। আর ছোট শিশুদেরও যেতে বারণ করছে। গুহার ভেতরে চড়াই উৎরাই disproportionate কারণ ভিয়েতনাম হেরিটেজ ডিপার্টমেন্ট গুহার ভেতরে কিছুই ভাঙাচোরা করতে দেয় নি। হেরিটেজ সাইটের চিন্তাভাবনায় অরিজিনাল যতটা বজায় রাখা যায় সেই চেষ্টায় নূন্যতম কাটাছেড়া করেছে, আর শুধু চড়াই উৎরাই এর রাস্তায় পাথরগুলোর উপর সিঁড়ির হাঁটাপথ বানিয়ে দিয়েছে। এর ফলে কোন কোন জায়গায় সিঁড়ি ছয় বা আট ইঞ্চি উঁচু, আবার কোন কোন জায়গায় এক ফুটের কাছাকাছি। হাঁটুকে কষ্ট দিয়ে ওঠানামা করতে হয়। গুহার ভেতরে বিভিন্ন জায়গায় হরেক রঙের হাল্কা আলোয় সুন্দরভাবে সাজানো, যেন এক মায়াবী জগৎ।
১৯০১ সালে ফ্রেঞ্চ পর্যটক এই Sung Sot Cave খুঁজে পান, এটি Halong Bay র সবথেকে বড় আর পরিচিত গুহা। 1938 সালের “Grotte Des Surprises” (The Cave of Surprises) বইতে এর উলেখ পাওয়া যায়। এর অন্যতম বৈশিষ্ট … Despite its unassuming entrance, the cave astounds visitors with its vast inner space, justifying its “Surprising” moniker. কিন্তু সাধারণ লোকের কাছে এর পরিচিতি হয় যখন ১৯৯৩ সালে এক প্রচন্ড ঝড়ে মাছে ধরার একটি ট্রেলর এই অজানা অচেনা গুহায় এসে আশ্রয় নেয়। তখন থেকেই এই Sung Sot গুহা Surprise Cave নামে পরিচিত হয়। ট্যুরিস্ট ডিপার্মেন্ট এসে সার্ভে করে আর ভেতরে কিছুটা জঙ্গল পরিস্কার করে দেয়, কিন্তু প্রকৃতির অরিজিনাল সৃষ্টি ধ্বংস না করে। আজকের দিনে এই Sung Sot (Surprise) গুহার আকর্ষণ অপরিসীম। এর দুটি প্রধান চেম্বার, একটি আকারে বড় থিয়েটার হলের মতন, চারিদিকে উপর থেকে প্রচুর stalactites ছড়িয়ে আছে, ভূগোলের সহজ কথায় বিভিন্ন আকৃতির long thin pieces of rock hanging down from the roof of a cave. সেখান থেকে সরু আঁকাবাঁকা গলিপথ দিয়ে দ্বিতীয় চেম্বারে আসতে হয়, এখানে ছাদের থেকে সামান্য কিছু সূর্যের আলো আসে। .
আমার অভিজ্ঞতায় বলি, যাঁদের হার্ট দুর্বল, বা হাঁটুর ব্যাথা আছে, এবং একদম কমবয়সীদের এই ট্রেকিং এ না যাওয়াই ভালো। এই চার’শ উঁচুনিচু সিঁড়ি চড়া সহজ কথা নয়, এমনকি সিঁড়ি দিয়ে নামার সময়েও বেশ কষ্ট হয়। তার উপর একটু যে ফ্যানের ঠাণ্ডা হাওয়া খাবো সে দুরস্ত। সবাই গরমে ঘেমে একশেষ। কখনও সিঁড়ি ভেঙে উঠছি, আবার নেমে আসছি। এই ওঠানামা চলছে। আবার খানিক পরে পেলাম সামান্য একটু ফ্ল্যাট মতন রাস্তা।
একটু পরে পরেই আমার হাঁটুতে টান পড়ছে, আর আমাকে খুঁজতে হচ্ছে কোথায় গিয়ে একটু বসা যায়? কিন্তু বসবো যে, সে ব্যাবস্থাই নেই। আগেই বলেছি, এদেশের সরকার যতটা সম্ভব এর হেরিটেজ ঐতিহ্য বজায় রেখেছে, আর্কিটেক্টের ভাষায় বলা যায় ইন্টিরিয়র ডেকরেশন করে অযথা প্রকৃতিকে সাজানোর চেষ্টা করে নি। তাই হাঁটুর খানিক বিশ্রাম দিতে পাথরের উপরেই বসতে হচ্ছে। কেউ কেউ সিঁড়ির উপরেই বসে পড়েছেন। ট্যুরিস্টরা একের পর এক সব আসছেন। একটা জিনিষ দেখলাম, খুব ভালো লাগলো যে এই অচেনা অপরিচিত পরিবেশে প্রত্যেকেই যেন একে অন্যের খেয়াল রাখছেন। কেউ বসে পরলেই অন্য একজন এসে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন। মানবধর্মের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। আর সবার শেষে আসছে ক্রূজের সার্ভিস গাইডের একটি ছোট দল, বিশেষ সতর্ক যে কেউ যেন আটকা না পড়ে। তবে গুহার ভেতরের সিঁড়ি বা রাস্তাটি এমনই যে সেই সরু রাস্তা ছেড়ে এদিক ওদিক যাওয়ার কোন উপায়ই নেই। তাই সার্ভিস গাইডের নজর এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব।
আমার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সময় লেগেছিলো প্রায় মিনিট চল্লিশ। তার মধ্যে অন্তত সাত আটবার আমি পাথরের উপর বসে বিশ্রাম নিয়েছিলাম। প্রত্যেককেই করতে হয়েছে। যখন বাইরে এলাম, ঘামে জামা চপচপ করছে, হাঁটু আর চলছে না। সঙ্গে জলের বোতল ছিলো। সেটা খুলতেই একজন সার্ভিসম্যান দৌড়ে এলো। প্লাস্টিক এখানে নিষিদ্ধ। জল খেয়ে খালি বোতল ওঁকে দিয়ে দিলাম। এবার প্রায় এক’শ সিঁড়ি ভেঙ্গে নীচে নেমে আসতে হবে।
ক্রূজে ফিরে এসে প্রথমেই এসির ঠাণ্ডা হাওয়ায় জল খেয়ে প্রাণে যেন শান্তি এলো। আমার চারিদিকে সকলেরই এক অবস্থা, তবে স্বীকার করতেই হয় এই গুহাদর্শন এক বিরল অভিজ্ঞতা, once in the lifetime experience বিশেষ করে প্রকৃতির প্রকৃত রূপকে একটুও বিনাশ না করে এভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা।
ডেকে নিজের সীটে ফিরে এলাম। আমাদের আশেপাশে বিভিন্ন রকমের গ্রুপ। সকলেই ক্লান্ত। কেউ দশ বারোজনের পরিবার, কেউ বা সদ্য বিয়ে করা যুগল। তাঁরা তো কাপল অফ দ্যা শো। ক্রমাগত একে অন্যর গায়ে ঢলে পড়ছে। চুম্বনের সিরিয়াল চলছে। একই গ্লাস থেকে দুটো স্ট্র নিয়ে কোক পান করছে। আড়চোখে দেখতে মন্দ লাগে না। আমাদেরই দেখতে লজ্জা করে, ওঁদের একেবারেই নয়। সামান্য দূরে কেউ একজন কারাওকো বাজিয়ে ইংরেজি পপ গান শোনাচ্ছেন। কিছু পুরনো গান, মানে আমার সময়ের ৬০-৭০-৮০ দশকের গান শুনলাম, মন্দ লাগলো না। আমি সাহস করে উঠে গিয়ে জানতে চাইলাম, ভায়া ভারতীয় গান কি কিছু জানো? একটু হেসে জবাব দিলেন, অনলি ওয়ান, জিমি জিমি জিমি আজা আজা আজা, বাৎ নৎ প্রিপেয়ারদ উইথ মাই ইনসতুরুমেন্ত। ভাবলাম, থাক বাবা, গাইতে হবে না।
