Asim Deb Writings

অচেনা ভিয়েতনাম – তৃতীয় অধ্যায়

অচেনা ভিয়েতনাম – তৃতীয় অধ্যায়
(ষষ্ঠ পর্ব)
@Asim Deb

পরদিন সকালের ব্রেকফাস্টে আবার দেখা আগের দিনের সর্দার সর্দারনীর সাথে, এক্কেবারে সামনা সামনি, পালাবার পথ নেই। আমি চুপ, নিজের থেকে কোন কথা বলি না। তখন সর্দার নিজেই বলে, “কাল কেলা খা লিয়া, ইয়ে ভেজ নন-ভেজ কা চক্করমে তো হামারা দিমাকই খারাপ হো গিয়া।”
আমি বলি “কেলা?’
– হ্যাঁ কেলা। রেস্তোরাঁ ব্রেকফাস্টমে কেলা খা লিয়া। দুপহরমে রাস্তে মে কেলা মিলা, তো খা লিয়া। আউর রাত মে শাকাহারী রেস্তোরামে থোড়া সা দাল আর চাউল খায়া।
– আপনে একই দিনমে এতনা কেলা খায়া?
– আরে ম্যায় নেহি। মেরা সর্দারনী। আজ ভি কেলা খায়গী, সুবে আর দুপহরমে।
আমি কি করি? একজন স্বদেশীনী ব্যাঙ, অক্টোপাস খাদকদের দেশে বেড়াতে এসে চাইলেন যে হোটেলের নিরামিষ রান্নাঘরে তাঁর জন্য আলাদা নিরামিষ বাসনে যেন নিরামিষ রান্না হয়। এই সমস্যায় জর্জরিত হয়ে তিনি গতকাল সারাদিন কলা খেয়েই কাটিয়ে দিলেন। অভিনন্দন জানাই? নাকি বলি, “সাব্বাস মেরা ভাই, ভাবী তো কেলা খাকে কামাল কর দিয়া”?

একবার পন্ডিচেরি (লোকে মারবে, কান ধরে শিখিয়ে দেয়, পুদুচেরি বলতে হয়) গিয়ে হোটেলে লাল লাল কলা দেখেছিলাম। প্রথমে মনে হয়েছিলো, সেগুলি শুধুই সাজানো। দর্শনীয় বস্তু। কিন্তু দেখি কয়েকজন অনায়াসেই সেগুলি খেয়ে নিলো, খাওয়ার পরে তেনাদের শরীরে কোন সাইড এফেক্টও নজরে এলো না। তখন মনে হলো, সেগুলিও তাহলে নিশ্চয়ই খাদ্যবস্তুই ছিলো।

সর্দারকে এমনই একটা মিথ্যা ছেড়ে দিলাম, “ভিয়েতনাম মে বহুত আচ্ছে লাল লাল কেলা মিলতা হ্যায়। বহুত আচ্ছা টেস্ট আউর হেলথ কে লিয়ে ভি আচ্ছে হ্যায়।“
সর্দার দেখি আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ব্যাটা ভাবছে, কতটা সত্যি। ম্যানেজ করে দিলাম, “আনে সে পহলে এক ট্রাভেল ম্যাগাজিন মে পড়া, লেকিন ইধার আনে সে তো কুছ নজর নেহি আয়া।“
আরেকটু দিলাম, “বেন থাই মার্কেট যাও, সায়দ মিল জায়েগা।“
এইবার আমি পালাই। ওভারডোজের সমস্যার সম্ভাবনা আছে।

রেস্তোরাঁয় আমি দেখি যেদিকে ফল সাজানো, সেখানে এক নতুন ধরণের ফল, লাল রঙের। অনেকটা আনারসের মতন। ফল অধিকাংশই আমার অচেনা বস্তু, আমি খুবই কম ফল খাই। আর বিদেশে এসে এক্সপেরিমেন্টে আমার কোন দরকার নেই। ব্রেড ওমলেট থাকলেই হলো। নিশ্চিন্ত। সেই লাল রঙের ফলের ফটো নিয়ে বন্ধুদের হোয়াটসএপ গ্রুপে দিতেই এক দোস্ত হিমাইরাজা বলে ড্রাগন ফ্রুট। তাঁর পাড়ায়, মানে কলকাতার পাটুলিতে নাকি প্রচুর পাওয়া যায়। একে বিশ্বাস করা কঠিন। কখনো বলে পাটুলিতে হাতিও পাওয়া যায়। যাই হোক, ড্রাগন হতে দূরে থাকাই নিরাপদ। যদি সত্যি হয়, তাহলে ৬৮ বছর বয়সে ড্রাগন ফল আমার এক আবিস্কার। সামনেই ড্রাগন ফলের এক কাটা পিস, ভেতর সাদা রঙের। হিমাইরাজা বলে পাটুলির ড্রাগন ফলের ভিতর হলুদ রঙের হয়। কি মুস্কিল? একই ফলের ভিতরটায় ভিয়েতনামে সাদা, আর কলকাতার পাটুলিতে হলুদ?
ভগবানের কি লীলা!!

যারা ড্রাগন খাবি খা, আমি পাউরুটি, ভিয়েতনামী ডিমের বড়া আর মাখনেই সন্তুষ্ট। খাওয়ার সময় রেস্তোরাঁর কন্যাটিকে বলতে হয় না। নিজেই আসে, একটু ভিয়েতনামী কফি আনি? “হ্যাঁ, প্লিজ”। গত কয়েকদিন যাবৎ সে রোজ আমাদের জন্য কফি আনে। জানে, ব্ল্যাক কফি। এক কাপে আমার মন ভরে না, আবার এক কাপ খাই। মেয়েটি রাগেও না। তারপর সকালে যে পরিমান ডিম পাউরুটি সাঁটাই, তারপর বিকাল তিনটা চারটা পর্যন্ত আর খিদেই পায় না।

খাওয়ার পর রিসেপশন ডেস্কে গিয়ে জানতে চাই এখানে কাছাকাছি কোন ব্যাঙ্কে ফরেন এক্সচেজ করা যায়? সে বলে এখানেই করা যায়। আমি বলি, আমরা সিঙ্গাপুর থেকে আসার সময় কিছু সিঙ্গাপুর ডলার সঙ্গে আছে, তাঁর বদলে যদি ভিয়েতনামী ডলার পাওয়া যায়। এবার সে বলে, মোটামুটি ভালো যে কোন কারেন্সি এখানের যে কোন হোটেলেই এক্সচেঞ্জ করে। ব্যাংকে যাওয়ার দরকার নেই। সেই করে দিলো, সময় লাগলো এক মিনিটেরও কম, এবং ভিয়েতনাম রিজার্ভ ব্যাংকের যা রেট, সেই রেটেই। মাঝখানে কোন কমিশন নেই। আর তাঁর সাথে স্ট্যাম্প করা রসিদও, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের রেট উল্লেখ করা। আমার একটু অবাকই লাগে। অন্য দেশে কি হয় জানি না, কলকাতার হোটেলে কোন এক দেশের লোক (ধরে নি ভিয়েতনামের) অন্য দেশের কারেন্সির (ধরে নি সিঙ্গাপুর ডলার) বদলে ভারতীয় টাকা পাবে? জানি না। পরে জানলাম, ভিয়েতনাম সরকার ট্যুরিস্টদের জন্য কিছুদিন আগে সিস্টেম অনেক ওপেন (লিবারেল) করে দিয়েছে। আমাদের ব্যাঙ্কে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিলো, এখন আর যাওয়ার দরকার নেই

******

সায়গন শহরের মিউজিয়াম
ভিয়েতনাম নিজেদের অতীত খুব সুন্দরভাবে সংরক্ষন করেছে। শুধু সায়গন শহরেই দশ দশটি মিউজিয়াম আছে। এগুলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য
• War Remnants Museum
• FITO Museum
• Ho Chi Minh City Museum
• Fine Arts Museum
• Museum of Vietnamese History
আমার লেখার দ্বিতীয় পর্বে War Remnants Museum নিয়ে আগেই লিখেছি।

উপরে যেগুলি বলেছি, তার মধ্যে Ho Chi Minh City Museum সবথেকে উল্লেখযোগ্য। আর এর ইতিহাসেরও ঘনঘন বদল হয়েছে। আগে নাম ছিলো Gia Long Palace (Vietnamese: Dinh Gia Long, French: palais de Gia Long), এখন সরকারীভাবে এটি Ho Chi Minh City Museum (Vietnamese: Bảo tàng Thành phố Hồ Chí Minh)। Lý Tự Trọng আর Nam Kỳ Khởi Nghĩa স্ট্রীটের কোনায় দুই হেক্টর জমিতে এর অবস্থান। প্রথম পর্বে Independence Palace এর উল্লেখ করেছিলাম, এটি তার কাছেই।

উপরে ফাইল ফটো ১৯৬৬
এর নির্মান কাজ চলে ১৮৮৫-১৮৯০ এই সময়ে। ফরাসী আর্কিটেক্ট Alfred Foulhoux, পরিকল্পনা করেছিলেন যে এখানে Museum of Commercial Trade হবে, কিন্তু ফ্রেঞ্চ ইন্দোচায়নার অন্তর্গত ফ্রেঞ্চ কোচিনচায়নার গভর্নর Henri Éloi Danel (1850 – 1898) এটিকে নিজের বাসভবন বানিয়ে নিলেন। তখন কলোনিয়াল যুগ, আর গভর্নরের প্রবল প্রতাপ। কেউ কিছু বলার নেই। গভর্নর দুই হেক্টর জমির একটা মিউজিয়ামকে নিজের বসতবাড়ি বানিয়ে জমিয়ে বসলেন।

এরপর এখানের ইতিহাসের ক্রমাগত বদলের মজার শুরু ১৯৪৫ সালে।
• ১৯৪৫ সালের ৯ মার্চ জাপানী ইম্পিরিয়াল আর্মি ফ্রেঞ্চ ইন্দোচায়নার গভর্নর Ernest Thimothée Hoeffel কে গদীচ্যুত করে বন্দী করেন। এবং এই বাড়ির নতুন ঠিকানা হয় জাপানী গভর্নর Yoshio Minoda এর নামে।
• কিন্তু তাঁর কপালে এই বাড়ির আরাম বেশিদিন সইলো না। মাত্র পাঁচ মাস পরে ১৪ই আগস্ট, ১৯৪৫, জাপান নিজের পছন্দের একজন সুবোধ লেফটেন্যান্ট জেনারেল গভর্নরকে খুঁজে পায়। নতুন গভর্নর Nguyễn Văn Sâm এলেন, গালভরা উপাধি নিয়ে The Empire of Vietnam Government.
• ইনি ছিলেন মাত্র ১১ দিন। ২৫ আগস্ট ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট পার্টি Việt Minh লেফটেনান্ট জেনারেল গভর্নর Nguyễn Văn Sâm কে, আর উনার সেক্রেটারি অফ দ্যা অফিস Hồ Văn Ngà কে বন্দী করে। সেদিন রাতারাতি এই Gia Long Palace হয়ে যায় Headquarters of the Provisional Administrative Committee of Southern Vietnam, পরে নাম পরিবর্তন করে হয় “People’s Committee of Southern Vietnam”.
• মাত্র পঁচিশ দিনের ব্যাপার। ১০ই সেপ্টেম্বর তারিখে ব্রিটিশ মিলিটারি মিশনের লেফটেন্যান্ট কর্নেল B. W. Roe এখানের People’s Committee-র লোকজনদের বিতারিত করে এই হেডকোয়ার্টার দখল করেন, আর নতুন নামকরণ করেন Allied Mission Headquarters.
• আবার পঁচিশ দিনের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। অক্টোবরের পাঁচ তারিখে ফ্রেঞ্চ হাইকমিশনার জেনারেল Leclerc এটিকে ইন্দোচায়নায় ফরাসী রিপাবলিকের অস্থায়ী হাইকমিশনে পরিনত করেন। তখম নেপথ্যে একটি ঘটনা ঘটে। Norodom Palace, যা পরে ১৯৬৬ সালে পুনঃনির্মান হয় এবং ১৯৭৫ সালে ভিয়েতনামের যুদ্ধজয়ের পরে The Independence Palace (Vietnamese: Dinh Độc Lập), বা Reunification Convention Hall নামে স্বীকৃতি পায়, তৎকালীন ফ্রেঞ্চ হাইকমিশনের এডমিরাল Georges Thierry d’Argenlieu সেই Norodom Palace কে ফ্রেঞ্চ কমিশনারের হেডকোয়ার্টারে পরিনত করেন।

ইতিমধ্যে ভিয়েতনামের বিভিন্ন স্থানে গেরিলা আর ফ্রেঞ্চ মিলিটারিদের মধ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দখল, আবার দখল, পুনঃদখল ইত্যাদি চলতেই থাকে।
• ১৯৪৮ সালের ২রা জুন, ইন্দোচায়না পুনঃদখলের পরে সেই আদি বাসস্থানের …….. কি যেন একটা নাম ছিলো, আসলে এত ঘন ঘন নাম পরিবর্তন হলে আদি নাম কি আর মনে থাকে? হ্যাঁ, মনে পড়েছে Gia Long Palace । সেই আদি Gia Long Palace এ রাজকীয়ভাবে আসেন নতুন রাজা Trần Văn Hữu আর সেই Gia Long Palace এর নতুন নাম হয় Palace of the Premier, আর নতুন রাজার উপাধি হয় Premier of the State of Vietnam.
• ১৯৫৪ সালের ২৬শে জুন থেকে ৭ই সেপ্টেম্বর, এই আড়াই মাস Ngô Đình Diệm এটিকে নিজের বাসভবনে পরিবর্তন করেন কারণ ফ্রেঞ্চ হাইকমিশনার Paul Ely তখন Norodom Palace টি দখল করে রেখেছিলেন। ১৯৫৫ সালে বিমানবাহিনীর বিদ্রোহী পাইলট সেনারা Norodom Palace এ বোমাবর্ষণ করলে ১৯৬২ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রিপাবলিক অফ ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট এটিকে নিজের দখলে রাখেন।
• ১৯৬৬ সালের ৩১শে অক্টোবর ভিয়েতনামের সুপ্রিম কোর্ট এখানে স্থানান্তরিত হয়।
• আর ৩০শে এপ্রিল, ১৯৭৫ সালে আমেরিকানদের বিরুদ্ধে ভিয়েতনামের জয়ের পর ১৯৭৮ সালের ১২ই আগস্ট Ho Chi Minh City People’s Committee এটিকে Ho Chi Minh City Revolutionary Museum (Bảo tàng Cách mạng Thành phố Hồ Chí Minh) এ পরিনত করে।

সুতরাং কিছুদিন পরে পরেই Norodom Palace, Gia Long Palace, Museum of Commercial Trade, Palace of the Premier, Allied Mission Headquarters, অস্থায়ী হাইকমিশন, People’s Committee of Southern Vietnam, সুপ্রীম কোর্ট, Independence Palace, একই ঠিকানায় এতসব নতুন নতুন নামের ধাঁধায় কোন আয়ারাম গয়ারাম গভর্নর, বা প্রেসিডেন্ট বা Empire of Vietnam কবে কোন বাড়িতে এলেন গেলেন, নিজেদের মধ্যে বাসাবদল করে নিলেন, সে সব টুকে লিখে না রাখলে মনে রাখাই দায়।

তবে লক্ষণীয়। ব্রিটিশ আমলে আমাদের দেশের গভর্নরেরা সবাই ছিলেন ব্রিটিশ, যেমন হেস্টিংস, কার্জন, ডালহৌসি, বেন্টিংক, ক্যানিং, কিন্তু এখানে সে ফ্রেঞ্চ আমলেই হোক, বা আমেরিকান আমলেই হোক, ফ্রেঞ্চ বা আমেরিকানরা কিন্তু নিজেদের পছন্দের আজ্ঞাবহ ভিয়েতনামীদেরই গদিতে সাজিয়ে রেখে দিয়েছিলো।

উপরে আমি ১৯৪৫ সাল থেকে উল্লেখ করেছি। সেইসময়ের আগে সম্রাট Bảo Đại র কিছু কথা উল্লেখ করতে হয়। ১৯২৬ থেকে ১৯৪৫, এইসময়ে Bảo Đại (১৯১৩-১৯৯৭) (Vietnamese: ɓa᷉ːw ɗâːj, মানে “Keeper of Greatness”, জন্মসূত্রে নাম Nguyễn Phúc / Phước Vĩnh Thụy (Hán tự: 阮福永瑞), ছিলেন ভিয়েতনামের Nguyễn রাজবংশের ত্রয়োদশ ও শেষ সম্রাট। ১৯২৬-১৯৪৫ সময়কালে উনি ফ্রেঞ্চ ইন্দোচায়নার অধীনে (protectorates) Annam আর Tonkin এর de jure রাজবংশের হয়ে শাসন করতেন। উপরে মার্চ ১৯৪৫ এর উল্লেখ করেছি। জাপানীরা Vichy French সরকারকে উৎখাত করে Bảo Đại কে ভিয়েতনামের গদিতে বসায়। কিন্তু ১৯৪৫ সালেই তিনি non-communist State of Vietnam এ চলে যান। মনে রাখতে হবে, উত্তর ও দক্ষিণ, এই দুই ভিয়েতনামের রাজনৈতিক সংযুক্তি হয়েছিলো ১৯৭৫ সালে।

যেহেতু এটি তৈরি হয়েছিলো Museum of Commercial Trade এর ধারণায়, এর প্রধান প্রবেশপথের দুপাশে ভিয়েতনামের শিল্প-বানিজ্যের দেবতার দু’টি মূর্তি (স্ট্যাচু) ছিলো (Goddess of Industry and Commerce)। কিন্তু ১৯৪৫ সালে তখনের ইন্দোচায়নার গভর্নর Governor Ernest Thimothée Hoeffel সেই স্ট্যাচু দুটিকে সরিয়ে বারান্দা (porch) তৈরি করেন।

স্থাপত্য হিসেবে ইন্ডিপেন্ডেন্স প্যলেসের তুলনায় এটি অনেক সুন্দর। ভেতরে, বাইরে দু’জায়গাতেই। ইন্ডিপেন্ডেন্স প্যলেসে গিয়ে শুধুই সাধারণ চেয়ার টেবিল আর দরজা জানালায় লম্বা লম্বা পর্দা ছাড়া আর কিছুই দেখিনি। কিন্তু এখানে অনেক কিছুই সংরক্ষিত আছে, যেমন বিভিন্ন রাজবংশের বিভিন্ন সময়ের ব্যাক্তিগত পোষাক, গয়না (jewelry fashion আর design), যুদ্ধে ব্যাবহৃত অস্ত্রশস্ত্র, পেইন্টিং, ব্যাংকনোট আর মুদ্রা (coins), বিভিন্ন সময়ের ম্যাপ, নানান রকমের দলিল আর চুক্তিপত্র, পেইন্টিং, আছে ২০০০ বছরের প্রাচীন লোহার কুঠার (stone axes)

এই দোতলা মিউজিয়ামের টেকনিক্যাল বর্ননা হলো Baroque architecture with European and Oriental influences. মেঝে, সিঁড়ি, আর বড় হলঘরগুলি ইউরোপীয় ঘরানার, আর মাথার উপরে Oriental স্টাইল। গ্রীক ঘরানার কিছু প্রতীক আছে (motifs)। প্যালেসের ভিতরে উপরের সম্মুখভাগে কিছু grotesques মূর্তি। grotesques মানে সহজ করে বলতে গেলে strange, mysterious, ugly, incongruous, unpleasant, or disgusting.