এবার দুপুরে খাওয়ার সময় আমার সেই একই সমস্যা, কি খাবো? সবই চৈনিক। আমার সিলেবাসের চিকেন রোস্ট আছে, মিক্সড ভেজিটেবল আছে, কিন্তু অদ্ভুত একটা গন্ধ। এই গন্ধের চোটেই আমার পালানোর মতন অবস্থা। আর আছে হরেক রকমের স্যালাড, আছে চাইনীজ ভেজ ননভেজ। সন্দেশের মতন একটা কিছু অথচ সন্দেশ নয়। কি আর করা? পয়সা যখন দেওয়া আছে, কিছু একটা টেস্ট করি। অনেক খুঁজে শুধু সামান্য একটু প্লেন ফ্রায়েড রাইস খেলাম। কেমন যেন লাগলো, পুরো খেতে পারলাম না। আমারই দোষ, ভারতীয় মেনুর বাইরে আমার সিলেবাস একেবারেই অচল। আমার বৌ মেয়ে ভিয়েতনামী গলদা চিঙড়ি খেলো, সাথে স্যালাড। শেষে ভিয়েতনামী কফি তো আছেই।
যতই বেলা পড়ে আসছে, মনে হচ্ছে জনতা যেন পরিশ্রান্ত, আমাদের নিজেদেরও সেরকমই মনে হচ্ছে। ডেক প্রায় খালি হয়ে এসেছে। আসলে অনেকক্ষণ রোদে বসে আর গুহায় ওঠানামা করে আমাদের অজান্তেই আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। শুধু আমরা নই, আমাদের আশেপাশে অনেকেই। আবার শুনলাম, যাঁদের সমুদ্র সফরের অভিজ্ঞতা নেই, তাঁদেরও প্রথমদিকে এরকম ক্লান্তি এসে যায়।
ট্যুরিস্টদের জন্য আরেকটি আকর্ষন সাধারণ নৌকায় জলসফর। মৎসজীবিদেরই এটি আরেকটি জীবিকা। বড় বড় ক্রূজগুলি গুহার একদম কাছে যেতে পারে না, তাই যারা খুব কাছে থেকে গুহার বাইরের সৌন্দর্য্য দেখতে উৎসাহী, তাঁরা এই ছোট ছোট নৌকায় সফর করেন। এর আরেকটি বৈশিষ্ট এই যে নৌকাগুলি গুহার নীচে দিয়ে প্রবাহিত জলপথের একদিক দিয়ে ঢুকে অন্যদিক দিয়ে বাইরে আসতে পারে।
আমরা এবার তীরের দিকে চলেছি। চারিদিকে জল আর জল, খানিক দূরত্ব বজায় রেখে ছোট বড় মোটরবোট ট্যুরিস্টদের নিয়ে সব পাড়ের দিকে ফিরে চলেছে। কাছে দূরে সারি সারি ছোট বড় পাহাড়, ধীরে ধীরে সব দূরে চলে যাচ্ছে। বিদায় হা লং বে।
********
আমরা এসেছিলাম দিনের সফরে। যারা অন্যধরনের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে চান, তাঁদের জন্য এখানে রাতের সময়ে স্বল্প আলোয় গুহার ভেতরের প্রাকৃতিক পরিবেশে নৈশভোজের ব্যাবস্থাও আছে। আমাদের আগে জানা ছিলো না, তাই মিস করলাম। শুনলাম Sung Sot গুহা থেকে সামান্য তিন কিলোমিটার দূরত্বের ড্রাম গুহায় (Drum Cave) অনেক ট্যুরিস্ট এই ডিনারে আসেন। এই ড্রাম গুহা নামের কারণ স্থানীয় লোকজনের ধারণায় যখন বজ্রপাত হয়, মনে হয় সেই আওয়াজ গুহার ভেতর থেকে আসে। তাই ড্রাম গুহা। এর অভ্যন্তরেও অনেক stalactites ছড়িয়ে আছে, (long thin pieces of rock hanging down from the roof of a cave).
ড্রাম গুহার নামে কিছু প্রাচীন প্রচলিত বিশ্বাসও আছে। একসময় এখানের ফ্লোটিং ফিশিং টাউনের এক মৎস্যজীবী এক অপরূপ সুন্দরীর প্রেমে পড়েন, কিন্তু দরিদ্র পরিবারের মেয়েটি পারিবারিক চাপে এক ধনীকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়। মেয়েটি এক দুরন্ত ঝড়ের রাতে পালিয়ে এই দ্বীপে এসে উপস্থিত হয়, আর ভয়েই মারা যায়। খবর পেয়ে সেই মৎস্যজীবী তখনই চলে আসে কিন্তু ভুলে সে গুহার উল্টোদিকের অন্য এক গুহায় Virgin Cave (Trinh Nu Cave) পৌঁছে যায়। সেই বিশ্বাস থেকে অন্য গুহাটির নাম হয় ভার্জিন কেভ।
ড্রাম গুহায় নৈশভোজ নাকি এক অন্যরকমের বিরল অভিজ্ঞতা। তিনদিকে পাথর আর একদিকে খোলা সমুদ্র। এখানেও হেরিটেজ ডিপার্টমেন্ট পাথর ভাঙাভাঙি করতে দেয় নি, প্রকৃতির আদি রূপটাই ধরে রেখেছে। যেটুকু খোলা জায়গা পাওয়া গেছে, বিনোদনের জায়গা শুধু সেইটুকুই। ভিয়েতনামের অনেক ধনী পরিবার এখানে প্রাইভেট নৈশভোজ পার্টির আয়োজন করেন। এর কৌলিন্যই নাকি আভিজাত্যের একটি অন্যতম মাপ্কাঠি।
শেষ করার আগে এই ঘুমন্ত গুহাগুলি নিয়ে আরও কয়েকটি কথা বলি। এখানের phreatic গুহাগুলোকে কয়েকভাগে ভাগ করা হয়েছে। phreatic মানে সম্পৃক্ততা অঞ্চলে (জল টেবিলের নীচে) ভূগর্ভস্থ জলের সাথে সম্পর্কিত। প্রথমভাগের এই গুহাগুলি হলো Sung Sot, Tam Cung, Lau Dai, Thien Cung, Dau Go, Hoang Long, আর Thien Long.
Sung Sot আগেই বলেছি, Bo Hon Island এ. এর পরে Tam Cung তৈরি হয় লাইমস্টোনের স্তুপে ফাটল ধরে তিনটে চেম্বারে ভাগ হয়ে (in the bedding planes of the limestone dividing the fissure cave)। আর Lau Dai এর অবস্থান Con Ngua দ্বীপের দক্ষিণে।
**********
অচেনা ভিয়েতনাম, নবম পর্ব
হ্যানয় প্রেসিডেন্ট’স প্যালেস
হ্যানয় শহরে ফ্রেঞ্চ ঔপনিবেশিক স্থাপত্যের একটি সুন্দর দ্রষ্টব্য স্থান প্রেসিডেন্ট’স প্যালেস, (Vietnamese: Phủ Chủ tịch)। এটির স্থপতি ছিলেন ফ্রেঞ্চ ইন্দোচায়নার আর্কিটেক্ট Charles Lichtenfelder কিন্তু অনেকেই ভুলবশত এটির কৃতিত্ব দিয়ে থাকেন Augusta Henri Vildieu-কে কারণ Augusta Henri সেইসময় ফ্রেঞ্চ ইন্দোচায়না সরকারের আর্কিটেক্ট ছিলেন।
১৯০০-১৯০৬ সালে ইন্দোচায়নার ফ্রেঞ্চ গভর্নরের বসবাসের জন্য এটি নির্মিত হয়েছিলো। ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত এটির নাম ছিলো Palace of the Governor General of Indochina, (French: Palais du Gouvernement general de L’Indochine, Vietnamese: Phủ Toàn quyền Đông Dương). ১৯৫৪ সালে ভিয়েতনামের প্রথম স্বাধীনতার পরে এটি ছিলো প্রেসিডেন্ট হো চি মিন-এর সরকারী বাসভবন, কিন্তু উনি এখানে থাকতে রাজি হন নি। তবে উনার সরকারী সব কাজ, বা অতিথি আপ্যায়ন এখানেই হতো। বর্তমানে এটি এখনের প্রেসিডেন্টের বাসভবন। এর ভেতরে যাওয়া যায় না, তবে টিকিট কেটে সামনের বাগানে ঘোরাঘুরি করা যায়। ১৯৫৪ সালে প্রেসিডেন্ট হো চি মিন চলে গেলেন একটি ঐতিহ্যগত (ট্র্যাডিশনাল) ভিয়েতনামী বাসভবনে, House No. 54 । ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত তিনি এখানেই ছিলেন। ১৯৭৫ সালে সেই বাসভবনটিকে একটি ঐতিহাসিক প্যালেসে রূপান্তরিত করা হয়।
সকালে যখন বেরিয়েছিলাম, অতটা গরম ছিল না। এখন বেলা প্রায় দেড়টা বাজে, সূর্য একেবারে মাথার উপর, বেশ গরম, সাথে ঘাম। পরিবার বলে সানস্ক্রিন (দামী ভারতীয়) লাগিয়েও কোন লাভ হলো না।
Hanoi Opera House
হ্যানয় অপেরা হাউস (French: Opéra de Hanoï), or the Grand Opera House (Vietnamese: Nhà hát lớn Hà Nội, French: Grand Opéra) তৈরি হয় ১৯০১-১৯১১ সালে। সেইসময়ে ভিয়েতনামে তিনটি অপেরা হাউস তৈরি হয়েছিলো, বাকি দু’টি সায়গন আর হাইফং শহরে। প্যারিসের সুপ্রাচীন অপেরা হাউস Palais Garnier এর অনুকরনে এটির স্থাপত্য, এবং এটি ছিলো সেই সময়ের এশিয়া মহাদেশের একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ architectural landmark, বলা হতো Neoclassicism. যদিও এটি প্যারিসের আদলে নির্মিত, কিন্তু প্যারিস ও হ্যানয় শহরের জলবায়ু আবহাওয়ার তারতম্যের কারণে এর নির্মানে ভিন্ন ধরণের সামগ্রী ব্যাবহার করা হয়। ফরাসী বা আমেরিকা বা ভিয়েতনামের বিভিন্ন সময়ে বহু রাজনৈতিক বা মিলিটারি শাসকদের এটি ছিলো ক্ষমতা দখল ও ক্ষমতা প্রদর্শনের কেন্দ্র।
The Vietnam National Opera and Ballet (VNOB)
ফ্রেঞ্চরা চলে যাওয়ার পর এই অপেরা হাউসটিকে ভিয়েতনামের নিজস্ব সঙ্গীত নাটক ইত্যাদি চর্চার কেন্দ্র বানানো হয়। এর সাথে সাথে পাশ্চাত্য ক্লাসিক্যাল অর্কেস্ট্রা ও অপেরা দলগুলির সাথেও যোগাযোগ স্থাপন করা হয়। পাশ্চাত্য অথচ ফরাসী বা ইতালীয়ান) নয়, সেরকম একটি অপেরা আসে ১৯৬০ সালে রুশ ভিয়েতনামের যৌথ সাংস্কৃতিক উদ্যোগে,Tchaikovsky’র Eugene Onegin. তখন ভিয়েতনামে কোন ব্যারিটোন গায়ক ছিলেন না। রাশিয়া থেকে শিক্ষক এসে ভিয়েতনামের Quý Dương কে ট্রেনিং দিয়ে তৈরি করেন। বলা হয় Quý Dương ভিয়েতনামের সর্বপ্রথম ব্যারিটোন গায়ক।
baritone a male singing voice of medium compass between bass and tenor. A singing voice that is lower than a tenor but not as low as a bass, or a musical instrument with this range.
Source – Cambridge
এখন এখানে ভিয়েতনাম ন্যাশনাল সিম্ফনি অর্কেস্ট্রা, আর হ্যানয় ফিলহার্মনিক অর্কেস্ট্রার অনেক শো হয়, মূলত ট্র্যাডিশনাল সুরতালে। বহু বিদেশী, প্রধানত ইউরোপের বিভিন্ন দেশের শিল্পীদের কনসার্টও হয়। ভিয়েতনামের ন্যাশনাল ব্যালে আছে, যেমন নিজস্ব ঘরানার কম্পোজিশন হয়, তেমনি বিদেশী ক্লাসিক্যাল সেরা কম্পোজিশনগুলিকে, যেমন Swan Lake, ভিয়েতনামের ঘরানায় রূপান্তরিত করা হয়।
Quang Ba Flower Market
ভিয়েতনামের পর্যটকদের জন্য একটি বড় আকর্ষন এই দেশের ফুলের বাজার। এত বিভিন্ন ধরণের ফুলের সমারোহ পৃথিবীর খুব কম দেশেই দেখা যাবে। হ্যানয় শহরের বিখ্যাত ফুলের বাজার Quang Ba Flower Market. এবং এর বিশেষ বৈশিষ্ট হলো যে এটি বসে রাতের বেলায়, প্রায় মাঝরাতে। ফুল আসে প্রধানত নিকটবর্তী Da Lat, Moc Chau, Dong Anh, Tay Tuu, Gia Lam ইত্যাদি অঞ্চল থেকে। আর আসে অনেক horticultural গ্রাম থেকে যেখানে শুধুই ফুলের চাষ হয়। West Lake এর পাড়ে পাইকারি বিক্রেতারা মাঝরাতে এখানে তাঁদের পসরা নিয়ে আসেন, এবং কেনাবেচা চলে ভোররাত পর্যন্ত। রাতের বেলায় সারা শহর যখন নিদ্রায়, তখন বহু উৎসাহী বিদেশী পর্যটক শুধুমাত্র এই ফুলের বাজার দেখতেই এখানে আসেন। এই Quang Ba মার্কেটে সবথেকে বেশি কেনাবেচা হয় Tet Nguyen Dan (Vietnamese New Year) এর সময়। তখন এই মার্কেট সারাদিন খোলা থাকে। আর সেই ফুলের বাজার তখন গাড়ি চলার রাস্তা পর্যন্ত দখল করে নেয়। স্থানাভাবে অনেক বিক্রেতাই রাস্তার উপর নিজেদের মোটর বাইকে পসরা নিয়ে বসেন। Tet Nguyen Dan (Vietnamese New Year) এর সময় ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে সকলেই নিজেদের বাড়ি বা অফিস সাজায়। আর প্রসঙ্গত, ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন বা খুব সাধারণভাবেই খানিকটা ফুল দিয়ে কিছু সুন্দর করে সাজিয়ে রাখার প্রবণতা ভিয়েতনামের এক বহু পুরনো সামাজিক প্রথা। আমি দেখাছি রাস্তায় দু’চাকার স্কুটার মোটর সাইকেলও বাহনে ছোট একটা ফুলের তোড়া লাগিয়ে রাখে, ট্যাক্সিতেও সেরকম দেখলাম।
Quang Ba Flower Market ছাড়াও হ্যানয় শহরে আরও চারটে বড় বড় ফুলের বাজার আছে।
• Hoang Hoa Tham Flower Market
• Hang Luoc Flower Market
• Tay Tuu Flower Market
Livelihood is really hard, but that is the beauty of labor. Perhaps in their dream, they wish their flowers stalls out of stock and a smooth market-day. Besides the dog-sleep, visitors also have chances to see the image of merchants coming here to choose fresh and beautiful bouquets of flowers so that until dawn, everyone will find a wonderful Hanoi city with colorful flower bikes slowly moving on each street.