সামনের facade এ ত্রিকোনাকার ফ্রেমে আছে ফ্রেঞ্চ স্থাপত্য ঘরানায় মানুষের মুখ (geometrical motifs; যেমন human head, bust, decorative design), তার পাশেই দুদিকে ফুল, পাতা আর সাপ। আর কোনার দিকে আছে মোরগের মূর্তি, দিনের পরিচয় বহন করে, আর প্যাঁচা, রাতের পরিচয় বহন করে। সামনের ব্যালকনিতে আছে ভিয়েতনামের পতাকা। আর প্যালেসের চারদিক ঘিরে সুদৃশ্য ফুলের বাগান। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে এটির নির্মান হয় যখন ভিয়েতনাম ছিলো ফ্রেঞ্চ কলোনি, এবং স্থপতি ছিলেন একজন ফ্রেঞ্চ আর্কিটেক্ট। তাই এখানে ফ্রেঞ্চ বা ইউরোপীয় ঘরানার বহুল পৌরানিক প্রভাব দেখা যায় যদিও ভিয়েতনামের লোকেরা ছিলেন বৌদ্ধধর্মাবলম্বী।

স্থাপত্যের ভাষায়, কোন বড় বাড়ির বিভিন্ন স্থানে বৈচিত্র্য না আনলে দেখতে একঘেয়ে লাগে, তাই decorate to reduce edifice’s monotone. এই কারনেই বিভিন্ন ধরণের আর্টওয়ার্ক, স্ট্যাচু, পেইন্টিং, প্রাচীন দ্রব্যাদি দিয়ে প্যালেস বা মিউজিয়ামগুলি সাজানো থাকে। প্যালেসের বিভিন্ন স্ট্যচুর বা কাঠের কাজের বর্ননা ইংরেজিতে দেওয়াই সহজ হবে। এখানে বিভিন্ন sculptures আছে
• figurine (Italian শব্দ figurina, লাতিন figura, অর্থাৎ molded স্ট্যাচুর আকার, শরীর বা দেহসৌষ্ঠবের অঙ্গ (shape, body, or figure small carved. This figurine must have special significance, by its location, quality of workmanship).
• Genie (a magic spirit believed to take human form and serve the person who calls it),
• Hermes – প্রাচীন গ্রীক ধর্ম বা পৌরাণিক অলিম্পিয়ান মূর্তি, the God who is the protector of human heralds, able to move quickly and freely between the worlds of the mortal and the divine, aided by his winged sandals. Hermes plays the role of the psychopomp or “soul guide”—a conductor of souls into the afterlife.
• SAURIAN, a suborder (Sauria) of reptiles including lizards, in older classifications the crocodiles and various extinct forms.
• জাহাজ বা নৌকার সম্মুখভাগ (prow of the ship)

এবার পুরনো Museum of Commercial Trade এর অন্দরমহলের কিছু ছবি দিলাম। ছবি না দিলে শুধু লেখা দিয়ে মিউজিয়ামের ভেতরটা বোঝানো যাবে না।

এবার প্যালেসের কৌশলগত দিকটায় আসি।
১৯৫৪ সালের ২৬শে জুন থেকে ৭ই সেপ্টেম্বর, এই আড়াই মাস Ngô Đình Diệm এখানে ছিলেন। উনি ছিলেন ভিয়েতনামের সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী (১৯৫৪-৫৫), এবং দক্ষিণ ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট (১৯৫৫-৬৩)। ১৯৬৩ সালে মিলিটারি ক্যু’তে উনাকে হত্যা করা হয়। Ngô Đình Diệm তাঁর সময়কালে নিজের নিরাপত্তা ও প্রয়োজনে সপরিবারে পালিয়ে যাওয়ার রাস্তা পাকা করতে এই প্যালেসে তিনটে সুড়ঙ্গ তৈরি করেন। এই সুড়ঙ্গের দরজায় ছিলো ৬টি লোহার ভল্ট, আর ২.২ মিটার উঁচু এই সুড়ঙ্গের রিইনফোর্সড কংক্রিটের দেওয়ালের স্পেশিফিকেশন ছিলো 170 kg of iron / 1 m3 of concrete). দেওয়ালগুলো ১ মিটার চওড়া। সুড়ঙ্গের ভেতরে ছিল প্রেসিডেন্টের নিজের অফিস, কনফারেন্স হল, রেডিও রুম, ইলেকট্রিক রুম, বেডরুম, বাথরুম, ড্রেনেজ সিস্টেম, অক্সিজেন ভেন্টিলেশন সিস্টেম এবং জরুরী অবস্থার মোকাবিলায় ব্যাটারি রুম এবং সেই ১৯৫৪ সালে বিদেশী টেকনোলজি প্রয়োগ করে battery banks for uninterrupted power supply,. সুড়ঙ্গের অন্যপ্রান্তের দুটি রাস্তা গিয়ে পড়েছিলো Le Thanh Ton স্ট্রীটে। এবং সেই সময়ের আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ হয়েছিল একটি অনুন্নত দেশে, অবশ্যই ব্যাক্তিগত স্বার্থে এবং সরকারী কোষাগারের অর্থানুকুল্যে।  

১৯৬৩ সালের ক্যু’র সময় Ngô Đình Diệm পালিয়ে সায়গনের নিকটবর্তী Cholon অঞ্চলে নিজের এক সমর্থকের বাড়িতে আশ্রয় নেন। কিন্তু পরদিনই ধরা পড়ে যান, এবং উনাকে হত্যা করা হয়। এই Cholon অঞ্চলেই আজকের বিখ্যাত Bình Tây Market, যার কথা প্রথম ও তৃতীয় পর্বে উল্লেখ করেছি, কলকাতার নিউমার্কেটের সাথে তুলনা করে। এখানে বলছি Cholon ছিলো সায়গনের নিকটবর্তী অঞ্চল। তার কারণ ১৮৮৫ সালে সায়গনের জনসংখ্যা ছিলো ৫০ হাজার, আজ ৬০ লক্ষ। সুতরাং কালের নিয়মে Cholon এখন সায়গনের আর “নিকটবর্তী” নয়, সায়গন শহরেরই অন্তর্বর্তী একটি অঞ্চল।

*********

মারিয়াম্মান মন্দির
সায়গন শহরে একটি প্রাচীন হিন্দু মন্দির আছে, মারিয়াম্মান মন্দির (Mariamman Hindu Temple)। এটি প্রধানত দক্ষিণ ভারতীয়দের হিন্দু মন্দির, এবং স্বাভাবিক কারনেই এর স্থাপত্যে স্থানীয় বৌদ্ধ প্রভাব লক্ষণীয়।

তামিল ভাষায় মারি শব্দটির অর্থ বৃষ্টি, আর দ্রাবির মূল শব্দ আম্মান এর অর্থ মা। তামিলনাড়ুতে মারিয়াম্মানকে বৃষ্টির দেবতা বলা হয়। মারিয়াম্মান মূর্তির মুখশ্রী হয় সুশ্রী যুবতীর মতন, পোষাক হয় লাল রঙের। তবে উনার বিভিন্ন রূপ দেখা যায়, তখন তিনি তান্ত্রিকমতে আরাধ্য দেবতা, বরাভয়দাত্রী, যার এক হাতে থাকে ত্রিশূল, অন্য হাতে করোটি (খুলি)। সময় বিশেষে তিনি নাচের বিভিন্ন মুদ্রার প্রদর্শন করেন, সাধারনত অভয় মুদ্রা। স্থান, কাল আর বিশ্বাসের আধারে ইনি কখনও শান্তরূপী, কখনও বা উগ্র। আমাদের বাঙালিদের যেমন দুর্গা, কালী, ভৈরবীর বিভিন্ন রূপ আমরা দেখতে পাই।

উনবিংশ শতকের শেষভাগে অধুনা তামিলনাড়ুর থাঞ্জেভর জেলার পাট্টুকোট্টাই অঞ্চলের বনিক সম্প্রদায়ের পালানিয়াপ্পা থেভার এই মন্দিরটি নির্মান করেন। মন্দিরটি স্থাপত্যের দিক দিয়ে এমনকিছু উল্লেখযোগ্য নয়, তবে সুদূর প্রবাসে ভিয়েতনামে একটি হিন্দু মন্দির দেখার কিছুটা আকর্ষন তো থাকবেই। এখন ভিয়েতনামে বসবাসকারী প্রবাসী ভারতীয়রাই এই মন্দিরটির রক্ষণাবেক্ষণ করেন।

*****

কলকাতা শহরে যেমন চীনা মার্কেট আছে, সায়গন শহরে আছে রাশিয়ান মার্কেট। এটা ‘চালু’ নাম। ইতিহাস বলে, ভিয়েতনামের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় থেকেই রুশ-ভিয়েতনামের সুসম্পর্কের শুরু। তখন থেকেই আমেরিকান সেনাদের তালিকাভুক্ত অনেক ভিয়েতনামী গেরিলা ছাত্র ভয়ে রুশ দূতাবাসের মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নে গিয়ে আশ্রয় নেয়। শুধু সোভিয়েত ইউনিয়ন বললে ভুল হবে, চীন, কম্বোডিয়াতেও গিয়ে আশ্রয় নেয়। ওরা বলতো people of the red states.

১৯৮২-৮৬ সময়ে Nguyen Manh Cuong নামের একজন ভিয়েতনামী সেনা সোভিয়েত ইউনিয়নে পাইলট ট্রেনিং এর জন্য যান। ফিরে এসে কিছুদিন কাজ করার পরে সায়গনের ট্যাক্স ট্রেডিং সেন্টারে কিছুদিন, তারপর সায়গন স্কোয়ারে রাশিয়ান শো’রুম খোলেন। এরপর ভিয়েতনামের ওপেন ইকনমির সময় ২০০০ সালে সেন্ট্রাল গার্ডেন বিল্ডিং এ আরও কিছু বন্ধুবান্ধব ও ব্যাবসায়ীদের ডেকে নিয়ে এসে এই রাশিয়ান মার্কেট তৈরি করেন। তখন এই মার্কেটের এত নাম ছিলো না। সময়ের সাথে সাথে এখন শুধু ভিয়েতনামী বা চীনের লোকেরা নয়, অনেক রাশিয়ান পরিবারও এখানে এই তিনতলা মার্কেটে এসে বড় বড় শো’রুম খুলেছেন।

“I was just a soldier who left the army. I created this market in order to gather people who love Russia for doing business. A large number of vendors and workers had been in Russia, some are doctors, some are engineers, some were migrant workers who studied and worked in Russia”. – Nguyen Manh Cuong.