Bat Trang Ceramic Village
আজ সকালে আমাদের গন্তব্যস্থল Bat Trang Ceramic Village, হ্যানয় শহর থেকে দূরত্ব ২০ কিলোমিটার। Bat Trang Ceramic Village নিয়ে প্রথমেই বলি যে এর সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং ঐতিহাসিক, তিনরকমের গুরুত্বই রয়েছে। আনুমানিক হাজার বছর আগে, রেড নদীর বদ্বীপ অঞ্চলে এর প্রতিষ্ঠা হয়। এখানে নদীর পাড়ে সাদা মাটির প্রাচুর্যের ফলে কিছু স্থানীয় পরিবার মৃৎপাত্রশিল্পকে নিজেদের জীবিকা বানিয়ে ফেলে। এরপর নিকটবর্তী Bo Bat গ্রাম (বর্তমানে Ninh Bình Province) থেকে মৃৎপাত্রশিল্পের জীবিকা নির্বাহকারী আরও পাঁচটি নামী পরিবার সাদা মাটির প্রাচুর্যের জন্য এখানে এসে ঘর বাঁধেন, এবং কিছু কারিগরকেও ডেকে নিয়ে আসেন। সেই পাঁচটি পরিবার এবং এক Nguyen পরিবার যৌথভাবে এখানে মৃৎপাত্রশিল্পের বানিজ্যের পত্তন করেন। এরপর আনুমানিক দ্বাদশ শতাব্দীতে একজন নামী শিল্পী চীন দেশের Guangdong Province গিয়ে সাদা glaze (চাকচিক্য) প্রয়োগের পদ্ধতি শিখে আসেন। তারপর থেকে নানান বিবর্তন ও পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে Bat Trang Ceramic Village আজ সারা পৃথিবীতে নিজেদের সুনাম ও খ্যাতি অর্জন করে নিয়েছে।
ট্যাক্সি আমাদেরকে নিয়ে গ্রামে ঢোকার পর রাস্তার দুপাশে দেখি সারি সারি শুধুই পটারির দোকান। ট্যাক্সিওয়ালা খানিক এগিয়ে বলে, এখানে মাইলখানেক জুড়ে শুধুই এরকম দোকান, আমাদের যদি বিশেষ ঠিকানা না থাকে, তাহলে এখানে নেমে দোকানে দোকানে ঘুরে দেখাই ভালো। ভাড়া চুকিয়ে নেমে গেলাম। রাস্তা থেকে প্রতিটি দোকানের কাঁচের এদিকে থেকে দেখেই বুঝতে পারছি যে এক একটি বিশাল বিশাল দোকান। কেউ আমাদের আইয়ে, আইয়ে বা প্লিজ কাম বলে ডাকছে না। রাস্তা থেকে কয়েকটি দোকানে উইন্ডো শপিং করে দেখলাম বিভ্রান্তি বেড়েই চলেছে, কারণ কোন দোকান থেকে কোনটা কিনি? এক একটা দোকানে ঢুকি, আর চোখ ধাঁধিয়ে যায়। যেমন বিরাট জায়গা জুড়ে দোকান, তেমনি প্রচুর পসরা থাকে থাকে সাজানো। ঘর সাজাবার বস্তু যেমন আছে, তেমনি দৈনন্দিন কাজের জন্য প্লেট গ্লাস, চা কফি মগ, serving bowl, candle stand, এবং আরও অনেক কিছুই আছে। আমাদের ভারতীয় মুদ্রায় দু তিন’শ টাকার জিনিষ আছে, আবার যারা মার্সিডিজ চড়েন তাঁদের জন্য লাখ টাকারও সামগ্রী আছে। সনাতন ভিয়েতনামী ঘরানার ডিজাইন যেমন আছে, তেমনি চাইনিজ, ইতালীয়ান বা লাতিন আমেরিকানও আছে। অত সূক্ষ্ম শিল্পকর্ম আমরা বুঝি না, এনারাই আমাদের বোঝান। তুলনামূলকভাবে ভারতীয় ডিজাইন কম। কয়েকটি দোকানে আমাদের উত্তর প্রদেশের খুরজা পটারির মতন কিছু ডিজাইন দেখতে পেলাম।
তবে একটা ব্যাপার চোখে পড়ে। আগেই বলেছি, কেউ আমাদের আইয়ে, আইয়ে বা প্লিজ কাম বলে ডাকেনি। পরে জেনেছিলাম এখানে বড় বড় ব্যাবসায়ীরা এসে বাক্স বাক্স অর্ডার দিয়ে যায়, আমাদের মতন চার আনা আট আনার খরিদ্দার কম। কিন্তু আমরা যেসব দোকানে গিয়েছি, প্রতি দোকানেই ভালো ব্যাবহার পেয়েছি। তাঁরা নিজেরাও জানে যে আমরা খুব একটা পয়সা খরচ করবো না। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রতিটি দোকানে আমাদের যত্ন করেই সব দেখিয়েছে। যেসব দোকানে ঢুকে অনেককিছু দেখা বা দরাদরি করেও কিছু কিনিনি, তাঁরাও কিছু বিরক্তি প্রকাশ করেনি। আমরা কিনলাম একটা মোমবাতির স্ট্যান্ড সেট, অনেকটা কেরোসিনের প্রদীপের মতন। আর অল্প দামী কয়েকটা স্যুভেনির। মুলুকে ফিরে ভিয়েতনামী স্যুভেনিরে ঘর সাজাবো না?
দেখলাম কিছু কিছু দোকানের ভেতরেই কারিগরেরা কাজ করে, মাটির আসবাব তৈরি করছে। আবার অনেক বিদেশী, সম্ভবত শিক্ষার্থী, তাঁরাও কাজ করছে, বা কাজ শিখছে। খানিক পরে জানলাম যে আমরা চাইলে আমরাও একাজ করতে পারি। নিজের পছন্দের জিনিষ নিজেই বানাও, কিন্তু ফিনিশিং টাচ দেবে দোকানের কারিগর। আর তৈরি করার পরে মাটি শুকিয়ে গেলে আরও একবার আসতে হবে। অথবা সেটি এঁদের কাছেই রেখে যেতে হবে।
প্রায় তিন হাজার স্কোয়ার মিটার জায়গা জুড়ে এখানে একটি পটারি মিউজিয়াম আছে। ২০১৮ সালে সাড়ে ছয় মিলিয়ন ডলার খরচ করে এটি তৈরি হয়, আর্কিটেক্ট ছিলেন Hoang Thuc Hao. বিশেষত্ব এই যে স্থানীয় পটারি এক্সপার্ট, স্থানীয় কারিগর ও গ্রামবাসীরা একত্রে আলোচনা করে এটির প্ল্যান তৈরি করেন। কিভাবে এখানে এই মৃৎশিল্প গ্রামটি ধীরে ধীরে গড়ে উঠলো, এই মিউজিয়ামে সেটি দেখানো হয়েছে। নানান ধরণের নানান বাজেটের সামগ্রী এখানে পাওয়া যায়।
হ্যানয় শহরের অদূরে একসময়ের এক অনামী Bat Trang Ceramic Village আজ পৃথিবীর এক সেরা মৃৎশিল্প গ্রাম। পারিবারিক ব্যাবসায়ী যেমন আছেন, তেমনি আছে যৌথ উদ্যোগ এবং কিছু কোওপারেটিভ কোম্পানিও।
Lake of the Restored Sword
বিকেলে আমরা এলাম Hồ Hoàn Kiếm Lake (Lake of the Restored Sword) অঞ্চলে। এই লেকের কিছু ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে। এ ছাড়াও ভ্রমণকারীদের জন্য, বিশেষ করে সান্ধ্যকালে এটি এক অত্যন্ত আকর্ষনীয় গন্তব্যস্থল।
১৪২৪-২৫ খ্রীস্টাব্দ সময়ে হ্যানয়ের Lê Lợi নিজের সৈন্যবাহিনী তৈরি করে চীনের Ming Chinese কে পরাজিত করেন, ও হ্যানয়ের রাজা হন। তিনি সৌজন্যবোধে পরাজিত চীনের সৈনিকদের দেশে ফিরে যেতে সহায়তাও করেন। কথিত আছে, যুদ্ধবিজয়ের পর একদিন এই লেকে রাজার নৌকাবিহারের সময় জল হতে একটি বিরাট আকৃতির কচ্ছপ উঠে এসে রাজাকে আদেশ দেয় যে যেহেতু যুদ্ধ সমাপনে শান্তি ফিরে এসেছে, সেহেতু যে তরবারি যুদ্ধে ব্যাবহার করা হয়েছে (“Thuan Thien” sword), সেই তরবারি এখন এই জলের দেবতার কাছে বিসর্জন দিতে হবে। সাধারণ লোকের বিশ্বাস ছিল যে এই তরবারি স্বয়ং ঈশ্বর পাঠিয়েছিলেন (“heaven-sent sword”)। প্রসঙ্গত বলা যায়, ভিয়েতনামীরা কচ্ছপের দীর্ঘায়ুর জন্য তাঁকে সৌভাগ্যের প্রতীক মানে। সুতরাং কচ্ছপের আদেশে রাজা Lê Lợi তখনই তাঁর তরবারি সেই জলে বিসর্জন দেন। সেই থেকেই এই লেকের নামকরণ হয় Lake of Restored / Returned Sword (Hoan Kiem Lake). আগে এই লেকের নাম ছিল Luc Thuy Lake (all-year green water). ভিয়েতনামের লোকজন বর্তমানে এই লেকটিকে সযত্নে রক্ষনাবেক্ষন করেন।
এই Hoan Kiem Lake অঞ্চলের চারিদিকে সারাদিন ব্যাস্ততা। প্রধান সরকের নাম Hoan Kiem Lake Walking Street. দিনভর প্রচুর গাড়ি চলে। শহরের অন্যতম প্রধান কেনাকাটার অঞ্চল। আর সপ্তাহান্তে সন্ধ্যাবেলায় যানবাহনের নো এন্ট্রি। রাস্তা জুড়ে বসে যায় দোকানের মেলা, আর চলে ছোট ছোট গ্রুপের নানান রকমের অনুষ্ঠান।
সেদিন শনিবার। নাইট মার্কেটের ব্যাপারটা আমরা জানি না। ট্যাক্সি এক জায়গায় এসে থেমে গেলো, সামনে ব্যারিকেড, মানে বাহন আর আগে যাবে না। বুঝতে পারছি না, আমরা কোথায়? ট্যাক্সিওয়ালা ঐ দূরের দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে দিলে বুঝলাম যে ঐ দূরেই কোন এক অচেনা অঞ্চলে সেই লেকের অবস্থান। আমরা পৌঁছেছি বিকেলের দিকে, দিনের আলোয়। খানিক এগিয়ে দেখি বিরাট চওড়া রাস্তার একদিকে সেই লেক, অন্যদিকে সারি সারি দোকান। সামনেই একটা বড় রেস্তোরাঁ। রেস্তোরাঁ দেখেই কেমন যেন ভিয়েতনামী কফির খাওয়ার বাসনা হলো। এমনিতে হোটেলের রুমে সাজানো আছে সাধারণ নেসকাফে কফি, শুধু ব্রেকফাস্টের সময় ভিয়েতনামী কফি পাওয়া যায়। ভাবলাম, এতদিন যে বস্তু হোটেলে মুফতে খাচ্ছি, আজ পয়সা দিয়ে একবার খাওয়া যাক। খেলাম, সে রেস্তোরাঁর কফির সত্যিই অন্যরকম স্বাদ।
রোদ চলে গেছে, খানিক পরেই সন্ধ্যা নামবে। ছোট ছোট দল এসে রাস্তার উপরেই নিজেদের কসরত দেখাতে শুরু করেছে। মনে হয় সব ছোটখাটো ক্লাবের দল। কস্টিউমের বাহুল্য নেই। সীমিত ক্ষমতায়, সীমিত দক্ষতায় সাধারণ পোশাকেই নিজেদের সীমিত প্রতিভা দেখানোর চেস্টা করে। তবে যেটা ভালো লাগলো, রাস্তায় সাধারণ লোকজন এঁদের উৎসাহ দেয়।
সন্ধ্যার আঁধার নামতেই কানে এলো খানিক দুরেই পপ সঙ্গীতের মূর্ছনা। কাছে গিয়ে দেখি রাস্তার উপরের মঞ্চ বানিয়ে মাইকেল জ্যাকসন বা জন লেননের ভিয়েতনামী ডুপ্লিকেট নিজের ব্যান্ড নিয়ে হাত পা নাচিয়ে শ্রোতাদের মনোরঞ্জনের চেষ্টা করছেন। খুব উচ্চমানের গায়ক মনে হলো না, তবে ছুটির সন্ধ্যায় দূর থেকে মন্দ লাগে না। দেখি গানের তালে কিছু লোক রাস্তায় নৃত্যও করেন। এককথায় অধিকাংশ জনতাই বিনা পয়সার অনুষ্ঠান উপভোগ করেন। আর কিছু লোক ব্যান্ডকে উৎসাহ দিতে একটি বাক্সে সাধ্যমত নোট ফেলে ব্যান্ডের কিছুটা আর্থিক সহায়তাও করেন।
আমরা হাঁটতে হাঁটতে আরও খানিক এগিয়েই দেখি যেদিকে দুচক্ষু যায় রাস্তার উপর একেবারে মাঝখানে বাজার বসা। তাঁবু খাটিয়ে সাজানো দোকান, বোঝাই যায় এগুলি অস্থায়ী। হ্যানয় শহরের উইকএন্ডের সান্ধ্যকালীন আকর্ষন এই স্ট্রীট মার্কেট। শুক্রবার ও শনিবার সন্ধ্যার পর কিছু বিশেষ অঞ্চলে দোকানীরা রাস্তার উপর নিজেদের পসার নিয়ে বসেন। অন্যসময় এই রাস্তাগুলি শহরের অন্যতম ব্যাস্ত রাস্তা, কিন্তু সন্ধ্যার পর যানবাহনের জন্য নো এন্ট্রি। এখানে দোকান বসানোর নিয়ম হলো যে দোকানী একটি নির্দিষ্ট পরিমান জায়গা নিয়েই দোকান বসাবে। আগে গিয়ে বিরাট এক জায়গা দখল করে নেবো, এসব চলে না। দোকানীরা স্যুটকেস ভরে সামগ্রী নিয়ে এসে ঝটাপট ক্ষিপ্রগতিতে দোকান সাজিয়ে ফেলে। তারপর এই বাজার চলে মধ্যরাত্রি পর্যন্ত। যেহেতু এখানে দাম এমনিতেই সস্তা, আর সুযোগ বুঝে দরাদরিও চলে, তাই বহু বিদেশী এখানে আসেন। লোকের ফেরার চিন্তা নেই, কারণ নাইট মার্কেটের অঞ্চলের বাইরে সারি সারি ট্যাক্সি, আর রিক্সা দাঁড়িয়ে থাকে।
এই নাইট মার্কেটে জিনিসপত্র কেনার পাশাপাশি কিছু অনামী মিউজিক ব্যান্ড, নাচের গ্রুপ, বা ম্যাজিশিয়ানরা রাস্তার মাঝখানেই শো করেন। জনা চার পাঁচেকের দলের যেমন ব্যান্ড থাকে, তেমনি এককভাবে কেউ বেহালা, স্যাক্সোফন, বা বাশি বাজিয়েও জনতার দৃষ্টি আকর্ষনের চেষ্টা করেন। অনামী নাচের দল নিজেদের শো দেখায়। মাঝখানে একটি বাস্কেট থাকে, শ্রোতারা নিজেদের ইচ্ছে ও সাধ্য অনুযায়ী কিছু টাকাপয়সা দিয়ে এনাদের কিছুটা মর্যাল সাপোর্ট দেয়। রাস্তার দুধারে থাকে কিছু কিছু স্থায়ী খাওয়ার দোকান আর রাস্তার মাঝখানে তাঁবু খাটিয়ে থাকে অস্থায়ী দোকান। খাওয়া মানে প্রধানত চাইনিজ, ভিয়েতনামী, বা থাই ফুড। এ ছাড়া বীয়ার পাব, চা কফির স্টলও থাকে। সুতরাং এখানে যারা আসেন, অধিকাংশই নিশ্চিন্তে আসেন, বাড়ি ফিরে ফ্রিজ থেকে ভাত ডাল মাছের ঝোল বার করে গরম করে খাওয়ার চিন্তাটা থাকে না।
হাঁটতে হাঁটতে কফির এক বড় দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালাম, দোকানে থরে থরে সাজানো নানান রকমের কফি প্যাক। দোকানে ঢুকে আমরা সোজা কবুল করলাম যে ভারত মুলুকে ভালো কফি নিয়ে যেতে চাই, কিন্তু কোনটি সেরা এ বিষয়ে আমাদের কোন জ্ঞানই নেই। দোকানী আমাদের বসতে দিলেন, বাজেট জেনে নিয়ে এবার একটা কফি আমাদের সামনেই বানিয়ে দিলেন, আমরা প্রস্তুতপ্রণালী মন দিয়ে দেখলাম। প্রস্তুতির সময় লাগলো প্রায় মিনিট দশেক। দুই চুমুক দিয়ে জানালাম, মনপসন্দ। এটি কমপ্লিমেন্টরি, পয়সা দিতে হলো না। তারপর দোকানী শুধু যে মালের দাম নিয়ে মাল প্যাক করে বিদায় দিলেন তা নয়, কিভাবে এই কফি বানাতে হয় সেটিও শিখিয়ে দিলেন।
Hang Bac Street
হ্যানয় শহরে সময় নিয়ে একবার Hang Bac Street এ যাওয়া যেতে পারে। এটি কয়েক শতাব্দী প্রাচীন রুপোর (traditional silver crafting) শিল্পবানিজ্যের কেন্দ্রস্থল। ভিয়েতনামে ‘Bac’ কথাটির অর্থ রুপা। লী রাজাদের শাসনকালে (Le’s Dynasty), রাজা Le Thanh Tong (1460-1497) তাঁর একজন প্রজা Le Xuan Tien কে সোনারূপার ব্যাবসা ও কারুশিল্পের জন্য একটি ফাউন্ড্রি (foundry) তৈরি করার অনুমতি দেন। এর বহুদিন পর উনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে রাজা Nguyen এই ফাউন্ড্রি নিজের Hue দুর্গের কাছে নিয়ে আসেন। কিন্তু বেশ কিছু অভিজ্ঞ শিল্পী Thang Long দুর্গেই থেকে যান, এবং সেখানেই নিজেদের ফাউন্ড্রি চালু রাখেন। এরই সাথে আজকের Hang Bac স্ট্রিটের খ্যাতির শুরু।
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, Thanh Tong দুর্গ স্থাপিত হয় ১০১১ সালে, এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়কালে এটি North Vietnamese Ministry of Defense এর সদর কার্যালয় ছিল। ফ্রান্সের শাসনকালে এই অঞ্চলে রূপা ও স্থানীয় মুদ্রার বিনিময় হতো (“rue de Changeurs” যার অর্থ Street of Silver Exchangers).