Chaowai Shichang অঞ্চলের 328 Vo Van Kiet Street, Co Giang Ward, District 1, গেলে দেখা যাবে Cyrillic স্ক্রিপ্টে লেখা রাশিয়ান সাইনবোর্ড, এখানে রাশিয়ান গান বাজে, ককেশিয়ান মেয়েরা ডাকাডাকি করে, ভিয়েতনামী মেয়েরাও রাশিয়ান বলে। দুর্বোধ্য ইংরেজি তো আছেই। তবে এই মার্কেটের একটি বৈশিষ্ট এই যে অনেক দোকানেই কাঁচের জানালায় পর্দা ঝোলানো, সুতরাং সব দোকানে উইন্ডো শপিং সম্ভব নয়। সিরিয়াস কাস্টমার হলে দোকানের ভিতরে গিয়ে দেখতে হবে। বিভিন্ন রকমের ঘরের প্রয়োজনীয় দ্রব্য পাওয়া যায়, তবে শীতের পোষাক বা ঠান্ডার সময়ের accessories কিনতে হলে এটাই সেরা জায়গা। এছাড়া রাশিয়ান দেশের আরও জিনিষ তো আছেই।

******

রাতের মোহময়ী সায়গন
রাত হয়ে গেলে দামী রেস্তোরাঁ তো আছেই, আছে পাব, নাইটক্লাব, ডিস্কো বার, ক্যাবারে। তবে প্যারিস বা লাস ভেগাসের কৌলিন্য এখানে নেই, পোষাকেও অত খোলাখুলি নেই। অনেক হোটেলের ছাদে ড্যান্স আর মিউজিক নাইটের আসর বসে। সুরাপান অবশ্যই আছে। শুনেছি লোকজন নিজেদের আমোদেই থাকেন। অহেতুক গ্যালারি শো’ করে অন্যদের বিরক্ত করে না। সুতরাং রাতের আসরে আমোদ খোঁজার লোকেদের জন্য অনেক কিছুই আছে।

আছে খোলা ছাদের ভিন্টেজ লিম্যুজিনে করে রাতের সায়গনে ঘুরে বেড়ানো। রাতের বেলায় দল বানিয়ে নিজেদের মতন করে ঘুরে বেড়ানো যায়। এগুলির কৌলীন্য উচ্চমাত্রার। নিজেদের তখন বেশ কুলীন অভিজাত সম্প্রদায়ের লোক মনে হয়। নিজের ফটো তুলে ফেসবুক আর হোয়াটসএপে সাঁটিয়ে দাও। এখনের জেনারেশন হলে ট্যুইটার বা ইন্সটাগ্রামে।

রাতের সায়গন শহরে স্ট্রীট ফুডের ছাড়াছড়ি। এক জায়গায় মাথার উপরে অনেক দেশের জাতীয় পাতাকা টাঙানো। মানে এখানে আসো, তোমার মুলুকের আইটেম আমার এখানে পাবে। দোকানগুলির ভীড় উপচে ফুটপাথে, মাঝেমধ্যে রাস্তায়ও। দূর হতে চীনা, থাই, ভিয়েতনামী রান্নার গন্ধ নাকে আসে। দোকানদারেরা বিভিন্ন বিদেশী ভাষা অল্প স্বল্প বলতে পারেন, কাস্টমারের মুলুক আন্দাজ করে সেই ভাষায় আহ্বান করেন। প্রচুর মিসফায়ার হয়। তবে হিন্দিতে আইয়ে জনাব, ইধার পধারিয়ে ইত্যাদি শোনা যাবে না।এখানে চিকেন মালাই কারি, ধোসা সম্বর বড়া, বা মাটন বিরিয়ানি পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। আমার মতন ভাত রুটি খাওয়া লোকেদের খুবই অসুবিধা। সকালের হোটেলের সর্দারনীর কথা মনে পড়ে গেলো। তবে উনি হয়তো খুঁজলে ফলের দোকানে কলা আপেল পেয়ে যাবেন।

একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। হোটেলে ব্রেকফাস্টের সময় একজনকে প্রশ্ন করেছিলাম, এখানে কি ফুড ফেস্টিভ্যাল হয়? বা হলে কোথায় কোন সময়ে হয়? তিনি অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে খানিক পরে বললেন, ইউ ইত হোয়াত ইউ ওয়ান্ত, আল ফুদ আর ফর ফেস্তিবাল।

*******

সায়গন শহরে Hồ Chí Minh Fine Arts মিউজিয়াম আছে, এটি কিন্তু সায়গনের Hồ Chí Minh City Museum থেকে আলাদা। সেখানে যাইনি, তবে অনেকেই যায়। নেট থেকে তার কিছু কিছু কপি পেষ্ট করে দিয়ে দিলাম।

ফরাসী আর্কিটেক্ট Rivera এটির ডিজাইন করেন, মূলত ফ্রেঞ্চ আর চাইনিজ সংমিশ্রণে। এই ভবনটির নির্মানকাজ শুরু হয় ১৯২৯ সালে, সম্পূর্ন হয় ১৯৩০ সালে। এটি প্রথমে ছিল ইন্দোচায়নার ধনকুবের Hui Bon Hoa পরিবারের বাসস্থান এবং অফিস। এই Hui Bon Hoa ছিলেন ম্যাজেস্টিক হোটেল, Tu Du Hospital, ও Ho Chi Minh City Emergency Center এরও মালিক। ১৯৭৫ সালে সরকার এটিকে ২১,০০০ আর্ট ও ক্র্যাফটওয়ার্কের মিউজিয়ামে রূপান্তরিত করে। ১৯৮৭ সালে সিটি পিপলস কমিটি এটিকে মিউজিয়াম অফ ফাইন আর্টস-এ রূপান্তরিত করে ও ১৯৯২ সালে এটির সরকারী উদ্ঘাটন হয়।

এখানে ভিয়েতনামের নিজিস্ব ঘরানার প্রচুর শিল্পকর্ম সংরক্ষিত আছে, বিশেষ করে বহু প্রাচীন সেরামিকের সংগ্রহগুলি, Ly Dynasty (১০১০-১২২৫ সময়ের) Tran Dynasty (১২২৬-১৪০০ সময়ের) এবং Le Dynasty (১৪২৮-১৫২৭ সময়ের). আর আছে মাটির তৈরি (pottery) কারুকাজ।

আর আছে ভিয়েতনাম ন্যাশনাল মিউজিয়াম, আগে নাম ছিল Musée Blanchard de la Brosse, ১৯২৬ সালে যার নির্মান করেছিলান Auguste Delaval (Architect of the French Government in Indochina), আর ১৯৭৯ সালে এটিকে ন্যাশনাল মিউজিয়ামে রূপান্তরিত করা হয়। মনে রাখতে হবে এই একই নামে হ্যানয় শহরেও একটি মিউজিয়াম আছে, National Museum of Vietnamese History in Hanoi. সেখানে প্রদর্শিত বস্তুগুলি (exhibits):
• প্রাগঐতিহাসিক যুগ (৫০০,০০০ থেকে ২৮৭৯ খৃষ্টপূর্ব).
• প্রস্তর যুগ (২৮৭৯ থেকে ১৭৯ খৃষ্টপূর্ব),
• ১৭৯ খৃষ্টপূর্ব থেকে ৯৩৮ খৃষ্টাব্দের স্বাধীনতা যুদ্ধ
• মেকং ডেল্টা অঞ্চলের Óc Eo সংস্কৃতি
• পাথর ও ব্রোঞ্জের বিভিন্ন মূর্তি, আর Champa শিল্পকর্ম (artifacts)
• কম্বোডিয়ার পাথরের মুর্তি (নবম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী সময়কালের)
আর আছে বিভিন্ন রাজত্বকালের সময়ের কাজ, যেমন
• Ngô, Dinh, Anterior Lê, Ly dynasties (৯৩৯ – ১২২৫)
• Tran and Ho dynasties (১২২৬ – ১৪০৭)
• Dynasties from the Lê to the Nguyên (১৪২৮ – ১৭৮৮)
• Tây Sơn dynasty (১৭৭১ – ১৮০২)
• Nguyễn dynasty (১৮০২ – ১৯৪৫)

******

অচেনা ভিয়েতনাম, সপ্তম পর্ব
@Asim Deb

আজ হ্যানয় অভিযানের প্রথম দিন।
সায়গন থেকে হ্যানয় এয়ারপোর্টে নেমে হোটেলে যেতে যেতে বেলা দুটো বেজে গেলো। এটা আমাদের ট্যুর প্ল্যানের একটা স্ট্র্যাটেজিক ভুল। সিঙ্গাপুরে, ব্যাংককে পৌঁছেছিলাম একদম ভোরবেলায়, যাতে পুরো দিনটাই হাতে পাওয়া যায়। তবে সিঙ্গাপুর আর সায়গন মিলিয়ে গত আটদিনে আমরা এত হাঁটাহাঁটি করেছি যে এবার একটু বিশ্রামেরও দরকার ছিলো। সায়গনে সকালের রেস্তোরাঁয় যে পরিমান ঠাসিয়েছি, দুপুরের খাওয়ার আর দরকারই পড়ে না। সকলেই ঘুম লাগালাম। ক্লান্তি কাটিয়ে যখন সবাই উঠলাম, সুর্যদেব অনেক আগেই অস্তাচলে চলে গেছেন। রুমের ব্যালকনিতে বসে সন্ধ্যার মেজাজে বড় বড় দু’কাপ ভিয়েতনামী কফি খেলাম। আজ আর কোথাও যাওয়া নয়। রাতে হোটেলেই চিকেন রাইস খেলাম। আমার স্ত্রীকন্যা কি কি খেলেন সেই নামগুলি ইহজন্মে শুনিনি। পরদিন, মানে কাল সকাল থেকে আমাদের হ্যানয় দর্শন শুরু হবে।

হ্যানয় নিয়ে ছোট্ট একটা ভূমিকা দি। হ্যানয় (Vietnamese: Hà Nội), দুটো আলাদা শব্দ, আমরা একসাথে জুড়ে বলি হ্যানয়, এর অর্থ ‘Inside of the rivers’, ১২টি ডিস্ট্রিক্ট, ১৭টি মফস্বল ডিস্ট্রিক্টের সাড়ে তিন হাজার স্কোয়ার কিলোমিটার জায়গা নিয়ে এটি ভিয়েতনামের রাজধানী, আর দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। ‘Inside of the rivers’ কারণ হ্যানয় শহরটি রেড নদীর ডেল্টার মধ্যখানে।

ইতিহাস খুঁজলে হ্যানয় এক অতি প্রাচীন শহর, খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে এর প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। খ্রীষ্টপূর্ব ১১১ সালে চীনের হুণ রাজাদের অধিগ্রহণের আগে Văn Lang রাজবংশের রাজারা এখানে রাজত্ব করতেন। নতুন শহরের নাম হয়েছিলো Thăng Long (‘Ascending Dragon’)। ১০১০ সালে সম্রাট Lý Thái Tổ এখানে ইম্পিরিয়াল ভিয়েতনামের পত্তন করেন। ১৮৩১ সালে নতুন নাম হয় হ্যানয়। ১৮৮৩ সালে ফ্রান্স ভিয়েতনামের দখল নেয়। ১৯৪৫ সালে হো চি মিন এর নেতৃত্বে ভিয়েতনাম স্বাধীনতা লাভ করে, ১৯৪৬ সালের ৬ই জানুয়ারি হ্যানয়কে স্বাধীন ভিয়েতনামের (সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক অফ ভিয়েতনাম) রাজধানী ঘোষনা করা হয়। এরপর আমেরিকার বিরুদ্ধে ভিয়েতনামের দ্বিতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধের (১৯৫৫-১৯৭৫) পরে ১৯৭৬ সালে হ্যানয় সংযুক্ত ভিয়েতনামের রাজধানী ঘোষিত হয়। অর্থাৎ, খুবই সংক্ষেপে, দু’হাজার বছরের ইতিহাসে বহু দেশী বা বহিরাগত রাজবংশীয় রাজা আর লুঠেরার দল এখানে অনেক রক্তপাত ঘটিয়েছেন।

উল্লেখ করতে হয় যে, এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে হ্যানয়ই একমাত্র ইউনেস্কো স্বীকৃত “City for Peace” শহর, recognizing its contributions to the struggle for peace, its efforts to promote equality in the community, protect the environment, promote culture and education, and care for younger generations. ১৬ জুলাই ১৯৯৯ সালে হ্যানয় এই স্বীকৃতি অর্জন করে। এরপর ২০১৯ সালের ৩১ অক্টোবর ইউনেস্কো হ্যানয়কে Network of Creative Cities as a Design City স্বীকৃতি দেয়।

শুরু করি Grand Palais দিয়ে। ১৯০২-০৩ সালে বিশ্বমেলা ও প্রদর্শনী উপলক্ষ্যে এই Grand Palais de l’Exposition (Vietnamese: Nhà Đấu xảo) ভবনটির নির্মান হয়। এখন এর অস্তিত্বই নেই। বোমা মেরে আমেরিকানরা এই ভবনটি গুঁড়িয়ে দিয়েছে। নীচে সেই ছবি দিলাম।

উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকেই ফরাসীরা এখানে আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করে। আর ফরাসী সংস্কৃতি আর স্থাপত্যও প্রসার লাভ করে। তার আগের দু’হাজার বছরের চীন ও বৌদ্ধধর্মের প্রভাব বিস্তারের সাথে সাথে সেই সময় থেকেই নতুন ফরাসী সংস্কৃতিও ধীরে ধীরে এখানে যোগ হয়ে যায়। ফরাসী আর্কিটেক্ট Adolphe Bussy এই Grand Palais ভবনটির ডিজাইন তৈরি করেছিলেন। অনেকটাই ১৯০০ সালের প্যারিসের Le Grand Palais Exposition Universelle এর আদলে এটির তৈরি। ফরাসীরা চিরকাল সৌন্দর্য, শিল্প, সংস্কৃতি, স্থাপত্যের ধারক, বাহক ও পৃষ্ঠপোষক। শুধু নিজেদের দেশে নয়, বিদেশেও এর প্রমাণ ওনারা রেখে গেছেন। ভিয়েতনামও ব্যাতিক্রম নয়। ভিয়েতনামে বৌদ্ধধর্মের ঐতিহাসিক প্রভাবের পাশাপাশি এখানে ফরাসী শিল্প, সংস্কৃতি, স্থাপত্যও ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে। দুঃখের কথা, স্বাধীনতা যুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গেরিলাবাহিনীকে সামাল দিতে না পেরে হতাশাগ্রস্ত আমেরিকানরা একের পর এক ঐতিহ্যগুলির ধ্বংসলীলা চালিয়ে গেছে। এই আমেরিকনদের সূক্ষ্ম সৌন্দর্য, শিল্প, সংস্কৃতির বোধশক্তি কোনোদিন ছিলো না, বিন্দুমাত্র আগ্রহও কোনোদিন ছিলো না। তাঁরা নির্বিচারে ধ্বংসলীলা চালিয়েছে। পৃথিবীর সর্বত্র।

Grand Palais ভবনটির ধ্বংসলীলার পরে শুধুমাত্র সিংহের দুটি ব্রোঞ্জের স্ট্যাচু পড়ে ছিলো, সেই দুটি স্ট্যাচু ভিয়েতনাম সেন্ট্রাল সার্কাসের সামনে রিইউনিফিকেশন পার্কে রেখে দেওয়া হয়েছে। বিশ্বমানের একটি নিদর্শনকে ধ্বংস করে দিতে আমেরিকানদের বিন্দুমাত্র কুন্ঠা হয় নি।

আমেরিকান বোমাবর্ষনের পরে সেই ধ্বংসস্তুপেরই উপর এখন ফ্রেন্ডশিপ কালাচারাল প্যালেস তৈরি হয়েছে। (Vietnamese: Cung Văn hoá Hữu nghị), এর আগে একদম শুরুর সময়ে ১৯০৩ সালে প্রদর্শনী মেলা শেষ হয়ে গেলে Grand Palais কে ফ্রেঞ্চ ইন্দোচীনের প্রথম ও বৃহত্তম মিউজিয়ামে পরিনত করা হয়েছিলো, তৎকালীন গভর্নর জেনারেল এর নামে, Maurice Long Museum,

*****

সকালে তাড়াতাড়ি ব্রেকফাস্ট করে নিলাম, এককথায় গাণ্ডেপিণ্ডে খেয়ে। আমার তো ফিক্সড মেনু, অচেনা খাদ্য সইবে না। তাই শুধুই পাউরুটি, মাখন আর ডিমের বড়া। সবার শেষে ব্ল্যাক কফি। গত দিন সাতেক এই চলছে। এবার রিসেপশনে এসে হ্যানয়ের সিটি ম্যাপ চাইলে ভদ্রলোক পরিস্কার ইংরেজিতে জবাব দিলেন, সিটি ম্যাপ তো নেই। আমি অবাক, আজকাল তো ইন্টারন্যাশনাল ট্যুরিস্টদের জন্য সব বড় হোটেলেই সিটি ম্যাপ থাকে, এখানে কেন নেই? পাশে একটি মেয়ে ছিলো, সে নিজেদের ভাষায় লোকটিকে কি যেন বললো। তারপর লোকটি অত্যন্ত অনুতপ্ত হয়ে জানালো যে সে ইংরেজিটা ভালো বুঝতে পারে নি, সিটি ম্যাপ তাঁদের কাছে আছে। মেয়েটি সিটি ম্যাপ এনে দিলো, তার সাথে ছোট একটা ট্যুরিষ্ট গাইড।

আমাদের ট্যুর প্ল্যান মোটামুটি করাই ছিলো। প্রথমেই যাবো ট্রেন স্ট্রীট। এই ট্রেন স্ট্রীট কেন, কবে বিখ্যাত হয়ে গেলো সেই ইতিহাস কোথাও নেই। ১৯০২ সালে এই লাইনটি পাতা হয়। Ngõ 224 Lê Duẩn নামের হ্যানয় ওল্ড কোয়ার্টারের পুরনো অঞ্চলে পুরনো দিনের দুইপাশের সব বাড়ির পিছন দিকে (ব্যাক সাইড) একটা সরু গলির মধ্য দিয়ে এই ট্রেন লাইনটি গেছে।

যুক্তি দিয়ে ভেবে পাই না এই ট্রেন লাইন এত বিখ্যাত হওয়ার কি আছে? কিন্তু দেশ বিদেশের ট্যুরিস্টরা দলবেঁধে এখানে আসে। এই ট্রেন স্ট্রীট নাকি হ্যানয়ের most unique, most famous এবং একই সাথে most dangerous tourist spot. ভয়ের কারণ এই যে কিছু কিছু জায়গায় গলিটি খুব চওড়া নয়, সেখানে ট্রেনটি আপনার মাত্র দু’হাত পাশ দিয়ে ঘণ্টায় প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার বেগে চলে যাবে, সেই ভয় বা রোমাঞ্চটাই এখানের অভিজ্ঞতা। তবে, সুখের কথা যে আজ পর্যন্ত একটিও দুর্ঘটনা এই গলিতে হয় নি।

কোন একসময়ে একজন মহিলা নাকি এই গলিতে একটি চা কফির দোকান করেছিলেন। দেখাদেখি আরও কয়েকজন এখানে ছোট ছোট চা কফির দোকান সাজিয়ে বসেন। ধীরে ধীরে খদ্দের বাড়তে থাকে, দোকানের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। রোদ কম থাকলে ট্রেন লাইনের উপর স্টুল পেতে বসে চা কফি বীয়ার খাও। আর ট্রেন আসার কয়েকমিনিট আগে উঠে পড়ো। ট্রেন যখন আসে, আমার মাত্র দু’হাত দূর দিয়ে চলে যায়, তখন ব্যাপারটা বেশ নতুন আর রোমাঞ্চকর লাগে। ট্রেন আসার সময়েই লোকজনের ভীড় বেশি হয়, দোকানীদেরও উপার্জন হয়। যেখানে গলি সরু হয়ে গেছে, সেখানেই ভীড় বেশি। বাড়ির দেওয়াল থেকে মাত্র ২০ সেন্টিমিটার দূরে একটা হলদে দাগের লাইন কাটা আছে, আর ট্রেন যাওয়ার সময় আমাকে বাড়ির দেওয়ালে ফিট করা শক্ত কিছু একটা ধরে নিজেকে সেই দাগের মধ্যে ধরে রাখতে হবে। locals are rushing into their houses, making sure that their kids, pets, motorbikes, or any other belongings are safe inside. Nothing can be left outside.