আজ এই Hang Bac স্ট্রীটে নানানরকমের সোনা রূপার গয়না ও শিল্পসামগ্রীর কয়েক’শ দোকান আছে, এবং বহু বিদেশী এখানে কেনাকাটার জন্য আসেন।
One Pillar Pagoda
ভিয়েতনামের অনেক অনেক সুপ্রাচীন স্থাপত্যের মধ্যে একটি হলো One Pillar Pagoda (Vietnamese: Chùa Một Cột 廚𠬠榾), এটি স্থাপন করা হয়েছে Diên Hựu tự (延祐寺) অঞ্চলে, এটিকে বলা হয় ‘Pagoda of Extended Blessings’. নামকরণেই বোঝা যায়, একটি লম্বা পিলারের উপর এই প্যাগোডা দাঁড়িয়ে আছে। হ্যানয় শহরে Ba Đình ডিসট্রিক্টে Thăng Long দুর্গের কাছেই। এই প্যাগোডাটিকে বলা হয় Liên Hoa Đài (蓮花臺) (Lotus Pedestal), একটিমাত্র পিলারের উপর স্থাপন করা হয়েছে। ১০৪৯ সালে সম্রাট Lý Thái Tông এর শাসনকালে (১০২৮-১০৫৪) এটির নির্মান হয়। কথিত আছে, সম্রাট নিঃসন্তান ছিলেন, স্বপ্নে দেখেন বোধিসত্ব Avalokiteshvara পদ্মফুলের আসনে বসে তাঁকে একটি শিশুপুত্র উপহার দিলেন। এরপরই সম্রাট এক কৃষককন্যাকে বিবাহ করেন, এবং পুত্রসন্তান জন্মায়। তখন বৌদ্ধ সন্যাসী Thiền Tuệ এর পরামর্শে সম্রাট এই পদ্মফুলের পুকুরে প্যাগোডা স্থাপন করেন, অবিকল স্বপ্নে যেরকম দেখেছিলান। ১৮৪০-৫২ সময়কালে Nguyễn রাজবংশের প্রধান এটির সংস্কার করেন, ১৯২২ সালে আবার সংস্কার করা হয়। দুর্ভাগ্যবশত ১৯৫৪ সালে ফরাসী শাসনকালে ভিয়েতনামী সেনার একজন লেফটেন্যান্ট এটিকে ডিনামাইট দিয়ে ভেঙে ফেলার চেষ্টা করলে তাঁকে ভয়ঙ্কর শাস্তি দেওয়া হয়। ১৯৫৫ সালে সরকারের তরফ থেকে পুরনো স্থাপত্যের রূপে আবার এটির পুনঃনির্মান করা হয়। Ly রাজবংশের শাসনকালে Vesak, অর্থাৎ গৌতম বুদ্ধের জন্ম উৎসব এই মন্দিরে সারম্বরে পালন করা হতো।
St. Joseph’s Cathedral
St. Joseph’s Cathedral (Nhà thờ Lớn Hà Nội lit. ’Grand Cathedral of Hanoi’, ফরাসী ভাষায় Cathédrale Saint-Joseph d’Hanoï) হ্যানয় শহরের প্রাচীনতম ক্যাথলিক চার্চ, নির্মান হয় ১৮৮৪-১৮৮৬ সময়কালে। এটিও প্যারিসের নোতর দাম গির্জার আদলে বানানো হয়।
হ্যানয় শহরের পর্যটকদের জন্য এটিও একটি দ্রষ্টব্যস্থান, যদিও আঙ্গিকে এটি সায়গনের নোতর দাম চার্চের মতনই।
Water Puppet Theatre
ভিয়েতনামের Water puppetry (Vietnamese: Múa rối nước) আনুমানিক ১২শ বছরের পুরনো সংস্কৃতি। ঐতিহাসিকদের মতে, একাদশ খ্রিস্টাব্দে উত্তর ভিয়েতনামের Red River বদ্বীপ অঞ্চলে এর উৎপত্তি। এরপর সময়ের ও বহু দেশি বিদেশী সংস্কৃতি ও অনুকরণের প্রভাবে এখন এটিকে বলা যায় a unique variation on the ancient Asian puppet tradition.
ধান এদেশের গ্রামাঞ্চলের প্রধান খাদ্যশস্য। কথিত আছে, প্রাচীনকালে বর্ষার পরে ধানখেতে জল জমে গেলে, চাষীরা কাঠের মূর্তি বানিয়ে সেটিকে কিছুটা জলের তলায়, আর কিছুটা জলের উপরে রেখে সন্ধ্যাবেলায় চাঁদের আলো ও প্রদীপ মোমবাতির মিলিত ঝিলিমিলি আলোয় নতুন ফসলের নৃত্যগীতের পার্বন করতো। (musical and vocal acoustics, with a shimmering lighting effect). সেই প্রথাই আজ একটি জাতীয় ঐতিহ্যগত প্রথার রূপ নিয়েছে।
সাধারণত কোন একটি গল্পের আধারে এই Water puppetry শো’গুলি হয়। চার মিটার বাই চার মিটার অঞ্চল নিয়ে কোন এক লেকের এক কোনে, অথবা কোন অডিটোরিয়ামের ভেতরেই সেই একই রকম আয়তনের একটি জলের ট্যাঙ্ক বানিয়ে। শুনতে অদ্ভুত লাগবে যে, বিশেষ আমন্ত্রণে ভ্রাম্যমাণ ট্যাঙ্কেও (portable tanks built for traveling performers) অনেক সময় এই শো করা হয়, তবে এটি খরচাসাপেক্ষ। এখন পুতুলনাচের সাথে গান আর আবহসংগীতে বাশী, drum, কাঠের bell, cymbal, horn, đàn bầu (monochord) gong, ইত্যাদি যন্ত্রের ব্যাবহার হয়।
*******
অচেনা ভিয়েতনাম দশম পর্ব
@Asim Deb
Hoi An ভিয়েতনামের এক অতি প্রাচীন শহর। এই ছোট অনামী শহরটি আজ একটি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সেন্টার কারণ সপ্তদশ ও অষ্টদশ শতাব্দীর ১,১০৭ টি কাঠের ফ্রেমের বাড়ি এখনও সংরক্ষিত আছে, এবং লোকজন সেখানে বসবাস করে। 1,107 timber frame buildings, with brick or wooden walls, which include architectural monuments, commercial and domestic vernacular structures, notably an open market and a ferry quay, and religious buildings such as pagodas and family cult houses. The houses are tiled, and the wooden components are carved with traditional motifs.
ভিয়েতনামের Hoi An শহর নিয়ে আমি দুইভাগে বলবো। প্রথমভাগে ষোড়শ আর সপ্তদশ শতাব্দীর অসংখ্য ঐতিহ্য, আর পরবর্তী পর্যায়ে এখানের বিখ্যাত Lantern Festival.