ট্যাক্সি করে আমরা যখন নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে পৌছালাম, দেখি রাজপথের মধ্যে দিয়ে ক্রস করে লাইন চলে গেছে। আপ-ডাউন মিলিয়ে রাস্তাটি প্রায় ১২০-১৫০ ফিট চওড়া, দু’দিক দিয়েই খুব ঘনঘন না হলেও যানবাহন মোটামুটি ভালোই চলছে, কিন্তু আশ্চর্য্জনক যে এখানে কোন লেভেল ক্রসিংই নেই। ট্রেন স্ট্রীটের গলিতে ঢোকার মুখের এক কোনায় একজন উর্দি পড়া লোক বসে আছেন, তিনিই বোধহয় লেভেলম্যান হবেন। আমরা গলিতে ঢুকতে যাবো, লোকটি হাউ হাউ করে দুর্বোধ্য ভাষায় কিসব বলতে শুরু করলো।

দেখিয়ে দিলেন, একটা নোটিশ ঝুলছে। নোটিশ পড়ে বুঝলাম ঢুকতে মানা। আমার মতন আরও কয়েকজন সেখানে দাঁড়িয়ে। অথচ ভেতরে বেশ কিছু লোকজন, দূর থেকেই বোঝা যায় যে বিদেশী। তাহলে ওঁরা ভেতরে গেলো কিভাবে? আর কিসেরই বা মানা? কিছুই বুঝতে পারছি না। ঠিক তখনই দেখি সেই ট্রেন লাইন ধরেই গলির ভেতর থেকে একজন দৌড়ে এসে জোরে জোরে “হে, হে” বলে ডেকে, তারপর হাতের ইঙ্গিতে আমাদের অপেক্ষা করতে বললো। আমরা দাঁড়িয়ে রইলাম। পনেরো বিশ সেকেন্ডের মধ্যেই লোকটা আমাদের সামনে এসে হাজির, বলে প্লিজ কাম, স্যার। আমরা ওঁর পিছনে পিছনে গলির কোনার বাড়িটার সরু সদর দরজা, চওড়ায় মাত্র আড়াই তিন ফুট আন্দাজ হবে, সেই অন্ধকার পথ দিয়ে ঢুকে এক্কেবারে ওঁর বসার ঘর, তারপর বেডরুমের মধ্যে দিয়ে গিয়ে পিছনের উঠানে এসে পড়লাম। উঠানে কোন দেওয়াল নেই, এটাই উনার চা কফির দোকান। পাশ দিয়েই ট্রেন লাইন চলে গেছে। বোঝা যায়, পুরনো পাড়া, তবে এখানে রোজ এত ট্যুরিষ্ট আসে, তাই দোকানীরাই জায়গাটাকে যথাসম্ভব পরিস্কার করে রেখেছে। আর এটাও বুঝলাম, এখানের সিস্টেম, সামনে উর্দিপড়া লোক নো এন্ট্রি নোটিশ দেখাবে, আর দোকানীরা অন্য পথে গলতা দিয়ে আমাদের ভেতরে নিয়ে যাবে।

আমাদের দোকানী ভদ্রলোক মাঝবয়সী, মোটামুটি ভালোই ইংরেজি বলেন, বোঝেন। ব্যাবসার তাগিদেই শিখেছেন। আমাদেরকে আদর করেই বসতে দিলেন। দেখলাম, সেই দোকানের দেওয়ালে কিছু পেইন্টিং লাগিয়েছেন, ছোট ছোট সেন্টার টেবিলের চারদিকে বসার জন্য ছোট ছোট স্টুল। টেবিলে ফুলদানি। সুন্দর ছিমছাম। চুপচাপ বসে থাকা যবে না, কিছু একটা খাদ্যবস্তু আমাদের নিতেই হবে। দোকানে চা কফি বিয়ার হার্ড ড্রিঙ্কস কেক কুকিজ বাদামভাজা স্যালাড ক্যাডবেরিজ সবই আছে। আমরা তো হেব্বি ব্রেকফাস্ট করেই এসেছি, তাই শুধু কফিই নিলাম, সাথে হাল্কা একটা কেক, আর বিস্কিট। তখনও ট্রেন আসতে আধঘন্টা দেরী, আরও কিছু নিতে হবে, একটা করে ডাব খেলাম। কফির পরে ডাব!! তাই সই।

আরও কয়েকজন বিদেশী, সকলেই আমাদের মতন সেই সরু গলির দরজা দিয়ে এসেছেন। তাঁরা নিলো চিলড বীয়ার। তাঁদের ভাষা বুঝিনা। একবার মনে হয় স্প্যানিশ, আবার মনে হয় পর্তুগীজ, বা জার্মান। আমরা হাতে ডাব নিয়ে দোকানের বাইরে ট্রেন লাইনের পাশেই এসে বসলাম। দেখি আশেপাশের দোকানেও সব বসে আছেন। যেদিকেই দেখি, সকলেই মনে হয় বিদেশী।

একসময় সরকার (ভিয়েতনাম রেলওয়ে কর্পোরেশন) বিপদের সম্ভাবনায় নোটিশ জারি করে দোকানগুলো বন্ধ করে দিলে, তখন দোকানীরা গিয়ে দরবার করেন যে সৎপথের উপার্জনে এত বাধা কেন? নিজেদের নিরাপত্তার খেয়াল তো নিজেরাই রাখবে। আর দুর্ঘটনা তো নিরাপদ জায়গাতেও হয়। অবশেষে, আইন আর সরকারি নোটিশ এখন তার নিজের জায়গাতেই আছে, দোকানগুলি আগের মতনই চলছে, আর সরকারও কিছু লোকের জীবিকার জন্য চোখ বন্ধ রেখেছেন।

খানিক বাদে দোকানী জনালেন, এবারে ট্রেন আসবে। উনি আমাদের সকলকে লাইনে দাঁড় করিয়ে দিলেন, আর দেওয়ালে খানিক দূরে দুরেই হ্যান্ডেল জাতীয় বস্তু আছে, বললেন সেটা শক্ত করে মুঠোয় ধরে রাখতে হবে। আশেপাশের বাড়ির লোকজন বাইরে রাখা জামাকাপড়, সাইকেল, বা রোদে দেওয়া জিনিষ সরিয়ে নিলেন। দোকানীরা চেয়ার,স্টুল ভেতরে নিয়ে গেলেন।

খানিক বাদেই দূরে ট্রেনের ইঞ্জিনের ভোঁওওও আওয়াজ। আর সব দোকানে সাজো সাজো রব। আমি এক হাতে মোবাইল ফোন, অন্য হাতে গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছি। আশেপাশের দোকানেও একই দৃশ্য। গলির দু’পাশে সবাই লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে, হাতে মোবাইল। দোকানীরা সাবধান করে দিচ্ছেন, মোবাইলে ফটো তুলতে হলে এক হাতে তুলতে হবে, অন্য হাতের মুঠো যেন আলগা না হয়। মিনিটের মধ্যেই আমার দুই কি আড়াই হাত পাশ দিয়ে ট্রেন চলে গেলো। বুঝলাম, কেন সরকার বলে এটি বিপদজনক। ট্রেনের গতি বেশ ভালো, অন্তত ঘণ্টায় পঞ্চাশ মতন হবেই। যথেষ্ট ভাইব্রেশন হলো, হাওয়ার বেগে আশেপাশের হাল্কা বস্তুই উড়ে যাবে। আর আমার মতন যারা লাইনের ধারে দাঁড়িয়ে, একটু অসাবধান হলেই বিপদ অনিবার্য। ভেবে দেখতে হলে, ট্রেন আমার মাত্র দুই আড়াই হাত দূর দিয়ে যাচ্ছে, আমি বাড়ির গায়ের লাগোয়া গ্রিল ধরে আছি। সব মিলিয়ে, এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা। নইলে দেশ বিদেশের এত এত লোকজন শুধু ঘন্টাখানেকের চা কফি বিয়ার খাওয়ার জন্য এই সরু গলিতে কেন আসবে? আমাদের আগে যারা গিয়েছে, অনেকের থেকেই শুনেছি যে রোদ কম থাকলে বা শীতের সময় যখন ট্রেন আসতে দেরি আছে, তখন লোকজন রেললাইনের উপরেই ছোট ছোট চেয়ার স্টুল পেতে বসে পড়ে।

এখানে গলি অনেকটাই চওড়া
আর সন্ধ্যার পরে বেশ মৌজ করেই বিয়ার আর ভিয়েতনামী খাদ্য নিয়ে লোকজন লাইন দিয়ে গলির দু’পাশে বসে যায়। অনেকেই বাড়ির দোতলায় মিনি রেস্তোরাঁ বানিয়েছে, সেখানেও ভালো ভীড় হয়।

অনেকের কাছেই এটা আকর্ষনীয় ফটোগ্রাফি স্পট।

নিজেকেই একটা প্রশ্ন করেছিলাম। লেভেল ক্রসিং নেই। ট্রেন যখন রাস্তার উপর দিয়ে ক্রস করে, তখন গাড়ি আটকানোর কি উপায়? এই ছবিটাই সব বলে দেবে। তখন সেই উর্দিধারী লোকটিই রাস্তায় ব্যারিকেড করে দেয়।

******

এবার আমাদের গন্তব্য দুটি জায়গায়, দুটিরই প্রাচীন ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে। একটি হলো ষষ্ঠ শতকের Chua Tran Quoc প্যাগোডা, প্রায় দেড় হাজার বছরের পুরনো, অন্যটি ১০৭৬ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত ভিয়েতনামের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় (ইউনিভার্সিটি) Quốc Tử Giám (Imperial Academy)। আমি আগে কয়েকবার উল্লেখ করেছি যে ভিয়েতনামের লোকজন প্রাচীন ঐতিহ্য নিয়ে যথেষ্ট গর্ব বোধ করেন, এবং সেগুলি যত্ন সহকারেই আগলে রেখেছেন। আমাদের দুর্ভাগ্য বিদেশী আক্রমণে আমাদের নালন্দা (৪২৭-১০৯৬ ক্রীষ্টাব্দ) ধ্বংস হয়ে যায়। নইলে পৃথিবীর অন্য সব প্রাচীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি অক্সফোর্ড (১০৯৬), বোলগনা ইতালি (১০৮৮), সালামাংকা স্পেন (১১৩৪), প্যারিস (১১৬০), কেম্ব্রিজ (১২০৯), পাদুয়া ইতালি (১২২২), নেপলস (১২২৪), সিএনা ইতালি (১২৪০), কোয়েম্ব্রা পর্তুগাল (১২৯০) এখনও বিদ্যমান। মিশরের আল হাজার উল্লেখ করা যেতে পারে, ৯৭০ খ্রিস্টাব্দে তৈরি, কিন্তু এটি তখন ছিলো শুধুমাত্র একটি মাদ্রাসা কেন্দ্র।

Chua Tran Quoc প্যাগোডা
৫৪৪-৫৪৮ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট Lý Nam Đế নিজের রাজত্বকালে হ্যানয় শহরের প্রাচীনতম এই Trấn Quốc প্যাগোডাটি (Vietnamese: Chùa Trấn Quốc, chữ Nôm: 𫴶鎭國) রেড নদীর পাড়ে স্থাপন করেন। নাম ছিলো Khai Quốc (National Founding), কিন্তু রেড নদীর জল ক্রমাগত মন্দিরের ভেতরে চলে আসার ফলে ১৬১৫ সালে এখনের Hồ Tây (West Lake) লেকের পাড়ে Kim Ngư (Golden Fish) দ্বীপে এই বৌদ্ধ মন্দিরটিকে স্থানান্তরিত করা হয়, মানে ৬০০ বছর আগে। বর্তমানে Trấn Quốc মন্দিরের ভেতরেই এই Chua Tran Quoc প্যাগোডাটি আছে। মাঝে কিছুদিনের জন্য দুটি বিভিন্ন সময়ে এই মন্দিরের দুটি ভিন্ন ভিন্ন নাম হয়ে গিয়েছিলো, An Quốc (Pacification of the Realm) আর Trấn Bắc (Guardian of the North). পরিশেষে বলি, এত প্রাচীন এই মন্দিরটির রক্ষনাবেক্ষনে ভিয়রতনামীদের কোন ত্রুটি নেই।

এই প্যাগোডায় বুদ্ধদেবকে মাতৃরূপেও পূজা করা হয়। তিনটি ভিন্ন রঙের মাতৃরূপ আছে। সবুজ, পাহাড় ও বনজঙ্গলের প্রতীক। সাদা, জলের প্রতীক। আর লাল, আকাশের প্রতীক। এই তিন মূর্তিকে ভিয়েতনামের অন্যতম প্রাচীন দেবতা মানা হয়। এখানের বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা বিবাহ করতেন না, পরিবারের দায় ছিলো না। তাঁরা কয়েক শতাব্দী ধরে এই প্যাগোডাতেই থাকতেন।

West Lake Hanoi
উপরে উল্লেখ করেছি যে রেড নদীর জল ক্রমাগত মন্দিরের ভেতরে চলে আসার ফলে Chua Tran Quoc প্যাগোডাটিকে ১৬১৫ সালে এখনের Hồ Tây (West Lake) লেকের পাড়ে Kim Ngư (Golden Fish) দ্বীপে স্থানান্তরিত করা হয়। এই প্রসঙ্গে Hồ Tây বা West Lake নিয়ে কিছু বলি। সিটি সেন্টারের উত্তর পশ্চিমে এই লেকটি (Vietnamese: Hồ Tây) হ্যানয় শহরের সবথেকে বড় ফ্রেশ ওয়াটার লেক। এবং পরিস্কার জল। আয়তনে ৫০০ হেক্টর, আর পরিধি (circumference) ১৭ কিলোমিটার (১১ মাইল)। অর্থাৎ এর পাড় দিয়ে হাঁটা শুরু করলে, আপনি ১১ মাইল হেঁটে এসে আবার নিজের জায়গায় ফিরে আসবেন। সামনে থেকে লেকের ধারের এই Chua Tran Quoc প্যাগোডাটির পারিপার্শ্বিক সৌন্দর্য্যর ধারণা করা যাবে না। উপর থেকেই (bird’s eye view) এর অপূর্ব দৃশ্য দেখা যায়। বহু আগে রেড নদীর জল শহরের ভেতরে চলে এলে তখনই এই লেকের সৃষ্টি হয়। এখানে ভালো বৃষ্টি হয়, তাই জলের পরিমাণও ভালো। কিছু প্রবাদকাহিনীও আছে। কিছু পন্ডিতের মতে Lạc Long Quân (Dragon King of Lạc) ও নয়টি লেজ বিশিষ্ট এক শেয়ালের আত্মার সাথে প্রবল যুদ্ধের পরেই এর সৃষ্টি। এই কারণে এর নামকরণ হয়েছিলো Đầm Xác Cáo (Fox Corpse Swamp).

Lạc Long Quân (Dragon King of Lạc)

আরেকটি প্রবাদে বলে যে একটি মোষের নিজের বাছুরছানাটি এখানে হারিয়ে গেলে তাকে খুঁজে না পেয়ে সেই মোষটি তান্ডব শুরু করে। সেই কারণে এর অন্য একটি ক্ষণস্থায়ী নামছিলো Hồ Trâu Vàng, বা Hồ Kim Ngưu (Golden Buffalo Lake), একাদশ শতাব্দীতে ঘন কুয়াশার কারণে লোকমুখে এর নাম হয় Hồ Dâm Đàm (Foggy Lake)। অবশেষে ১৫৭৩ সালে সম্রাট Lê Thế Tông এর স্থায়ী নমকরণ করেন West Lake. সারাদিন, আর বিশেষ করে সন্ধার পর এই লেকের ধারে অনেকেই ঘুরতে আসেন। দোকানীরা বিভিন্ন রকমের পসার নিয়ে আসেন। অনেকটা যেন মেলার মতন আসর বসে।

Temple of Literature

Temple of Literature (Vietnamese: Văn Miếu, Hán tự: 文廟) ১০৭০ সালে Lý রাজবংশের সম্রাট Thánh Tông এর শাসনকালে হ্যানয় শহরে এটির নির্মান হয়, মানে আজ থেকে সাড়ে ন’শো বছর আগে। বিদগ্ধ দার্শনিক পন্ডিত কনফুসিয়াসের উদ্দেশ্যে এই প্রতিষ্ঠানটিকে উৎসর্গ করা হয়। ১০৭৬ সালে Lý Nhân Tông এর শাসনকালে এই শিক্ষামন্দিরের প্রাঙ্গণেই ভিয়েতনামের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপন হয়, Quốc Tử Giám (Imperial Academy)। তখন সমাজের উচ্চবর্ণের পরিবারের লোকজন (Vietnam’s bureaucrats, nobles, royalty, and other members of the elite) এই একাডেমিতে বিদ্যাশিক্ষার জন্য আসতেন। Trần রাজবংশের শাসনকালে (১২২৫–১৪০০) এর বিভিন্ন সংস্কার ও পুনঃনির্মান হয়। পঞ্চদশ শতাব্দীর Le রাজবংশের রাজত্বকালে এই প্রতিষ্ঠানের আরও সম্প্রসারণ করা হয়। তখন প্রতিষ্ঠানের দুই শীর্ষপ্রধানের উপাধি ছিলো Tế tửu (Rector) ও Tư nghiệp (Vice Rector), আর শিক্ষকদের বিভিন্ন উপাধিগুলো ছিলো Giáo thụ, Trực giảng, Trợ giáo আর Bác sĩ.

ছাত্ররা পড়তে আসতেন তিন থেকে সাত বছরের জন্য। এখনের দিনের হস্টেলের ধাঁচে দূরের ছাত্ররা এবং অবশ্যই বিদেশের ছাত্ররা মন্দিরের ছাত্রাবাসেই থাকতো, আমাদের প্রাচীন নালন্দার মতন। প্রতি মাসে একটি করে ছোট পরীক্ষা (minor test) আর বছরে চারটি বড় পরীক্ষা (major tests) দিতে হতো। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ন হলে শিক্ষামন্ত্রক (Ministry of Rites, Bộ Lễ, 部禮) পরবর্তী জাতীয় পরীক্ষায় বসার সুযোগ দিত (qualified to sit the national Hội Examination – Thi Hội). আর সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ন হলে রাজকীয় পরীক্ষায় বসার সুযোগ পাওয়া যেত, (qualified to sit the royal Đình Examination Thi Đình, held at court) যেখানে রাজপ্রধান নিজের দরবারে ছাত্রদের ডেকে প্রশ্ন করতেন (ইন্টারভিউ), এবং সেই সাফল্যের উপর নির্ভর করে পরীক্ষার ফলাফল নির্ধারিত হতো (ranked into different grades)। সেই সময়ের ইম্পিরিয়াল একাডেমি ছিলো দেশের সবথেকে নামী ও সবথেকে বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং এখানেই ছিলো সেরা ছাত্রদের সমাবেশ। Văn Miếu, Hán tự এর (Temple of Literature) ছাত্রদের ইম্পিরিয়াল একাডেমিতে ভর্তি হওয়ার জন্য তখনকার দিনের আঞ্চলিক পরীক্ষা (Hương Examination – Thi Hương, Regional Examination) দিয়ে এখানে যোগ্যতা অর্জন করতে হতো। সুতরাং এখন যেমন আমাদের দেশের ডাক্তারি বা ইঞ্জিনিয়ারিং বা ম্যানেজমেন্ট কোর্সে ভর্তির জন্য ছাত্রদের ভালো প্রস্তুতি নিতে হয়, অনুমান করা যায় হাজার বা পাঁচশো সাতশো বছর আগে ভিয়েতনামেও সেরকমই পড়াশোনার মান ছিলো। তবে ১৮০২ সালে Nguyễn রাজবংশের রাজধানী সাময়িকভাবে স্থানান্তরিত হলে এর গুরুত্ব ও ছাত্রসংখ্যা কিছুদিনের জন্য হলেও কমে গিয়েছিলো।

এই একাডেমিতে পড়ানো হতো (syllabus) সাহিত্য, কাব্য, চাইনিজ ইতিহাস ও দর্শনশাস্ত্র। পুরনো কিছু বই পাওয়া গেছে, চাইনিজ ও ভিয়েতনামী ভাষায়। চারটি পাঠ্যপুস্তক ছিলো The Great Learning (Đại Học, 大學), Doctrine of the Mean (Trung Dung 中庸), The Analects (Luận Ngữ, 論語) আর Mencius (Mạnh Tử, 孟子)। কনফুসিয়াসের আগের সময়ের পাঁচটি পাঠ্যপুস্তক ছিলো Classic of Poetry (Kinh Thi, 經詩), Book of Documents (Kinh Thư, 經書), Book of Rites (Kinh Lễ, 經禮), Book of Change (Kinh Dịch, 經) আর Spring and Autumn Annals (Kinh Xuân Thu, 經春秋); আর পড়ানো হতো পুরনো কাব্য।