Hoi An
সিনো ভিয়েতনামীতে এর অর্থ হয় “peaceful meeting place” ২০১৮ সালের গণনা অনুযায়ী মাত্র ১ লক্ষ ২০ হাজার জনসংখ্যার একটি ছোট অনামী শহর আজ ষোড়শ আর সপ্তদশ শতাব্দীর প্যাগোডা আর কয়েকশ বছরের পুরনো কাঠের বাড়িগুলি সযত্নে সংরক্ষণ করে চলেছে, যার ফলস্বরূপ ভিয়েতনামের এই ছোট শহরটি ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সেন্টারের স্বীকৃতি পেয়েছে। আর ২০২৩ সালে UNESCO Creative Cities Centre Network এর তালিকাভুক্ত হয়েছে। প্যাগোডার তালিকা অনেক লম্বা হয়ে যাবে, আমি কয়েকটি মাত্র উল্লেখ করছি:
• Ong Pagoda, ১৬৫৩ সালে নির্মিত
• Phuc Kien Pagoda, ১৬৯৭ সালে নির্মিত
• Cau Pagoda, ষোড়শ শতাব্দীতে নির্মিত
• Phap Bao Pagoda, ১৯৮০ সালে নির্মিত
• Ba Mu Pagoda, ১৬২৬ সালে নির্মিত
• Vien Giac Pagoda. এটি আগে Xuyen Trung শহরে স্থাপন করা হয়েছিল, নাম ছিল Cam Ly Pagoda, কিন্তু ক্রমাগত নদীর তীরবর্তি অঞ্চলে মাটির ক্ষয়ের জন্য (land erosion) স্থানীয় লোকেরা ১৮৪১ সালে এটিকে বর্তমান স্থলে পুনঃনির্মান করেন, এবং নামকরণ করেন Vien Giac Pagoda.
• Hai Tang Pagoda, ১৭৫৮ সালে নির্মিত
• Phuoc Lam Pagoda, সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে নির্মিত
• Chuc Thanh Pagoda, ১৬৭১ সালে নির্মিত 1671
• Quan Am Pagoda, also known as Minh Huong Temple, ১৬৫৩ সালে নির্মিত
এখানের ষোড়শ শতাব্দীতে নির্মিত Cau Pagoda বিশেশভাবে উল্লেখযোগ্য তার জাপানী, চীন আর ভিয়েতনামের মিশ্র স্থাপত্যের জন্য (architecture blends Japanese, Chinese, and Vietnamese influences, featuring yin-yang roof tiles, a wooden frame, and ornamental details)। মাত্র ১৮ মিটার লম্বা অতি সাধারণ আকারের একটি সেতুর উপর নির্মিত এই প্যাগোডাটি এখানের স্থানীয় লোকেদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র স্থান, তাঁরা মনে করেন ভগবান Tran Vo Bac De তাদেরকে বন্যা বা অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করবেন।
Kim Buu Pagoda
Kim Buu Pagoda এখানে ভিন্ন একটি কারণে উল্লেখ করছি। ভিয়েতনামের স্বধীনতা যুদ্ধের সময় গেরিলারা এখানে আশ্রয় নিয়েছিল, এবং এখানের বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা আমেরিকান আগ্রাসন থেকে এটিকে রক্ষা করেছিলেন।
Hoi An’s pagodas are distinguished by their harmonious blend of Vietnamese, Chinese, and Japanese architectural styles, reflecting the town’s rich multicultural heritage. The Japanese Covered Bridge, or Chua Cau, constructed in the 17th century by Japanese merchants, exemplifies this fusion with its wooden structure, curved roof, and intricate carvings. This bridge not only connected the Japanese and Chinese quarters but also symbolized the cultural exchange prevalent during Hoi An’s history.
Phuoc Lam Pagoda
Phuoc Lam Pagoda, established in the late 17th century by Monk Thiet Dinh, is a significant Buddhist site located in Cam Ha Ward, approximately 3 kilometers from Hoi An’s city center. The pagoda’s architecture reflects traditional East Asian design, featuring a three-door temple gate, a spacious courtyard, and a main hall flanked by two robust bell towers. Within its sanctuary, Phuoc Lam Pagoda preserves numerous valuable antiques, including ancient porcelain bowls and intricately carved wooden Buddhist scriptures, offering visitors a glimpse into the rich spiritual heritage of Hoi An.Quan Cong Temple
The Quan Cong Temple, also known as Chua Ong, showcases traditional Chinese architectural elements. Built in the mid-17th century by Chinese immigrants, the temple is dedicated to Quan Van Truong, a revered general from the Three Kingdoms period in Chinese history. The temple’s vibrant colors and intricate designs highlight the Chinese influence in Hoi An’s spiritual architecture.
Hai Tang Pagoda
Hai Tang Pagoda, established in 1758, is a historic one. The pagoda’s name combines “Hai,” meaning sea, and “Tang,” referring to the Buddhist Tripitaka, symbolizing the vastness of Buddhist teachings. Architecturally, it features a distinctive three-entrance gate, arched design, and a yin-yang tiled roof, harmoniously blending with its natural surroundings. The pagoda houses wooden statues of the Three Buddhas, Quan Cong, Chau Xuong, Luu Binh, and Earth Store Bodhisattva, reflecting its spiritual significance. Notably, it preserves a large brass bell molded in 1770, exemplifying the craftsmanship of the Early Le dynasty. The serene location, nestled between a mountain and a small valley, enhances the tranquil experience for visitors exploring Hoi An’s spiritual heritage.
Assembly Hall of Cantonese Chinese Congregation – Tran Phu Street, Minh An, Hoi An
The Assembly Hall of the Cantonese Chinese Congregation, established in 1885, is a striking example of Hoi An pagoda culture, its an integral part of the Hoi An Assembly Halll tradition, serving as a centerpiece of the Cantonese community’s spiritual and cultural life. Originally dedicated to Confucius and Thien Hau Thanh Mau, the sea goddess, it was later rededicated to Guan Yu, a symbol of loyalty and integrity. This Hoi An Chinese pagoda showcases exquisite architecture, including a grand three-entrance gate, intricate dragon and phoenix carvings, and a courtyard fountain depicting the legend of the carp transforming into a dragon. Inside, vibrant altars honor Guan Yu alongside the Gods of Wealth and Land, reflecting the Cantonese influence on local traditions. As a hub for worship and community gatherings, it offers visitors a chance to explore the rich blend of history, art, and spirituality unique to Hoi An’s cultural heritage.
Hoi An শহর
Hoi An শহরের ভূমিকায় উল্লেখ করেছি যে সপ্তদশ ও অষ্টদশ শতাব্দীর ১,১০৭ টি কাঠের ফ্রেমের বাড়ি এখনও সংরক্ষিত আছে। এই বাড়িগুলো নির্মিত হয়েছে ক্রমান্বয়ে পাশাপাশি, আর সামনে আছে সরু চলার পথ (unbroken rows along narrow pedestrian streets).