মন্দির বলি বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বলি, এখানে বৌদ্ধধর্মের চিরাচরিত রীতি অনুযায়ী পাথরের গায়ে, পিলারে, প্রাচীনকালের খোদাই করা বহু ঐতিহাসিক তথ্য, মূল্যবান স্ক্রিপ্ট, চিকিৎসাবিদ্যা আর ছবিতে কাহিনী দেখতে পাওয়া যায়। মোট ৮২ টি Stelae আছে, প্রত্যেকটি এক একটি কচ্ছপের পিঠের উপর স্থাপন করা। ভিয়েতনামীদের বিশ্বাস অনুযায়ী কচ্ছপ ওঁদের দীর্ঘজীবনের প্রতীক, এবং পবিত্র মানা হয়। Stelae কথাটি বাংলায় বোঝাতে পারছি না, ইংরেজিতে সহজ করে বলা যায় an upright stone slab or column decorated with figures or inscriptions, common in old or prehistoric times. এই Stelae গুলির নির্মান চালু হয় ১৪৮৪ সালে। আর ১৪৪২ সাল থেকে নিয়ে ১৭৭৮/৭৯ পর্যন্ত ৮২ টি পরীক্ষায় কৃতকার্য ১৩০৭ জন স্নাতকের (graduates, who passed rigorous exams) নাম, জন্মসময়, আর তাঁদের কিছু কৃতিত্বের কথা এখানে খোদাই করা আছে। আমার মনে প্রশ্ন এসেছিলো, ১৪৪২ থেকে ১৭৭৭৮/৭৯, মানে ৩৩৬ বছরে মাত্র ৮২টি পরীক্ষা হয়েছিলো? এর উত্তর আমি পাইনি। তখন কম্পিউটার ছিলো না, বা কলকাতার দ্বারভাঙ্গা বিল্ডিং এর মতন Administrative Department ছিলো না, সেইজন্যই হয়তো সকল তথ্য সংরক্ষণ করা যায় নি। আবার অনেকের মতে, আরও Stelae হয়তো ছিলো, হাজার বছরের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন যুদ্ধের কারণে হয়তো অনেকগুলি নষ্ট হয়ে গেছে, বা সংরক্ষণ করা যায় নি।

প্রসঙ্গে বলি, ভিয়েতনামীদের চারটি পবিত্র প্রতীক হলো কচ্ছপ, ড্রাগন, ইউনিকর্ন (গ্রীক ও ল্যাটিন পুরাণে বর্ণিত সিংহের ল্যাজবিশিষ্ট কাল্পনিক একশৃঙ্গি অশ্ব), আর ফিনিক্স পাখী (গ্রীক পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে অমরত্বের প্রতীক, মরুভূমির একটি রূপকথার পাখী, ছাই থেকে পুনরুত্থিত হবে বলে বিশ্বাস করা হয়)

এই শিক্ষামন্দির প্রাঙ্গণের সামনের দিকটা খোলা, প্রবেশদ্বার। আর তিনদিক ঘিরে লম্বা চওড়া বারান্দা। প্রবেশদ্বারের মুখোমুখি, মানে উল্টোদিকের টানা বারান্দার মধ্য দিয়ে গেলে একটি হলঘরে কনফুসিয়াসের এক আবক্ষ মুর্তি আছে।.যখন তৈরি হয়েছিলো, নির্মাতারা বানিয়েছিলেন সেইসময়ের বিশ্বমানের একটি শিক্ষাপ্রতিষ্টান। তাঁরা জানতেন না যে আগামী হাজার বছরে দেশ বিদেশের বহু কোটি বৌদ্ধধর্মাবলম্বী বা ট্যুরিষ্টরা এখানে পূণ্য অর্জনে বা নিছক বেড়াতে আসবেন। হাজার বছর ধরে বিভিন্ন সময়ের পূণ্যার্থীরা এখানে বিরাট পরিমানের সামগ্রী দান করে গেছেন (সোনা রুপার অলঙ্কার, মূল্যবান বই, স্যুভেনির, ইত্যাদি), আর এখন এখানের ব্যাবস্থাপনার দ্বায়িত্বে যারা আছেন, তাঁদের কথায় এত মূল্যবান সামগ্রী রাখার স্থানের সংকুলান হচ্ছে না। অদূর ভবিষ্যতে এখানে নতুন ভবন বানিয়ে মিউজিয়াম বানানোর পরিকল্পনা চলছে, আবার রক্ষণশীলরা এই প্রাঙ্গণে নতুন কিছু নির্মানের বিরোধী। সুতরাং ভবিষ্যৎই বলবে, এরপর কি হবে।

আমাদের দেশে লোকজন যেমন পরীক্ষার আগে বা বিয়ের সময় কালীঘাটে গিয়ে আশীর্বাদ প্রার্থনা করেন, সেরকম প্রথা, অন্যভাবে এখানেও চালু আছে। প্রথাগতভাবে ছেলেরা বেলুন আর ফুল নিয়ে আসে, আর মেয়েরা আসে নিজেদের প্রথাগত Aoi Dai পোষাকে। এখানে পূজো দেওয়া মানে কনফুসিয়াসের মূর্তির সামনে ফুল রেখে প্রার্থনা করা। নইলে নিছক বেড়াতে আসার জন্য স্কুল কলেজের ছেলেমেয়েরা পয়সা খরচ করে বেলুন আর ফুল কিনে এখানে সময় কাটাতে আসবে না।

Tết Festival

হ্যানয় শহরে সুদীর্ঘদিনের এক সামাজিক প্রথা চালু আছে। বসন্তকালকে আবাহন করে নতুন বছর Tết ভিয়েতনামের একটি বড় উৎসব। Vietnamese:Tết Nguyên Đán কে সংক্ষিপ্ত করে Tết বলা হয় (Festival of the First Day), পালিত হয় ভিয়েতনামের lunisolar Chinese ক্যালেন্ডার অনুযায়ী। গ্রিগোরিয়ান ক্যালেন্ডারের জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারি মাসে। ভিয়েতনামী নতুন বছর উপলক্ষ্যে এই মন্দিরে বহু মানুষের সমাগম হয়। প্রাচীন বিশ্বাস মতে সেইদিন বহু লোক এখানে এসে মন্দিরের দেওয়ালে নিজেদের ইচ্ছাগুলি (wishes) লিখে দিয়ে যান। calligraphists রাও আসেন, মন্দিরের বাইরে এসে জমায়েত হন। ক্যালিগ্রাফিস্ট বাংলায় কি হবে জানি না, সহজ কথায় যার হস্তাক্ষর খুব সুন্দর (the art of writing beautifully with a special pen or brush)। এনারাও কিছু পারিশ্রমিকের বিনিময়ে সাধারণ দর্শনার্থীদের ইচ্ছাগুলি (wishes) লিখে দিতে সাহায্য করেন। লোকজনেরা অনেকসময় এগুলি উপহার হিসেবে বা গৃহসজ্জার জন্যও বানিয়ে নেয়।

তবে একটি কথা। Tết Nguyên Đán আর Tết Trung Thu (Mid-Autumn Festival) এক নয়। দ্বিতীয়টি শিশু উৎসব (Children’s Festival in Vietnam). ভিয়েতনামে “Tết” শব্দটি উৎসব উপলক্ষ্যে বৃহত্তর অর্থে ব্যাবহার করা হয়।

Tet নিয়ে আরও একটি আপাত প্রাসঙ্গিক ইতিহাস বলি। Tet এর অপপ্রয়োগও হয়েছে, তার চরম নিন্দাজনক ও দুঃখজনক উদাহরণ আমেরিকানদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কালে ১৯৬৮ সালের ৩০শে জানুয়ারির The Tet Offensive, সেই আমলের একটি পরিকল্পিত বিরাট সেনা আক্রমণ (a major escalation and one of the largest military campaigns of the Vietnam War). মার্কিন সেনারা জানতো যে সেই বিশেষ দিনে সাধারণ লোকজন সকলেই উৎসবের আনন্দে থাকবে, হয়তো গেরিলারাও। তাই এক অতর্কিত ভয়াবহ আক্রমণের পরিকল্পনা করা হয়। ভিয়েতনামের ইতিহাসে মার্কিন সরকার বহু অমানবিক ঘটনার নিদর্শন রেখে গেছে। কিন্তু একটি বিশেষ উৎসবের দিনে দেশের নিরীহ সাধারণ লোকেদের উপর এইধরনের আক্রমণ পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল আজকাল উগ্র চরমপন্থী আতঙ্কবাদীরা ধর্মীয় দিনে নিরীহ মানুষের উপর আক্রমণ চালায়। কিন্তু একটি দেশের সরকার যে এরকম করতে পারে, আমেরিকা তার একমাত্র উদাহরণ।

*****

সেই সকালে ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়েছিলাম। মে মাসের গরম, সেই সকাল থেকে ট্রেন স্ট্রিট, Chua Tran Quoc প্যাগোডা, ওয়েস্ট লেক, আর টেম্পল অফ লিটারেচর ঘুরে শরীর আর দিচ্ছে না। সবাই ঘেমে অস্থির। আসলে সবকটিই তো খোলা আকাশের নীচে। আমরা যাকে বলি ওপেন এয়ার। কনফুসিয়াসের হলঘরে সামান্য আধঘন্টার বিশ্রাম নিয়েছিলাম, ব্যাস ঐটুকুই। সঙ্গে যা জল নিয়ে বেরিয়েছিলাম, শেষ হয়ে গেছে। টেম্পল অফ লিটারেচরের বাইরে কোক কিনলাম, কোকের দাম প্রায় জলের দামের কাছাকাছি।
বিকেল হয়ে এবার সন্ধ্যে আসছে।
হোটেলে ফিরে এলাম।

*******

 

 

Asim Deb

Add comment