এই শহরটি ছিল নদীবন্দর, অতীতের থেকে শহরের সামান্যই পরিবর্তন হয়েছে। (The original street plan, which developed as the town became a port, remains. It comprises a grid of streets with one axis parallel to the river and the other axis of streets and alleys set at right angles to it). নদীপথে বানিজ্যের সুবিধার জন্য বাড়িগুলি নির্মান হয়েছে যার পিছনের খিড়কি দুয়ার আছে নদীর দিকে (easy loading and off-loading of goods from boats). এই শহরে ট্রেন পরিসেবা নেই। Hoi An শহরটি দানাং থেকে ২৮ কিলোমিটার দূরে, রাস্তায় সময় লাগে ৫০ মিনিট।
Hoi An Lantern Festival
ষোড়শ বা সপ্তদশ শতাব্দীর কোন এক সময়ে চীন দেশের Guangdong, Fujian, আর Chaozhou অঞ্চলের লন্ঠন নির্মাতারা এখানে এসে বাসা বাঁধেন। ব্যাবসার পাশাপাশি এঁরা ঘরের বাইরে টাঙিয়ে লন্ঠন টাঙিয়ে রাখতেন, বিশ্বাস করতেন যে এতে দূর চীন দেশের স্বজনদের সাথে যোগাযোগ থাকে। সেই প্রাচীন সময় থেকেই ঘরে ঘরে লন্ঠন জ্বালিয়ে ঘর আলো করার প্রথা ছিল। এরপর ১৯৮৮ সাল থেকে শহরের লোকজন প্রতি চন্দ্রমাসের চতুর্দশ দিনের সন্ধ্যায় lantern festival উদযাপন শুরু করে। এই উৎসবের সময় লোকেরা প্রতিটি ঘরের বৈদ্যুতিক আলো নিভিয়ে দেয়, আর নানান রঙের লন্ঠনে ঘর সাজানো হয়।
রাস্তাঘাটও লন্ঠনে সাজানো হয়, আর Thu Bon নদীর জলে বা অন্যান্য জলাশয়েও ভাসমান প্রদীপ লন্ঠনের মতন সাজিয়ে ভাসানো হয়। সেদিন লোকজন যথাসম্ভব সনাতন (traditional) পোষাকে হাতে লন্ঠন নিয়ে নাচগান আর বাজি ফাটানোর সাথে সাথে রাস্তায় কুচকাওয়াজ (parade) করেন।
Da Nang
দানাং শহরের ইতিহাস প্রায় হাজার বছরের, প্রাচীনকালে এখানের বানিজ্যিক যোগাযোগ মোটামুটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সীমাবদ্ধ ছিল। দূর পাশ্চাত্যের সাথে প্রথম যোগাযোগ হয় যখন ১৫৩৫ সালে পর্তুগীজ ভূ-পর্যটক (explorer) António de Faria নিকটবর্তী Hội An বন্দরে নিজের জাহাজ নোঙর করেন। de Faria প্রথম ইউরোপীয়ন যিনি এখানের কথা বহির্বিশ্বে প্রচার করেন। এরপরেই পর্তুগীজ নৌবানিজ্যের জাহাজ নিয়মিতভাবে Hội An বন্দরে আসতে শুরু করে। এরপর ফ্রান্স আর স্পেন দেশ থেকেও জাহাজ আসতে শুরু করে। কিন্তু দানাং শহরের ভৌগলিক অবস্থান, অর্থাৎ সামুদ্রিক বন্দরের সুবিধার জন্য Hội An বন্দরের তুলনায় দানাং এর গুরুত্ব ক্রমে ক্রমে বৃদ্ধি পায়। ২০২৩ সালের গণনা অনুযায়ী ১২ লক্ষ ২৫ হাজার জনসংখ্যার দানাং শহর (Da Nang) বর্তমানে বানিজ্য ও জনসংখ্যার নিরিখে দেশের চতুর্থ গুরুত্বপূর্ন সামুদ্রিক শহর। একই সাথে এটি দেশের অন্যতম ট্যুরিজম আর এডুকেশন হাব। হ্যানয়, সায়গন, বা হা লং বে-র মতন ঐতিহাসিক, বা বিখ্যাত স্থাপত্য বা প্রাকৃতিক উল্লেখযোগ্য সৃষ্টির নিদর্শন এখানে নেই। দানাং শুধুই কয়েকদিনের ছুটি কাটানোর জন্য।
ট্যুরিস্টদের জন্য এখানে সবথেকে আকর্ষণীয় দ্রষ্টব্যস্থল গোল্ডেন ব্রিজ। মানুষের হাতের আদলে দুটি পিলারের উপর এটি দাঁড়িয়ে। আকাশ থেকে দেখলে বা দ্রোন ফটো তুললে মনে হবে একজন মানুষ দুই হাতে ব্রিজটি ধরে আছে। খুবই সাধারণ, কিন্তু যে আর্কিটেক্ট এর পরিকল্পনা করেছিলেন তাঁকে হাজারো কুর্নিশ। ২০১৮ সালে ১৫০ মিটার (৪৯০ ফুট) লম্বা এটির প্রধান তিনজন ছিলান ডিজাইনার আর্কিটেক্ট হোচি মিন সিটি ইউনিভার্সিটির TA Landscape Architecture, তৈরি করে প্রিন্সিপ্যাল ব্রিজ ডিজাইনার Vu Viet Anh, ব্রিজ ডিজাইনার Trần Quang Hùng আর ডিজাইন ম্যানেজার Nguyen Quang Huu Tuan.
আরেকটি গন্তব্যস্থল Mercure Danang (ফ্রেঞ্চ ভিলেজ)। বানা পাহাড়ের উপর (Bana Hills Mountain range) সমুদ্রতল থাকে ১৪৮৭ মিটার উপরে ইউরোপীয়ান গথিক স্টাইল, ও ফ্রেঞ্চ ঘরানার মিশ্রণে এটি এক অভিজাত পর্যটনস্থল। পর্যটকদের সুবিধার জন্য দানাং ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে মাত্র ২০ মিনিটে কেবল কারে (cable car ride) পৌঁছে যাওয়া যায়। আজ এই সময়ে দানাং বিশ্বের ট্যুরিজম মানচিত্রে এক উল্লেখযোগ্য নাম।
সারাংশ
খুব সংক্ষেপে বলি
আমি প্রথমে ভিয়েতনামে আসতে চাই নি, কারণ আমার এক ভীতি ছিল যে এত পয়সা খরচ করে এখানে এসে সর্বহারাদের লাল পতাকার মিছিল দেখতে হবে। কিন্তু এসে দেখলাম, ভিয়েতনাম এক অচেনা দেশ। আমরা সাধারণ লোকেরা এই দেশের কিছুই খবর রাখি না। ধ্বংসস্তুপ থেকে কিভাবে উঠে দাঁড়াতে হয়, ভিয়েতনাম তার এক উজ্জলতম দৃষ্টান্ত। আজ তাই সারা দুনিয়ার লোক ভিয়েতনামে আসে। শুধু বানিজ্য নয়, বিদেশী ছাত্রছাত্রীরাও আজ এখানের স্কুলে পড়তে আসে। আর শুধু দু দুটি স্বাধীনতা যুদ্ধ নয়, ভিয়েতনামের ইতিহাস হাজার বছরের পুরনো, এবং ভিয়েতনামীরা হাজার দেড় হাজার বছরের প্রতিষ্ঠান বা প্যাগোডা সযত্নে সংরক্ষণ করেছে। এর সাথে ইন্দোচীন বা ইউরোপীয়ন ফ্রেঞ্চ গথিক স্থাপত্যগুলিও সযত্নে সংরক্ষণ করেছে। হা লং বে-র প্রাকৃতিক সৃষ্টিও অক্ষুন্ন রেখেছে। এসে না দেখলে বিশ্বাসই করতাম না।
আমার মতে এখানের প্রধান দর্শনীয় স্থানগুলি
সায়গনের War Remnants Museum, Cu Chi Tunnels, Xá Lợi প্যাগোডা, Gia Long Palace, এখন এটি Ho Chi Minh City মিউজিয়াম, সায়গন পোস্ট অফিস, Ben Thanh মার্কেট (কলকাতার নিউ মার্কেট মনে হবে), Notre Dame Cathedral, ডিসট্রিক্ট ওয়ানে উদ্দেশ্যহীন হয়ে বেড়ানো, এবং অবশ্যই রাতের সায়গন নদীতে সফর এবং খোলা জিপের নাইট সাফারি। এরপর হাতে সময় থাকলে মেকং ডেল্টা, Mariamman হিন্দু মন্দির, Bitexco Financial Tower, Thien Hau Temple, Golden Dragon Water Puppet Theatre, Vietnam History Museum, Suoi Tien Theme Park, সায়গন মার্কেট।
হ্যানয় শহরে দেখতে হবে ট্রেন স্ট্রীট, ১০৭০ খ্রীস্টাব্দের Temple of Literature, ষষ্ট শতাব্দীর Chua Tran Quoc প্যাগোডা, Bat Trang Ceramic Village, হ্যানয় অপেরা হাউস, Hoan Kiem Lake আর Hoan Kiem Lake Walking Street, সঙ্গে উইক এন্ড স্ট্রীট শপিং, One Pillar Pagoda, Presidential Palace, হ্যানয় ফ্রেঞ্চ কোয়ার্টার (Ba Dinh District), Hang Bac Street এ কয়েক শতাব্দী প্রাচীন রুপোর বাজার (traditional silver crafting), Quang Ba Flower Market আর Water Puppet Theatre
একদিনের Ha Long Bay ক্রূজ সফর, সঙ্গে Sung Sot গুহা (Surprise Cave) দর্শন, এবং সম্ভব হলে প্রাগঐতিহাসিক যুগের ড্রাম গুহায় নৈশভোজ।
Hoi An শহর হেরিটেজ সেন্টার ও Lantern Festival
দানাং শহরে গোল্ডেন ব্রিজ, আর Bana Hills এর উপ্র Mercure Danang (ফ্রেঞ্চ ভিলেজ)।
অবশ্যই এগুলো আমার ব্যাক্তিগত ভালোলাগার মতামত।
আর যারা একদা লাল সূর্য্য ও লাল বিপ্লবের স্লোগান দিয়েছিলেন, তাঁদের তো অবশ্যই আসা উচিৎ।
নমস্কার
*******
XYZ
Add comment